ব্যাট যেন উদ্ধত রাজদণ্ড

মনে করুন, আপনার গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে বেশ খুঁখার ঝগড়া হয়েছে। আর আপনার গার্লফ্রেন্ড একেবারে নেকুপুসু মার্কা নয়। আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করলে তিনি যে কাজটা করবেন সেটা হল আয়নার সামনের বেসিনটা টেনে তিনি ডানদিক থেকে বাঁদিকে ঘুরিয়ে ফেলে দেবেন। সামনে আপনি থাকলে তো কথাই নেই।

পুলিং আ কিচেন সিঙ্ক কথাটা থেকেই পুল বা পুল শট এসেছে। তবে সেটা ক্রিকেটে। গলফেও পুল শট আছে, তবে সেটা যদি আপনি হাওয়ার গতিবেগ বুঝে একটা ড্রাইভ মারলেন আর সেটা টার্গেটের বাঁদিকেই থেকে গেল তাহলে সেটাকে পুল বলবে। ক্রিকেটে কিন্তু মাঝারিমাপের খাটোলেন্থের বলকে আপনি শরীর টেনে এনে যদি আড়া ব্যাটে লেগ সাইডে ফেলে দেন সেটাকে পুল বলবে।

আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে হুক তাহলে কী? হুক আর পুল প্রায় একই শটেরই দুই অবস্থা। বাঁ বগলের উপরের বল যদি আপনি কাঁধের সমান বা তার থেকে উঁচুতে ব্যাট দিয়ে আড়াআড়ি শট খেলেন সেটা হুক, আর সামান্য খাটো লেন্থের বল যদি আপনি সামনের পায়ে বা পিছনের পায়েই আড়া ব্যাটে মিট করেন উড়ু থেকে বগলের মধ্যে এবং বলের লাইন যদি আপনার শরীরের ভিতরে বা অফস্টাম্পের দিকে হয় তাহলে সেটা পুল শট হবে। অর্থাৎ হুকের ক্ষেত্রে আপনি ডানহাতি হলে আপনার বাঁ কাঁধের কাছাকাছি বা তার উপরে বলটাকে থাবড়াবেন। আর পুলে বল শরীরের ভিতরে বা ডান কাঁধের নিচে বা বাইরে হলে চাঁটাবেন। যে রোগীর যে ঔষধ আর কি!

এবারে ধরে ধরে যদি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ বীরদের তুলে আনা হয়? তাহলে প্রথমেই নাম মনে আসে ভিভের। ভিভ, আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। এমনিতে হয়তো তিনি হাঁটু শক্ত রেখে একটা অফ স্ট্যাম্প বরাবর ফ্রন্টফুট শাফল করতেন। কিন্তু বোলারকে দেখে যদি বুঝে যেতেন যে বল সামান্য খাটো লেন্থে পড়তে চলেছে, তাহলে পিছনের পা অফস্টাম্পে নিয়ে তৈরি। তারপর বল আকাশে যাবে না ব্যাটের মুখ মাটির দিকে করে মাটির গন্ধ নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছবে তা সম্রাটের মর্জির উপর নির্ভরশীল।

পুল শটের আবার দু ভাগ আছে। ধীর গতির বলে পিছনের পায়ে পুল মেরে সামনের পা এবং শরীর লেগ সাইডে চলে যাবে, অথবা সামনের পা এগিয়ে নিয়ে এসে বল চাঁটাবে ব্যাট। যেমন বহুক্ষেত্রে ছবি দেখতে পাই কানহাই, ইয়ান চ্যাপেলদের। আর পেস বলে পুল করতে গেলে, জাভেদ মিয়াঁদাদ, কপিল, অরবিন্দ ডিসিলভাদের কথা মনে আসে। এদের মধ্যে কপিল হুক শটের মতই, পুলেও এক অনবদ্য বাঁ পা তুলে নটরাজ মূর্তি রচনা করতেন।

ডি সিলভার ক্ষেত্রে তাঁর গ্রিপ পুলের ক্ষেত্রে কার্যকরী হত। আসলে শট মারার সময় যদি বলের ইমপ্যাক্টে নিচের হাত ঘুরে যায় তাহলেই চিত্তির। ডিসিলভার গ্রিপে উপরের এবং নিচের হাতের মধ্যে দূরত্ব থাকত ফলে ড্রাইভের সময় উপরের হাতে জোর এবং নিচের হাতে জোরে পুল করতেন।

