স্যার ববি চার্লটন তো বলতেন ফুটবলটা তাঁর জন্যেই আবিষ্কার হয়েছে। তাঁকে নিয়ে রূপকথার গল্প তৈরি হয়েছে শতশত। বাবাকে দেয়া কথা রাখতেই কিনা বিশ্বজয় করেছিলেন কিশোর বয়সেই। গোলসংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছেন হেসেখেলেই। একবার তো যুদ্ধই থামিয়ে দিয়েছিলেন, নাইজেরিয়া আর বায়াফ্রার মুক্তিকামী মানুষরা বল পায়ে তাঁর ছুটে চলা দেখা থেকে বঞ্চিত থাকতে চাননি। গ্যালেয়ানো একবার বলেছিলেন, ‘বল পায়ে তাঁর মূহুর্তগুলো এতটাই অপার্থিব যে আমাদের অমরত্বে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।’
তাঁকে খুঁজে পেতে সেই পুরনো আপ্তবাক্যই মাথায় ঘুরেফিরে আসে। ‘তিনটা জিনিস পৃথিবীতে সবাই চেনে। কোক, যীশু আর পেলে!’
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ক্লোরাকাসে এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম। যদিও সার্টিফিকেট বলে তারিখটা ভুল, ফুটবল ঈশ্বর পৃথিবীতে এসেছিলেন আরো দুদিন আগে। তাতে থোড়াই কেয়ার, ব্রাজিলিয়ানরা যে অ্যাকুরেসি নিয়ে এতটা ভাবে না!
মা আদর করে ডাকতেন ডিকো নামে। স্কুলের খাতায় নামটা অবশ্য দেয়া হয়েছিল বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসনের নামে। এডসন আরান্তো দো নসিমেন্তো! কিন্তু ফুটবল ঈশ্বর হওয়াই যার নিয়তি, সে কি আর বাবা-মায়ের রাখা নামে বেড়ে উঠবেন। ঈশ্বরকে তো ডাকবেন তাঁর ভক্তরা, তাঁরা যেভাবে ডাকবেন সে নামেই তো পরিচিত হবেন।
পরিবারের সামর্থ্য ছিল না ফুটবল কিনে দেয়ার। তাই বলে কি খেলা থেমে থাকবে! পুরনো মোজা দিয়েই তিনি জাদু দেখিয়ে যান ক্লোরাকাসের রাস্তায়। স্কুলের বন্ধুরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মুগ্ধ ভক্তের ন্যায় ঈশ্বরকে তাঁরা ডাকে ‘পেলে’!
সময় গড়ায়, আমাজনের আরো গহীনে বাড়ে মানুষ। পেলেও দ্যুতি ছড়াতে শুরু করেন আপন মহিমায়। স্কুলের আঙিনা কিংবা রাস্তার অলিগলি পেরিয়ে তাঁর পদার্পণ হয় ক্লাবের মাঠে। স্থানীয় জেলাগুলোতে নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি যখন সবুজ গালিচায় বল নিয়ে ছুটে বেড়ান, মোহাবিষ্ট দর্শকের ন্যায় তাকিয়ে থাকে সকলে। বাউরু অ্যাথলেটিক ক্লাবকে জুনিয়র পর্যায়ে জেতান তিন শিরোপা। কোচ ওয়াল্ডেমার দো ব্রিটো এবার তাঁকে নিয়ে আসেন সান্তোসে, ফুটবলের আসল জগতে। মাত্র ১৫ বছর বয়সেই নাম লেখান পেশাদার ফুটবলের দুনিয়াতে।
এক বছর বাদেই ডাক পান সান্তোসের মূল দলের হয়ে। ১৬ বছর বয়সে অভিষেক ম্যাচেই হাজারো গোলের ক্যারিয়ারের প্রথম গোলটা পেয়ে যান। এরপর কেবলই এগিয়ে যাওয়া, নিজের প্রথম মৌসুমেই লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা নির্বাচিত হন। এক বছর পেরোনোর আগেই ডাক আসে জাতীয় দল থেকে।
মারাকানায় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচ। ছোটবেলার মারাকানাজো’র দুঃসহ স্মৃতি সঙ্গী করেই জাতীয় দলের হয়ে প্রথম মাঠে নামা। অভিষেকেই গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা বনে যান। কিন্তু ব্রাজিল ম্যাচ হেরে যায় ২-১ গোলে। বছরদুয়েক বাদে উঁকি দেয় ১৯৫৮ সালের সুইডেন বিশ্বকাপ। কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগে হাঁটুর ইনজুরিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সবকিছু। তবে কি ছোটবেলায় বাবাকে দেয়া কথাটা রাখতে পারবেন না!
