এক যুগ আগে, সবাই খানিকটা অবাকই হয়েছিল। ২০১০ সালে কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য নির্বাচিত হলে। মরুর দেশে বিশ্বকাপ আয়োজিত হবে। সে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দের শেষ নেই। তবে কাতার অবশ্য বেশ লম্বা পরিসরে পরিকল্পনা হাতে নিয়েই ফুটবল মাঠে নেমেছে। ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজন করবার সুযোগ পাওয়ার পর ফুটবল আঙিনায় কাতারের বিচরণ বাড়তে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ফ্রেঞ্চ ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে কিনে নেয় কাতার স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি।
এরপর থেকেই তো ক্লাবটির উত্থানের শুরু। কাতারের অঢেল অর্থে কত কিছুই তো হল। সাদামাটা একটা ক্লাব থেকে ইউরোপীয় ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে ক্লাবটি। যাত্রা পথে কত চমকই তো দেখিয়েছে ক্লাবটি। ২০১৭ সালের আরও এক দফা ফুটবল বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয় পিএসজি। একটু তলিয়ে বললে, কাতার। নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপ্পের মত খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ায় ক্লাবটি। সময়ের সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়ে পরিণত হন দুইজন।
নেইমার তখন অবশ্য তারকা খেলোয়াড়। তবে এমবাপ্পে ছিলেন উদীয়মান তারকা। তবুও সম্ভাবনাময় সেই খেলোয়াড়কে হাতছাড়া করেনি। সময়ের পরিক্রমায় তিনি পরিণত হয়েছেন। গেল মৌসুমেই তারকার মেলায় পরিণত হয় পিএসজি। ফুটবল বিশ্বের অন্যতম কিংবদন্তি লিওনেল মেসিও যুক্ত হন ক্লাবটির সাথে। দলের এই তিন তারকা আবার রয়েছেন বিশ্বকাপের দৌড়ে।
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা, নেইমারের ব্রাজিল ও এমবাপ্পের ফ্রান্স, এই তিন দলেরই সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এবারের বিশ্বকাপে বাজিমাত করবার। পিএসজির কাতারি মালিক নাসের আল খেলাইফি নিশ্চিতরুপেই সবচেয়ে সুখী মানুষ বর্তমানে। তাঁর দলের কোন এক তারকা ফুটবলারের হাতে উঠবে বিশ্বকাপ। তবে এই তিন তারকার কেবল একজনই পারবেন জিততে বিশ্বকাপ। গতিপথ অন্তত তাই বলে।
পিএসজির হয়ে এই মৌসুমে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছে তাদের আক্রমণভাগ। সেই আক্রমণ ভাগেই তো রয়েছেন, মেসি, নেইমার ও এমবাপ্পে। এবারের মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করবে ক্লাবটি। তেমনটাই বোঝা যাচ্ছে তাঁদের এবারের পারফরমেন্সে। এই ত্রয়ী এখন পর্যন্ত ৪৬টি গোল করেছে। পিএসজি এই মৌসুমে খেলেছে কেবলমাত্র ২২টি ম্যাচ। ঠিক কতটা দুরন্ত সময় পার করছেন তাঁরা সেটা আন্দাজ করে নেওয়াটা খুব কঠিন কিছু না।
জাতীয় দলের লিওনেল মেসির অপূর্ণতার শেষ ছিল না। তবে ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা জিতে আন্তর্জাতিক ট্রফি খরা ঘোচান মেসি। এবার তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন বিশ্বকাপেও হাত রাখতে। ২০১৪ সালে একহাত দূরত্বে থাকা শিরোপাটা তো কয়েক যোজন দূর মনে হয়েছিল। আরও একবার সুযোগ এসেছে বাঁ পায়ের জাদুকরের সামনে। সম্ভবত এটাই তাঁর শেষ সুযোগ। তিনি সে সুযোগটাকে কাজে লাগানোর আপ্রাণ চেষ্টাটুকু করবেন সেটা ঘটা করে না বললেও চলে।