পরবর্তীকালে পুল শটের ক্ষেত্রে পারদর্শীতা দেখি ইঞ্জির। ইনজামামের ফুটওয়র্ক নিয়ে কথা হতে পারে, কিন্তু বলের উপরে মাথা নিয়ে যাওয়া এবং স্থির রেখে পিছনের পায়ে প্রেশার ট্রান্সফার করে পুল মারার এক সহজাত প্রবৃত্তি দেখা যেত। একই রকম শট আমরা বর্তমানে রোহিত শর্মাকে মারতে দেখি। ফর্ট ফুট শাফলিং-এর পর সামান্য খাটো লেন্থে পড়লেই শরীর পিছনে নিয়ে তৈরি। শট সম্পূর্ণ করার সময় ডান পা তুলে নেওয়া। এও ইনজামামের প্রতিচ্ছবি হয়ে ধরা দেয়।

শচিন তেন্ডুলকার, ব্যাকফুটে ব্যাটিঙটাকে আলুপোস্ত বিউলিডাল করে ফেলা বোধহয় শচিনের আগে ধারাবাহিকভাবে কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যানের পক্ষে সম্ভব হয়নি। শচিনের ব্যাকফুট অফস্টাম্পের উপর পাঞ্চ, স্কোয়ার কাটের সঙ্গে সঙ্গেই গায়ের উপর সামান্য খাটো বল্কে নির্মমভাবে পুল মারা চোখে লেগে থাকে। কিন্তু তার থেকেও বেশি করে চোখে লেগে থাকে, ইংল্যন্ডে ক্রিস লুইসকে, কানাডায় আজহার মাহমুদকে, শারজায় ‘ডেজার্ট স্টর্ম’এর সময় মাইকেল ক্যাস্প্রোউইচ, ড্যামিয়েন ফ্লেমিংকে স্টেপ আউট করা অবস্থায়, শরীরে ঢুকে আসা বলেও আশ্চর্যজনকভাবে কোমর ঘুরিয়ে পুল মারা।

পরবর্তীকালে ২০০৪-০৬ সময়ে পিঠের চোটের একটা অন্যতম কারণ ছিল এই শট। অত ভারী ব্যাট হাল হামেশাই মেরেছেন।

রাহুল দ্রাভিডের পুল মশায়, দৃষ্টি নন্দনের নন্দন কানন, ব্যাকরণের পরকাষ্ঠা। ব্যাট লিফট করার সময় সেই যে বাঁ কনুই ভেঙে ব্যাট ডান কাঁধের দিকে গেল, শরীরের উপরে উঠে আসার পর সেই পিছনের দিকে শরীর মুড়িয়ে পিছনের হাত দিয়ে বলের উপরে ব্যাট রোল করিয়ে কাঁধে উঠল ব্যাট। আর বল, মাটি কামড়ে বাধ্য ছেলের মতো চলে গেল।

পুল শট বলতে আরেক ভারতীয়ের নাম মাথায় আসে, অবশ্যই আসে। বর্তমান অধিনায়ক বিরাট কোহলি। কিন্তু তাঁর কথা পরে বলছি। তার আগে সেরে নিই দক্ষিণ আফ্রিকার তিনজনের কথা। অ্যান্ড্রু হাডসন, জ্যাক ক্যালিস এবং এবি ডিভিলিয়ার্স।

এদের মধ্যে প্রথম দুজন চকিতে ওয়েট ট্রান্সফার করে মারতেন। কিন্তু এবি হলেন টেকনিকাল মার্ভেল। বিশ্বের প্রথম ৩৬০ ডিগ্রি ব্যাটসম্যান। আসলে সবকিছু লুকিয়ে এবির স্টান্স এবং শাফলিং-এ। বোলারের হাত থেকে বল যখন বেরোচ্ছে, তখন বাঁ পা সামনে নিয়ে এসে সামান্য ঝুঁকে মাথা সোজা রেখে এবি তৈরি। ঝুঁকে থাকার কারণে ইনিশিয়ালি সামনের পায়ের শাফলিং হলেও ওয়েট ট্রান্সফার একেবারে সমান হয়ে গেছে। মাথা সোজা, দিকনির্ণয়ে কোনো সমস্যাই নেই। এবারে বল পড়ে গায়ে এলে তো মুড়ি তেলেভাজা খাওয়ার মতো একবার হাত ঘুরিয়ে নিলেই চলে।