খেলোয়াড়দের চাপে টিম ম্যানেজমেন্ট এবং কোচ পেলেকে রাখেন সুইডেনগামী বিশ্বকাপের স্কোয়াডে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে মাঠে নেমে বিশ্বকাপের অভিষেকটাও ঘটে যায়। তবে গোলের খাতাটা খোলেন খানিকটা দেরিতে, কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলশের বিপক্ষে।
সেমিফাইনালেও দলের ত্রাণকর্তা তিনি, ফ্রান্সের বিপক্ষে একপর্যায়ে ২-১ গোলে পিছিয়ে ছিল ব্রাজিল। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে অনবদ্য এক হ্যাটট্রিকে ম্যাচের ভাগ্য লিখে দেন পেলে। ফাইনালেও করেন জোড়া গোল, তাতেই ৫-২ গোলের ব্রাজিল ঝড়ে উড়ে যায় স্বাগতিক সুইডেন। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় ব্রাজিল।
ব্রাজিলে ফিরেই সান্তোসকে জেতান সাও পাওলো লিগের শিরোপা। ১৯৬২ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন বেনফিকার বিপক্ষে ম্যাচে খেলতে পর্তুগালে যায় সান্তোস। লিসবন পার্কের সেই ম্যাচে পেলের হ্যাটট্রিকে দাঁড়াতেই পারেনি স্বাগতিকরা। ম্যাচের পর বেনফিকার গোলরক্ষক কোস্তা পেরেইরা বলেছিলেন, ‘আমি এক গ্রেট ফুটবলারকে ঠেকানোর জন্য পোস্টে দাড়িয়েছিলাম। কিন্তু ম্যাচ শুরু হতেই বুঝতে পারি অন্য গ্রহে জন্ম নেয়া কাউকে ঠেকানোর সাধ্য আমার নেই।’
১৯৬২ বিশ্বকাপ অবশ্য পেলের জন্য ছিল খানিকটা হতাশার। প্রথম ম্যাচেই গোল করে জানান দিয়েছিলেন সুইডেনের ফর্মটা তিনি নিয়ে এসেছেন চিলিতেও। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এক ইনজুরি তাঁকে ছিটকে দেয় পুরো টুর্নামেন্টের জন্য। যদিও গ্যারিঞ্চার সুবাদে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জিততে কোনো সমস্যাই হয়নি ব্রাজিলের। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবগুলোর নজর পড়ে পেলের উপর।
ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলো উঠেপড়ে লাগে পেলেকে দলে টানার জন্য, টাকা-পয়সা তাঁদের জন্য কোনো বিষয়ই না তাঁকে দলে ভেড়াতে। তাছাড়া সে সময়টাতে ব্রাজিলের তারকা ফুটবলাররা সবাই নাম লেখাচ্ছিলেন ইউরোপিয়ান দলগুলোতে। বয়স বিশ পেরোনোর আগেই তাই ব্রাজিল সরকার তাঁকে জাতীয় সম্পদ আখ্যায়িত করে অরপ্তানিযোগ্য ঘোষণা করে।
১৯৬২ বিশ্বকাপ যদি পেলের জন্য হতাশার হয়, ১৯৬৬ বিশ্বকাপ তবে চূড়ান্ত আক্ষেপের। বুলগেরিয়া এবং পর্তুগাল তাঁকে আটকাতে আশ্রয় নেয় চূড়ান্ত অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের। তাঁদের ক্রমাগত বাজে ফাউল আর ট্যাকলে ইনজুরির শিকার হন পেলে, খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসেন মাঠের বাইরে। সাইডলাইনে বসেই ক্রন্দনরত চোখে দেখতে হয় বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিলের লজ্জাজনক বিদায়।
১৯৭০ বিশ্বকাপের আগের সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিলো না পেলের। ব্রাজিলে তখন চলছে সামরিক জান্তা সরকারের শাসন। শাসকগোষ্ঠী ভাবছিল বামপন্থীদের সাথে আঁতাত আছে পেলের। যদিও পরবর্তীতে পেলে মেক্সিকো বিশ্বকাপে মাঠে নেমেছিলেন। সেবার চার গোল করে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন নিজের শেষ বিশ্বকাপ এবং প্রথম দল হিসেবে তিনবার বিশ্বকাপ জিতে জুলেরিমে ট্রফিটা একান্ত নিজের করে নিয়েছিল ব্রাজিল।
ব্রাজিলের সেই দলটাকে বলা হয় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল। ১৯৭১ সালে যুগোশ্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল ক্যারিয়ারের ইতি টানেন পেলে। অন্যদিকে সান্তোসের হয়ে ১৯৭৪ সালে অবসর নিলেও ১৯৭৬ সালে নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে কিছু ম্যাচে মাঠে নামেন আমেরিকার ফুটবলকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে।
সবুজ গালিচায় পায়ের জাদুতে দর্শকদের মাত করেছেন এরকম ফুটবলারের সংখ্যা নেহাতই কম নয়, কিন্তু ফুটবলের প্রথম বৈশ্বিক তারকা হয়ে উঠেছিলেন পেলে। অবসরের পর ১৯৯২ সালে বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষায় তাঁকে আইকন হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ। পাঁচ বছর বাদে ব্রিটিশরা তাঁকে সম্মানজনক নাইট কমান্ডার উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৯৫ সালে ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন বেশ কিছুদিন। এমনকি সিলভাস্টোর স্ট্যালোন এবং মাইকেল কেইনের সাথে এক চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে পেলেকে।
ফুটবলের মতো পেলের ব্যক্তিগত জীবনও বেশ রঙিন। তিনবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এই ফুটবল তারকা। ১৯৬৬ সালে রোজারিও দোস রেইস চোলবির সাথে প্রথমবারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন পেলে। এই সংসারে দুই ছেলে এবং এক মেয়ের পিতা হন তিনি। ১৯৮২ সালে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে এই দুজনের। এরপর ১৯৮৬ সালে ব্রাজিলিয়ান গায়িকা আসিইরা লেমোস সেইক্সাসকে বিয়ে করেন পেলের। কিন্তু দুই যমজ সন্তানের জন্মের পর আলাদা হয়ে যান দুজনে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে জাপানিজ ব্যবসায়ী মার্সিয়া সিবেকে অকির সাথে তৃতীয়বারের মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন পেলে।
ফুটবলটাকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কেবল ফুটবলশৈলী দিয়েই তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয়ে। জীবনে কোনোদিন ফুটবলে লাথি না মারা লোকটাও পেলের নাম জানে। তাঁর দক্ষতা আর নৈপুণ্য দুদন্ড শান্তি দিয়েছে জীবনযুদ্ধে বারবার হেরে যাওয়া মানুষকেও।