সে এক সময় ছিল তখন, ভারত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি বরাবরই একদিনের ক্রিকেটে সাত ব্যাটসম্যান আর চার বোলারের নীতি আঁকড়ে থাকতেন, থাকার যথেষ্ট কারণও ছিল। কারণ সে সময় দেশে এমন কোনো আন্তর্জাতিক মানের অলরাউন্ডার ছিল না যার ওপর একদিনের ম্যাচে ভরসা করা যায়, আরো একটা কারণ ছিল – তখন দলে একঝাঁক পার্ট টাইম বোলার ছিলেন, যারা পঞ্চম বোলারের কাজটা মোটামুটি উৎরে দিতেন।
অর্থাৎ, দলে মূলত যাদের কাজ ব্যাটিং, কিন্তু দরকারে হাত ঘুরিয়ে দু একটা উইকেট এনে দিতে পারেন, এনারাই সেই পার্ট টাইম বোলার জাতি, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একদিনের ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ধরে চলা পার্ট টাইম বোলিং কি ক্রমশ বিলুপ্তির পথে?
সৌরভের আমলে বেশিরভাগ সময়ই সাফল্য এসেছে তাদের হাত ধরে, এই ‘তাদের’ বলতে মূলত শচীন, শেবাগ, যুবরাজ আর অধিনায়ক স্বয়ং। এই চার জনের সাথে দীনেশ মোঙ্গিয়া বা হেমাঙ বাদানিরাও কখনো কখনো এসে জুটতেন। ক্যারিয়ার শেষের পর যদি দেখা যায়, এদের সবাইকে মেলালে একদিনের ক্রিকেটে মোট উইকেটের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৫০০!
সময় বদলের সাথে সাথে অধিনায়কত্বের ব্যাটন বদলে দ্রাবিড় বা ধোনিদের হাতে এলেও পঞ্চম বোলার হিসাবে পার্ট টাইমার দিয়ে কাজ চালানোও চলতে লাগলো, কিন্তু যুবরাজ আর রায়না চলে যাওয়ার পর ধোনির দলেও পার্ট টাইম বোলারের অভাব ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছিল। সে সময় নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে একদিনের সিরিজে কেদার যাদবের ওপর ভার পড়লো পার্ট টাইম বোলারের কাজ চালানোর, বছর দুয়েক ভালোই কাজ চালালেন কেদার, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অনেকবার ব্রেক থ্রু দিয়েছেন তিনি মিডল ওভারে।
কেদারের ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিকতার অভাব তাঁর দলে জায়গাকে এখন অনিশ্চিত করেছে, ফলত কোহলির ব্রিগেডে এই পার্ট টাইম বোলিং করার লোকের বড়ই অভাব বর্তমানে, অধিনায়ক নিজে মাঝে মাঝে আগে হাত ঘোরাতেন, সে দৃশ্য দেখা যায় না এখন আর। একদিনের দলে শ্রেয়াস আইয়ার, মানিশ পান্ডে, শিখর ধাওয়ান বা সদ্য দলে আসা মায়াঙ্ক আগারওয়ালরা কেউই একদিনের ক্রিকেটে বল হাতে তোলেন না।
রোহিত শর্মা, যিনি আইপিএলে হ্যাটট্রিকের মালিক, তিনিও বল করা ছেড়েছেন বহুকাল হলো। প্রশ্ন হচ্ছে এর কারণ কি? একদিনের ক্রিকেটে বাউন্ডারি ক্রমশ আগের তুলনায় ছোট হয়ে যাওয়ার ফলে মার খাওয়ার ভয় নাকি বিপক্ষের গদাব্যাট ধারীরা তাঁদের বলকে অবলীলায় বাউন্ডারির বাইরে পাঠাবেন সেই ভয়? কিংবা বর্তমানের টি-টোয়েন্টির যুগে অতিরিক্ত খেলার ধকলে বল করার দায়িত্বটা আর নতুন করে নিতে চান না? না।
