৪৫ টেস্টে ৩২.৮৭ গড়ে ১৩৪ উইকেট। আর ২৪ ওয়ানডেতে ২৯ উইকেট। এরকম সাদামাটা পরিসংখ্যানের একজন বোলারকে আলাদা করে মনে রাখার কোন কারণই নেই। কিন্তু পল অ্যাডামসকে ক্রিকেট বিশ্ব ঠিকই মনে রেখেছে।
পল অ্যাডামসের নাম শোনেন নি কিংবা তাঁর কথা মনে নেই এমন ক্রিকেটপ্রেমী খুব কমই আছেন। সাবেক এই প্রোটিয়া ‘চায়নাম্যান’ বোলার যতটা না তাঁর বোলিংয়ের জন্য বিখ্যাত, বরং তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন তাঁর আশ্চর্যরকম ‘ইউনিক’ ও ‘ব্যতিক্রমী’ বোলিং অ্যাকশনের জন্য। এমন ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে এর আগে কেউ আসেননি। ভবিষ্যতেও আসবেন কি না সন্দেহ!
চায়নাম্যান বোলার ক্রিকেট বিশ্বে এমনিতেই বিরল। তবে প্রথাগত চায়নাম্যানদের চেয়ে পলের বল ছোঁড়ার ধরন ছিল একেবারেই আলাদা। অদ্ভুতভাবে শরীরটা বাঁকিয়ে হাত ঘুরিয়ে এবং মাথা নিচু করে বল করতেন তিনি।
সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক ও কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান মাইক গ্যাটিং পলের এই অদ্ভুতুড়ে বোলিং অ্যাকশনের নাম দিয়েছিলেন ‘ফ্রগ ইন আ ব্লেন্ডার’!
পল অ্যাডামসের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ক্রিকেটার হবেন। সেই লক্ষ্য পূরণে মাত্র ১০ বছর বয়সে নাম লেখান স্কুল ক্রিকেটে। জুনিয়র লেভেলে হার্ডহিটার ব্যাটসম্যান হিসেবে বেশ নামডাকও হয়েছিল। সাথে টুকটাক বোলিংও করতেন।
হাইস্কুলে ওঠার পর স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষক পলের মধ্যে বোলিং প্রতিভার দেখা পেলেন। ব্যাটিং ছেড়ে পুরোদস্তুর স্পিনার হবার পরামর্শটা সর্বপ্রথম তিনিই দিয়েছিলেন। ওই শিক্ষকের পূর্ণ তত্ত্বাবধানেই একজন লেফট আর্ম আন-অর্থোডক্স স্পিনার হিসেবে ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলেন পল। আসলে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন যে বোলার হিসেবে পল ঠিক কতটা ‘আন-অর্থোডক্স’ ছিলেন!
পল অ্যাডামসকে বল করতে দেখাটা শুধু ক্রিকেট মাঠ নয়; বরং সমগ্র পৃথিবীরই সবচাইতে আশ্চর্যজনক দৃশ্যগুলোর একটি। ছোট্ট রানআপে স্বাভাবিকভাবেই দৌড়ে আসতেন তিনি কিন্তু বল ছাড়ার মুহূর্তেই চোখমুখ কুঁচকে যেত তাঁর! ঘাড়সহ মাথাটা অদ্ভুতভাবে বেঁকে যেত প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি! বল ডেলিভারি দেওয়ার আগমুহূর্ত পর্যন্ত মাথাটা ঝুঁকে থাকত মাটির দিকে। এমনকি বল ছাড়ার সময়ও শরীরটা এমন অস্বাভাবিকভাবে বাঁকিয়ে রাখতেন যে ব্যাটসম্যানকে দেখতে পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না! তাই বলা যায়, অনেকটা চোখ বন্ধ করে না দেখেই বল করতেন তিনি!
