প্রথমবারের মত রাউন্ড রবিন লিগ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয়দের কাছে দশ উইকেটের হার দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ মিশন। এরপর ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার কাছেও ধরাশয়ী। রাউন্ডের বাকি ম্যাচ গুলো খেলে তখন শুধু দেশের বিমান ধরার অপেক্ষা করার কথা পাকিস্তানের। তবে অধিনায়ক ইমরান খান ভেবেছিলেন অন্যকিছু, যা ভেবেছিলেন তা এখন ক্রিকেটের অনন্য ইতিহাস।
১৯৯২ ওয়ানডে বিশ্বকাপের কথা বলছিলাম। রাউন্ড রবিন লিগের সেই বিশ্বকাপে একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল নয়টি দল। সেখান থেকে সেরা চার দল খেলবে সেমিফাইনাল। ওদিকে পাকিস্তান প্রথম ম্যাচে জয় পেয়েছে মাত্র একটি। তাই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটায় বৃষ্টি এসে মান বাঁচিয়েছিল। না হলে সেটিতেও হার প্রায় নিশ্চিতই ছিল। আর বাকি তিন ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারতের কাছে ভরাডুবি।
বিশ্বকাপের প্রথম পাঁচ ম্যাচ খেলার পর এতটাই করুণ ছিল পাকিস্তানের অপেক্ষা। ক্রিকেট বোদ্ধারা তখন ধরেই নিয়েছে পাকিস্তান বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। শুধুই নিয়ম রক্ষার খাতিরে ম্যাচগুলো খেলা। তবে ইমরান খানের দল শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য খেলেনি। অমন বিধ্বস্ত একটা দলের মধ্যেও লড়াই করার শক্তি নিয়ে আসেন ইমরান খান। ক্রিকেট ইতিহাসে যার অধিনায়কত্ব যেন এক রূপকথার গল্প।
ক্রিকেট ইতিহাসে ইমরান খানের মত চরিত্রও আর নেই। বলা হয় কোন দলে যদি ইমরান খান থাকেন তাহলে চোখ বন্ধ করে তিনিই অধিনায়ক। তিনি থাকা অবস্থায় অন্য কেউ অধিনায়ক হতে পারে না। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা চুল ও ছয় ফুট দুই ইঞ্চির একটা শরীর। পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসকে এই একটা জায়গায় এসে থামতেই হবে।
গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে একটা মুহূর্তের জন্য থমকে দিয়েছিলেন এই অধিনায়ক। একটা এলোমেলো দলকে এক সুঁতোয় বেঁধেছিলেন। তাঁদেরকে নিয়ে বিশ্বজয় করে ফেলেছিলেন। ইমরান খান কত বড় ক্রিকেটার কিংবা কত বড় অলরাউন্ডার তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। তবে অধিনায়ক ইমরান খান বুঝি তার চেয়েও অনেক বড়।
ক্রিকেটপাড়ায় একটা গল্প রচিত আছে। তিনি যখন অধিনায়ক হিসেবে দল নির্বাচনী সভায় ঢুকতেন তখন নাকি তাঁর পকেটে দুইটা কাগজ থাকতো। একটা তাঁর পছন্দের একাদশ আরেকটা তাঁর পদত্যাগ পত্র। টেবিলের ওপর দুটো পাশাপাশি রাখা থাকতো নাকি! হয় এটা নাও , না হলে ওটা। এই গল্পের সত্যতা কতটুকু তা জানা নেই। তবে মানুষটা যে এমনই দৃঢ় ছিলেন তা বিশ্বাস করি।
প্রথম পাঁচ ম্যাচে অমন অবস্থার পর পাকিস্তান ঘুরে দাঁড়িয়েছিল তাঁর নেতৃত্বেই। পাকিস্তান একটা বিশ্বকাপ পেয়েছিল এই মানুষটার জন্যই। পরের ম্যাচে আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দিল দলটা। এই পাকিস্তানকে আর রুখবে কেউ। ইমরান খানের ওই দলটার সামনে সত্যিই আর কেউ বাঁধা হতে পারেননি।
এরপর শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও বড় ব্যবধানে জয়। তবে চ্যাম্পিয়ন দল অস্ট্রেলিয়ার ঝুলিতেও চার দল। তবে রান রেটের হিসেবে এগিয়ে ছিল পাকিস্তান। বৃষ্টির কারনেও পেয়েছিল এক পয়েন্ট। ফলে ৮ ম্যাচে ৯ পয়েন্ট নিয়ে সেমিফাইনালে ওঠে দলটা।
সেমিফাইনালে পাকিস্তানের সামনে ছিল কঠিন প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। ২৬৩ রানের বড় টার্গেটই দিয়েছিল কিউইরা। তবে ইনজামাম উল হকের ঝড়ো ইনিংসে সেই পাহাড় ডিঙিয়ে ফেলল পাকিস্তান। চার উইকেটের জয় নিয়ে ফাইনালের পথে পাকিস্তান। এবার প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড।
এবার অধিনায়ক ইমরান খান একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। তাঁর ব্যাট থেকে এলো ৭২ রানের ইনিংস। সাথে জাভেদ মিয়াঁদাদ করলেন ৫৮ রান। শেষে ওয়াসিম আকরামের ব্যাট থেকে আসলো ১৮ বলে ৩৩ রানের ঝড়ো ইনিংস। ২৪৯ রানের লড়াকু সংগ্রহ পেল পাকিস্তান। জবাবে ব্যাট করতে নামা গ্রাহাম গুচের দলকে থামিয়ে দিয়েছিলেন ওই ওয়াসিম আকরামই। বল হাতেও তিন উইকেটে হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। ইমরান খানরা একটা বিশ্বকাপ জয় করে ফেললো সেদিন। পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাস লেখা হল নতুন করে।