কি নিজেদেরই আর বল করার গরজটা কমে যাচ্ছে দিনকে দিন? উত্তর মনে হয় সবকটাই। দলে ৪ বোলার ও এক অলরাউন্ডার থাকার পরেও বহু সময়ই দরকার পড়ে আরেকজনের, কারণ কোনো খারাপ দিনে সেই ৫জনের মধ্যে দুজনের অফ ডে যেতেই পারে, তখন কিন্তু ঐ পার্ট টাইমার একজনও না থাকাটা বা মিডল ওভারে একটা ঝটকা দিয়ে উইকেট তুলতে না পারাটা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পার্ট টাইম বোলার কমে যাওয়ার এই ট্রেন্ড কি শুধু এ দেশেই নাকি গোটা বিশ্বজুড়ে? আসুন দেখা যাক। যদি অস্ট্রেলিয়ার দিকে তাঁকানো যায় দেখা যাবে ৪ মূল বোলারের পাশে স্টোয়নিস অলরাউন্ডারের কাজটা আর ম্যাক্সওয়েল ঐ পার্ট টাইম বোলিংয়ের কাজটা মোটামুটি চালিয়ে দেন, কিন্তু আগের মতো দলে একঝাঁক পার্ট টাইমার কিন্তু নেই। এককালের মাইকেল ক্লার্ক, মাইকেল বেভান, ড্যারেন লেম্যান বা ড্যামিয়েন মার্টিনরা অনেক বেশি পরিমাণে বোলিং করতেন, এখনকার স্টিভ স্মিথরা বল করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন।
অজিদের পড়শী নিউজিল্যান্ডের দিকে যদি তাঁকানো যায় সেখানে পার্ট টাইম বোলার একটু আধটু তাও পাওয়া যায়, অধিনায়ক উইলিয়ামসন বা কলিন মুনরোরা মাঝে মাঝে হাত ঘোরান, কিন্তু বছর পনেরো ষোলো আগের আস্টল, ম্যাকমিলান, স্টাইরিশদের মতো তাঁরা নন, যে নিয়মিত বোলিং করে উইকেট তুলবেন। কিউই বোলিংয়ে সান্টনার, নিশ্যাম বা গ্র্যান্ডহোম অলরাউন্ডার হিসেবে থাকেন বলে পার্ট টাইমারের ব্যাপারটা যদিও সামলে দেওয়া যায়।
উপমহাদেশের ক্রিকেটে যদি ফেরা যায় দেখা যাবে একমাত্র বাংলাদেশে পার্ট টাইম বোলার যথেষ্ট আছেন, মাহমুদউল্লাহ বল হাতে যথেষ্ট ভরসা যোগ্য, সাথে সৌম্য সরকার মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে কাজ চালিয়ে দিতে পারেন সাথে মোসাদ্দেক হোসেনও অফস্পিন বোলিংয়ে চলনসই।
শ্রীলঙ্কায় অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউস এক সময় অলরাউন্ডারই ছিলেন, এখন খুব দরকার না পড়লে বল হাতে তোলেন না, এক প্রকার পার্ট টাইমারই হয়ে গেছেন তিনি, এ ছাড়া দানুস্কা গুনতিলাকে ছাড়া এ যুগের লঙ্কান দলেও সেরকম পার্ট টাইম বোলিংয়ে কেউ পারদর্শী নন, মাঝে আসিলা গুনরত্নে ভালো করছিলেন, কিন্তু ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিকতা না থাকায় ছিটকে যান। অরবিন্দ, রানাতুঙ্গাদের সে যুগ তাঁদেরও আর নেই।
পাকিস্তান দলেও মালিক, হাফিজের মতো মিডল ওভারে নিয়মিত বল করার লোক বড়ই কম। আজকের বাবর আজমরা মোটেই হাত ঘোরাতে উৎসাহী নন, হ্যারিস সোহেল টুকটাক বোলিং করলেও ভরসা সেই অলরাউন্ডারের ওপরই। তবে বর্তমানে ইফতিখার আহমেদ বা খুশদিল শাহ মাঝের ওভার গুলোতে বোলিং করছেন, তবে বড় দলের বিপক্ষে সে পরীক্ষা এখনো অনেক বাকি। আফগান দলে গুলবদিন নাইব ও মোহাম্মদ নবীর মতো অলরাউন্ডার থাকায় পার্ট টাইম বোলিং বড় একটা প্রয়োজন পড়ে না, পড়লেও রহমত শাহ কাজ চালিয়ে দেন।