নিজের অমন বিদঘুটে বোলিং অ্যাকশন নিয়ে পলের বক্তব্যটা ছিল এরকম, ‘লোকে ভাবে বল করার সময় আমি হয়তো ব্যাটসম্যানদের দেখতে পাই না। আসলে পাই। আমি যখন মাথা নিচু করি, আমি মনের চোখ দিয়ে তাঁদের দেখি। এটা অনেক অনুশীলন করে পেয়েছি, এটা স্রেফ ভাগ্যের জোরে হয় না।’
১৯৯৫ সালে মাইক আথারটনের নেতৃত্বে প্রোটিয়া সফরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। এদিকে ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স দিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়ছিলেন অ্যাডামস। ঘটনাক্রমে সুযোগ মিলে যায় সেই সফরেরই এক প্রস্তুতি ম্যাচের দলে। ব্যস এক সুযোগেই বাজিমাত! প্রথম সুযোগেই গ্রায়েম হিক, গ্রাহাম থর্প, অ্যালেক স্টুয়ার্টের মত ব্যাটসম্যানের উইকেটসহ পলের শিকার ইনিংসে ৫ উইকেট। যার ফলশ্রুতিতে ডাক পেয়ে যান টেস্ট সিরিজের জন্য ঘোষিত মূল স্কোয়াডেও।
১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে পোর্ট এলিজাবেথে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৮ বছর ৩৪০ দিন বয়সে টেস্টে অভিষিক্ত হন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সে টেস্ট অভিষেকের রেকর্ড এটাই। অভিষেক ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে পলের শিকার ছিল ৪ উইকেট।
বিচিত্র অ্যাকশন আর চায়নাম্যান বোলিংয়ের রহস্য – এ দু’য়ে মিলে ক্রিকেট বিশ্বের কাছে পল অ্যাডামস ছিল একটি বিস্ময়ের নাম। তবে সেই বিস্ময়ের ঘোর কাটতেও খুব বেশিদিন সময় লাগে নি। বোলিংয়ে কন্ট্রোলের অভাব আর হাতে যথেষ্ট ভ্যারিয়েশন না থাকায় অল্প কদিনের ভেতরেই পলের ‘চায়নাম্যান রহস্য’ ভেদ করতে সমর্থ হয়েছিলেন বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যানরা।
পলের এই অদ্ভুত বোলিং একশন নিয়ে সমালোচনাও কম হয় নি। সাবেক দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার ও কোচ এডি বার্লো বলেছিলেন, পল নাকি চায়নাম্যান বোলিংয়ের বিভিন্ন ভ্যারিয়েশন ‘গুগলি’, ‘ফ্লিপার’ এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই জানে না। তাঁর ডেলিভারি গুলোকে উল্লেখ বলেছিলেন অর্ডিনারি ‘ইনস্পিনার’ কিংবা ‘আউটস্পিনার’ হিসেবে।
৪৫ টেস্টে পলের শিকার ১৩৪টি উইকেট যা রেকর্ড হিসেবে একেবারে খারাপও না। প্রোটিয়া বাঁ হাতি স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডও এখন পর্যন্ত এটাই। তাছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও বেশ সফল ছিলেন তিনি। ১৪১ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ৪১২ টি।
২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে কেপটাউনের নিউল্যান্ডসে ক্যারিয়ারের ৩৪ তম টেস্ট ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সপ্তম বোলার হিসেবে ১০০ উইকেটের মাইলফলক অর্জন করেন পল। ২০০৩ সালে লাহোর টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংসে পেয়েছিলেন ৭ উইকেট। যেটা ছিল পলের ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার (১২৮/৭)।
কিছু খেলোয়াড় থাকেন যাদের খেলা খুব অল্প সময়ের জন্য দেখলেও সারাজীবন মনে থাকে। পল অ্যাডামস সেরকমই একজন ক্রিকেটার যাকে আসলে একবার দেখলে ভোলা সম্ভব না। তবে অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করলেও ক্যারিয়ারটা লম্বা করতে পারেননি তিনি।
ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে ইনজুরিতে পড়া, ড্রাগ নেওয়াসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়া, বৈচিত্র্যহীন বোলিং, স্পেশালিষ্ট স্পিনার হিসেবে নিকি বোয়ের উত্থান – এসব বিভিন্ন কারণে মাত্র ৪৫ টেস্টেই থেমে যায় সাবেক এই বাঁহাতি রিস্ট স্পিনারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অধ্যায়।
টেস্টের পাশাপাশি খেলেছেন ওয়ানডেতেও তবে নিয়মিত সুযোগ না পাবার কারণে দলে থিতু হতে পারেননি। ২০০৪ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন পল অ্যাডামস।
১৯৭৭ সালের ২০ জানুয়ারি কেপটাউনের গ্রাসি পার্কে জন্মেছিলেন এই বাঁহাতি লেগ স্পিনার। তাঁর পুরো নাম পল রিগান অ্যাডামস।
ড্রেসিংরুমে সতীর্থদের কাছে পল পরিচিত ছিলেন ‘গগা’ নামে। মজার এই নামটি পলকে দিয়েছিলেন তাঁরই সাবেক সতীর্থ ব্রায়ান ম্যাকমিলান। ‘গগা’ হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় এক প্রকার মাছি জাতীয় পতঙ্গের নাম। পলের ভাষায়, ‘ও (ম্যাকমিলান) যখন নেটে আমাকে প্রথম আমার ভিন্নধর্মী বোলিং অ্যাকশন দেখে তখন বলে – আরে তুমি তো পুরোই গগা!’