সামনের পায়ের উপর ওজন রেখে পুল মারার ক্ষেত্রে আরও দুজনের কথা বলতে হয়। দুজনই ইংলিশ। ইয়ান টেরেন্স বোথাম এবং নাসের হুসেইন।

তবে বলেছিলাম, কোহলির কথা পরে বলব। কিন্তু যার কথা বলার জন্য কোহলিকে আটকে রেখেছিলাম, তার নাম কিন্তু রিকি টমাস পন্টিং। বল নাচের সময় যেভাবে অবলীলায় বাঁ হাতে নাচের সঙ্গিনীকে দূরে পাঠিয়ে চকিতে শরীরের কাছে টেনে এনে ডান হাতে কোমর ধরে চোখে চোখ রাখে, রিকি ঠিক সেই অবলীলায় উঠতে বসতে শয়নে স্বপনে পুল মারতেন। অস্ট্রেলিয়ায়, বিশেষত তাসমানিয়ায় ক্রিকেট শিক্ষার এই সুবিধাটা হয়েছে যে, বল গুডলেন্থ থেকেও অতর্কিতে উঠে আসলে পুল মেরে তাকে শিক্ষা দেওয়া। চকিত ফুটওয়র্ক, আর শরীরের অবস্থান পরিবর্তনে, রাহুলের মতো দৃষ্টিনন্দন না হলেও রিকির পুল হল তাঁর রুজি রুটি।

ঠিক যেভাবে গুড লেন্থ বলটাকে সামনের পায়ে এসেও পিছনের পায়ে ওয়েট ট্রান্সফার করে চোখের নিচে বলটাকে মিট করে ব্যাকওয়র্ড পয়েন্ট দিয়ে বার করে দিতে পারতেন, স্লাইস ড্রাইভে। ঠিক সেভাবেই। ভারতীয় বিরাট কোহলি এবং অস্ট্রেলীয় মাইকেল ক্লার্ক একই ঘরানায় পুল শটে বিশ্ব শাসন করেছেন।

অবশ্য বর্তমানে স্টিভ স্মিথও বেশ ভালো পুল মারেন। কিন্তু স্টিভের পুল তাঁর নিজস্ব ঘরানা তৈরি করেছে। তার সঙ্গে অন্য কারুর তুলনা চলে না।

একটু নজর করলেই বুঝতে পারবেন যে আলোচনায় একজনও বাঁহাতির নাম নেই। কারণটা হল পুল শটের ক্ষেত্রে বাঁহাতিদের শট মেকিং-এ একটা সম্পূর্ণ ভিন্নতর সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সেটা হল কোণ। ডান হাতি বোলারের বল, বাঁ হাতিদের ক্ষেত্রে এক স্বাভাবিক কোণ তৈরি করে, যার উপর কম্পালসিভ পুলিং অত্যন্ত দুরূহ। ঠিক যেভাবে কভার ড্রাইভ বা স্কোয়ার ড্রাইভ অনেক বেশি সহজাত।

কিন্তু এই অ্যাঙ্গেলের উর্ধে উঠে স্যার গ্যারির পুল বা তাঁরই মানসপুত্র যুবরাজ সিংএর অনায়াস পুল অথবা ত্রিনিদাদের রাজপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারার লাফিয়ে ওঠা পুল মনের মধ্যে থেকে যায়। থেকে যায় অ্যালভিন কালীচরণের পুল। কার্যকরিতার দিক থেকে আরও মারাত্মক কিন্তু অস্ট্রেলীয় মেভারিক অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, ম্যাথু হেডেন, জাস্টিন ল্যাঙ্গার বা দক্ষিণ আফ্রিকীয় গ্রেম স্মিথের পুল।