অলরাউন্ডারের দেশ বলা হয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে, যুগে যুগে নামী দামি সব অলরাউন্ডার তারা বিশ্বক্রিকেটকে দিয়ে এসেছে, পার্ট টাইম বোলিং না থাকলেও দিব্বি চলে যেত, কিন্তু সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ভালো মানের অলরাউন্ডারের ই আজ বড় অভাব, তো পার্ট টাইমার!! ডুমিনির মতো মিডল ওভারে বোলিং করে ব্রেক থ্রু দেওয়ার কেউ নেই, মার্করাম মাঝে মধ্যে বল হাতে নিতেন, কিন্তু ব্যাটিংয়ে ফর্ম হারিয়ে তিনি এখন নিজেকে খুঁজছেন।
ল্যাঙ্কাশায়ারে কাউন্টি খেলার সময়ে ফাফ ডু প্লেসিস নিয়মিত বোলিং করতেন, পরে নতুন নতুন দলে ঢুকেও করেছেন, সেসব আজ অতীত। রিজা হেনড্রিক্স বা রাসি ভ্যান ডের ডুসেনরা কেউই কাজ চালানোর মতো বোলিং করেন না, এ এক বিরাট সমস্যা প্রোটিয়াদের। আফ্রিকার আরেক দেশ জিম্বাবোয়েতে পার্ট টাইম বোলারের কোনোকালেই অভাব ঘটেনি, আজও নেই, উইলিয়ামস বা সিকান্দার রাজারা দিব্বি কাজ চালিয়ে দেন।
ইংল্যান্ড এই মুহূর্তে একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বজয়ী দল, বেন স্টোকসের মতো অলরাউন্ডার সে দলে আছেন, তার পাশে জো রুট ব্যাটসম্যান হয়েও দলের প্রয়োজনে তাঁর অফ স্পিনকে কাজে লাগান, স্মিথ বা কোহলির মতো বল হাতে নেওয়া একেবারে বন্ধ করেননি, পার্ট টাইম বোলারের অভাব ভারতের মতো এতটাও প্রকট নয় ইংরেজদের।
প্রতিবেশি আয়ারল্যান্ডে একসময় পল স্টার্লিং পার্ট টাইম বোলিংয়ে যথেষ্ট ফুল ফুটিয়েছেন, কিন্তু কালের অমোঘ নিয়মে তিনিও কোহলিদের পথই নিয়েছেন। কোয়ালিটি অলরাউন্ডারের অভাব আইরিশদের বর্তমানে দেখা দিলেও নবাগত কুর্টিস কাম্ফার সে চাহিদা ভবিষ্যতে হয়তো পূরণ করবেন, কিন্তু মিডল ওভারে ঝটকা দেওয়ার লোক তাঁদের দলেও কমছে, ফলত নিয়মিত ৩০০+ রান ইদানীং আইরিশদের বিরুদ্ধে উঠছে।
ক্যারিয়াবিয়ান দলে সারওয়ান, গেইল, ওয়াভেল হাইন্ডস বা স্যামুয়েলসদের সেই পার্ট টাইম বোলিংয়ের যুগেরও আজ অবসান হয়েছে, এযুগের মেরুন জার্সির ব্যাটধারীরা মানে এভিন লুইস, সিমরন হেটমায়ার, ড্যারেন ব্র্যাভোরা পারতপক্ষে কেউ বল হাতে তোলেননা, পোলার্ড যদিও এখন পার্ট টাইমারই হয়ে গেছেন, তবে রোস্টন চেস বা হোল্ডারের মতো অলরাউন্ডার থেকেও নিয়মিত তাঁদের বিরুদ্ধে ৩০০+ রান ওঠা কেউ আটকাতে পারছে না।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিশ্বজুড়েই আজ পার্ট টাইম বোলারের বড়ই আকাল, ব্যাটসম্যানরা অতিরিক্ত খেলার ধকলে হয়তো বল হাতে নেন না, কিংবা সর্বদা মাথায় কাজ করে বল হাতে নিলেই ছোট বাউন্ডারির ফলে মার খাওয়ার ভয়। ফলত ৩০০+ রান করেও কোনো দল এখন আর নিরাপদ নয়, সব দলই বিপক্ষের ঐ অতিরিক্ত বোলার না থাকার ফাঁক খোঁজার চেষ্টা করছে। একদিনের ক্রিকেটেও এক বিরাট বদল ঘটে পার্ট টাইম বোলিংয়ের ধারাও বোধহয় আজ ক্রমশ বিলুপ্তিরই পথে।