এবারের আর্জেন্টিনা দলটাও সাংঘাতিক রকমের ধারাবাহিক। টানা ৩৬টা ম্যাচ আলবেসেলেস্তারা অপরাজিত। সেই ধারা নিশ্চয়ই অব্যাহত রাখতে চাইবে দলটি। অন্যদিকে দলের রসায়ন ঈর্ষনীয়। যদিও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ইনজুরির কারণে বাদ পড়েছেন ও সংশয় রয়েছে কয়েকজনকে নিয়ে। তবুও এবারে আর্জেন্টিনা দলটা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম শক্তিশালী দল।
শক্তি বিবেচনায় একই চিত্র ব্রাজিল শিবিরে। সেখানে মধ্যমণি নেইমার। এখন অবধি দুইটি বিশ্বকাপ খেলেছেন নেইমার। তবে ধারণা করা হয় এবারই তিনি পূর্ণ ফিট হয়ে যাচ্ছেন বিশ্বকাপ মিশনে। তাছাড়া ফর্মটাও দারুণ নেইমারের। পিএসজির হয়ে দারুণ সময় কাটিয়েছেন। সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছেন। আবার নিজেও জালের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছেন বহুবার। ব্রাজিল দলের জার্সি গায়ে নেইমার সর্বদাই ভিন্ন রুপে আবির্ভূত হন।
এবারের দলটাও আগের দুই বারের তুলনায় যথেষ্ট ভারসাম্যপূর্ণ। দলের আক্রমণভাগটা একেবারেই তারকায় ঠাসা। সেলেসাওদের প্রতিটা খেলোয়াড় পারফর্মার। বড় ম্যাচে প্রতিটা খেলোয়াড় একাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। দলের ফুলব্যাক পজিশন নিয়ে বেশকিছু প্রশ্ন থাকলেও ইনজুরি সংক্রান্ত কোন ধরণের সেটব্যাক নেই। তবে ব্রাজিল নিজেদের দিনে প্রচণ্ড আগ্রাসী। এমন একটি দল অবশ্যই শিরোপার দাবিদার।
২০১৮ সালে যেবার ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিতলো, তখনও কিলিয়ান এমবাপ্পে ছিলেন কিশোর। অল্প বয়সেই বিশ্বকাপ জেতার স্বাদ পেয়ে গিয়েছেন তিনি। ক্ষুধাটা নিশ্চয়ই বেড়েছে। সময়ের সাথে পরিণত হয়েছেন, খেলার ধার বেড়েছে। শিরোপা ক্ষুধাও নিশ্চয়ই কমবার কথা নয়। পিএসজির হয়ে দারুণ সব গোল করেছেন এই মৌসুমে। ফর্মের শীর্ষে থেকে তিনিও এসেছেন আরও এক শিরোপা জয়ের উদ্দেশ্যে।
তবে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দলটা অবস্থা বেশ বেগতিক। দলে হানা দিয়েছে ইনজুরি। পল পগবা ও এনগোলো কান্তেদের মত তারকা ফুটবলাররা বিশ্বকাপের আগেই ছিটকে গিয়েছেন। ক্রিস্টোফার এনকুনকু অনুশীলনের ইনজুরিতে পড়ে বিদায় নিয়েছেন বিশ্বকাপ থেকে। দলের অভ্যন্তরেও ছোটখাটো ইনজুরির শঙ্কা রয়েছে। এমন অবস্থায় ফ্রান্সের বিশ্বকাপ যাত্রার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব থাকবে এমবাপ্পের কাঁধে। তিনি কতদূর দলকে টেনে নিতে পারবেন সেটাই দেখবার বিষয়।
গেল বার কোয়ার্টার ফাইনালে ৪-৩ ব্যবধানে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে ফ্রান্স পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এবারও একই পর্যায়ে এই দুই দলের মুখোমুখি হবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া সেমিফাইনাল পর্যায়ে ব্রাজিলের সাথে এই দুল থেকে জিতে আসা কোন এক দলের মোলাকাত হবার সম্ভাবনাও প্রবল। এমন অবস্থায় তারকায় ঠাসা দলগুলোর যে কোন একটি দলই শেষ অবধি পৌঁছাতে পারবে বিশ্বকাপ শিরোপা অবধি। শিরোপা জিততে নিশ্চয়ই ফাইনালে কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে দলগুলোকে।
ক্লাব পর্যায়ে প্যারিস সেইন্ট জার্মেইকে অন্যতম সেরা হিসেবে পরিণত করতে চাওয়া তিন তারকা এখন একে অন্যের পথের কাঁটা। তবে কাতারের বিশ্বকাপে তাদের একজনের হাতে বিশ্বকাপ দেখলে নিশ্চয়ই গোটা কাতারও আনন্দ উৎসবে মেতে উঠবে।