প্রথম তিনজনের শট মেকিং-এ বাঁহাতিদের স্বাভাবিক দৃষ্টিনন্দন ফ্লেয়ার থাকত। কিন্তু পরের চারজনের শটে আবার বোলারকে মেরে শায়েস্তা করার অনভূতি প্রকটিত। একই শরণীতে রাখা যায় সনাথকে। সনাথ জয়াসুরিয়া, বোলার হিসেবে শুরু করেও ওপেনিং ব্যাটিং-এ বিপ্লব আনেন। ভয়ঙ্কর ভারী ব্যাট, চকিত ব্যাট লিফটে শরীরের উপরের বলের উপর যখন নেমে আসত তখন বল আকাশ পথে তারাদের সঙ্গে খেলতে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন পথ পেত না।

কিন্তু বামহাতিদের এই ফাঁদে পা ফেলবার জন্য খাটো লেন্থ এবং সামান্য কম খাটো লেন্থে গতি বাড়িয়ে উইকেট নিতে দেখেছি আমরা গ্লেন ম্যাকগ্রা বা অনিল কুম্বলেকে। কুম্বলের কথাই বলি, কুম্বলের বল বেশি স্পিন করত না। দুর্জনে বলত, কুম্বলের কোমর ঘুরত কিন্তু বল ঘুরত না। কিন্তু স্পিনের অপারগতা কুম্বলে পেরিয়ে গেছিলেন, লাইন লেন্থ এবং গতির হেরফের করে। এরকমই একটা বল ছিল কুম্বলের ফ্লিপার।

ওয়ার্নের ফ্লিপারও খুব সাংঘাতিক ছিল। কিন্তু ওয়ার্ণে বল স্পিন করার ক্ষেত্রে হয়তো সর্বকালের সেরা। তাই সে চিন্তা ছিল না। কুম্বলের ক্ষেত্রে বল সামান্য শর্ট ফেলাই হত যাতে ব্যাটসম্যান হেলাফেলা করে আড়া ব্যাটে শট মারতে যায়। কিন্তু গ্রায়েম হিক, সেলিম মালিক, ড্যামিয়েন মার্টিন, মাহেলা জয়বর্ধনের মতো ব্যাটসম্যানরা তো বটেই, শয়ে শয়ে টেলএন্ডাররা কুম্বলেকে মাঠের বাইরে ফেলার ব্যর্থ স্বপ্ন নিয়ে বারবার ড্রেসিংরুমে ব্যাট বগলে ফিরে গেছেন।

তবে বাঙালি পাঠকের জন্য একটা শেষ পাতে দই রেখে যাই। মনে করুন ব্লুমফন্টেন। ব্যাটিং-এর সময় উল্টোদিকে ভিআরভি সিং, বল করছেন কালো মানুষের ভরসা মাখায়া এনটিনি। সামান্য খাটো লেন্থের বলটাকে উড়িয়ে দিলেন তিনি মিড উইকেটের উপর দিয়ে। ব্যাটিং-এ মন না দিয়ে অধিনায়কত্বকে সমস্যায় ফেলার পর, গ্রেগ চ্যাপেলের অদ্ভুত সিদ্ধান্তগুলোর পর, দল থেকে বাদ পরে একা একা ঘন্টার পর ঘন্টা ইডেনে, ইন্ডোর স্টেডিয়ামে ঘাম ঝরাবার পর স্বমহিমায় অবতীর্ণ হলেন সৌরভ চন্ডিদাস গাঙ্গুলি।

পুল তাঁর প্রিয় শট ছিল না। ব্যাট লিফট এবং শরীরের অবস্থানের জন্য অন্য বাঁহাতিদের তুলনায় লেগ সাইডে দুর্বলতা বেশি ছিল। তবু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আড়া ব্যাটটাকে সঙ্গী করে নিয়েছিলেন তিনি। ব্লুমফন্টেনের শটটির সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।

এভাবেই, বোলারের আত্মবিশ্বাসে ফুটো করে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করার জন্য যুগে যুগে কিংবদন্তীরা পুল শটকে হাতিয়ার করেছেন। হুক শটের মধ্যে একটা মরিয়া ভাব থাকে, ঝুঁকির পারসেন্টেজ অনেক বেশি থাকে। কিন্তু পুল শট হল অনেক বেশি কর্তৃত্বের গল্প। শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করতে, এবং জন সমক্ষে প্রদর্শন করতে যুগে যুগে ব্যাটসম্যানরা এভাবেই তাঁদের রাজদণ্ডকে নির্মমভাবে ব্যবহার করে এসেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link