বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে জন্ম তাঁর, তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে তিনি একজন ভারতীয় ক্রিকেটার। পুরো নাম প্রবীর কুমার সেন। ডাক নাম ছিল খোকন। লোকে ডাকতো খোকন সেন বলে।
পার্থের ডেইলি নিউজকে এক সাক্ষাৎকারে প্রবীর বলেছিলেন, ‘কলকাতায় সব বাচ্চাদেরই খোকন বলা হত। আমার ক্ষেত্রে নামটা সব সময়ের জন্য জুড়ে গেছে।’
১৯২৬ সালের ৩১ মে জন্মেছিলেন কুমিল্লা, বা বৃহত্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক প্রথিতযশা ব্যবসায়ী পরিবারে। বাবা অমীয় সেন ও মা বাসন্তী সেন। যদিও, বালক বয়সেই পরিবারের সাথে খোকন চলে আসেন কলকাতায়।
গাঁট্টাগোট্টা ধরণের ডান হাতি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ছিলেন তিনি। ১৯৪৩ সালে শুরু করে পথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ার। বয়স তখন মাত্র ১৭, কলকাতার লা মার্টিনিয়ার কলেজে পড়াশোনাটা সবেই শেষ করেছিলেন। পড়াশোনায় তিনি বেশ ভাল ছিলেন বলেই শোনা যায়।
১৯৪৭-৪৮ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নিয়মিত উইকেট রক্ষক জেনি ইরানির বিকল্প হিসেবে। নববর্ষের দিনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে তাঁর অভিষেকও হয়ে যায়।
১৪ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ার ছিল তার। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি ছিলেন ভারতীয় দলের নিয়মিত সদস্য। এর মধ্যে ২০ টি ক্যাচ ছাড়াও ১১ টি স্ট্যাম্পিং করেছিলেন তিনি। টেস্ট খেলা প্রথম বাঙালি ক্রিকেটার তিনি।
উইকেটের পেছনে তিনি যে বেশ দক্ষ ছিলেন সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের প্রথম জয়ে এক ম্যাচ তিনি পাঁচটি ডিসমিসাল করে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। কাকতালীয় ভাবে সবগুলোই ছিল ভিনু মাককড়ের বলে।
খোকনের সাথে মানকড়ের জুটি জমে উঠেছিল ওই সময়। খোকনের ৩১ ডিসমিসালের মধ্যে ১২ টিই এসেছে এই মানকড়ের বলে।
তবে, তিনি বিখ্যাত অন্য একটা কারণে। তিনিই হলেন একমাত্র ভারতীয় উইকেটরক্ষক যিনি স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানকে স্ট্যাম্পিং করেছিলেন। সেটা ১৯৪৭ সালের ঘটনা। যদিও কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ ছিল না সেটা।
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ইন্ডিয়ান্স দলের হয়ে ভিনু মানকড়ের বলে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসে এই কাণ্ড ঘটান খোকন। ১২ রানেই সাজঘরে ফিরতে হয় ব্র্যাডম্যানকে। সেই চারদিনের ম্যাচটা ড্র হয়ে গিয়েছিল।
লোয়ার অর্ডারে দারুণ কার্যকর ব্যাটসম্যান ছিলেন খোকন। যদিও টেস্টে কখনও একটা হাফ সেঞ্চুরিরও দেখা তিনি পাননি। ১১.৭৮ গড়ে করেন মোটে ১৬৫ রান।
তবে, তার ব্যাটিং প্রতিভার দেখা মেলে রঞ্জি ট্রফিতে। সেখানে ক্যারিয়ার শেষ করার আগে ৩০.৪৪ গড়ে ১৭৯৬ রান। সব ধরণের প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খোকন খেলেছেন ৮২ টি। এর মধ্যে ২৩.২৪ গড়ে ২,৫৮০ রান আর ১৪৪ টি ডিসমিসাল পেয়েছিলেন। বলা হয়, তিনি বেশ আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান ছিলেন।
বিয়ে করেছিলেন ক্রিকেট প্রশাসক পঙ্কজ গুপ্ত’র ভাগ্নি রিনা সেনকে। সেটা ১৯৪৮ সালের ঘটনা। এই দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় কন্যা মধুশ্রী সেন ও পূত্র অভিজিৎ সেন। তিন নাতি-পুতি হলেন বিক্রম, দেবাকি ও অদিতি ধর।
খোকনরা ছিলেন তিন ভাই আর এক বোন। বাকিরা হলেন মনি সেন, সমীর ও রণবীর সেন। খোকনের চেয়ে ১৯ বছরের ছোট রণবীরও ক্রিকেটার ছিলেন। বাঁ-হাতি এই ব্যাটসম্যান চুটিয়ে পশ্চিম বঙ্গের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলে গেছেন।
১৯৭০ সালের ২৭ জানুয়ারি কলকাতায় হৃদযন্ত্রের ক্রীয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। তার স্মরণে প্রতিবছর কলকাতায় পি.সেন মেমোরিয়াল ট্রফির আয়োজন করা হয়। সেই টুর্নামেন্টে শচিন টেন্ডুলকার (ইস্ট বেঙ্গল, ১৯৯৪) ও শ্রীলঙ্কার চামিন্দা ভাসের (মোহনবাগান, ২০০৯) মত ক্রিকেটাররাও খেলেছেন!
অভিনব এক রেকর্ড দিয়ে ইতি টানি। খোকন সেন হলেন একমাত্র ভারতীয় উইকেটরক্ষ যিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করেন। ১৯৫৪ সালে ঊড়িষ্যার বিরুদ্ধে বারাবাটি স্টেডিয়ামে দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের চতুর্থ ওভারের দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বলে টি.আর. শাস্ত্রী, তামায়া শাস্ত্রী এবং নিমান পাধিকে আউট করে এই বিরল নজির গড়েন। ওই ম্যাচে বাংলার হয়ে উইকেটের পেছনে দাঁড়ান অভিষিক্ত গোপাল চক্রবর্তী।