স্থিতধী প্রলয়ের বাহক

কেন যেন, ক্রিকেট পাড়ায় প্রচার হয়ে গিয়েছে চেতেশ্বর পূজারা শুধু লাল বলেই খেলতে জানেন। তাই ভারতের রঙিন পোশাকে সুযোগ পাওয়া তো দূরে থাক, শেষ কয়েকবছরে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগেও (আইপিএল) দল পান নি তিনি। টি-টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডে কোন ফরম্যাটেই পূজারা অতটা লাইমলাইটে থাকেন না।

তবে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসে গা থেকে টেস্ট স্পেশালিস্ট তকমা ঝেড়ে ফেলতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন চেতেশ্বর পূজারা। মঞ্চ হিসেবে বেছে নিয়েছেন রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপ। টুর্নামেন্টের শুরুটা ভাল না হলেও দ্রুতই ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

আগস্টের ১২ তারিখে সাসেক্সের হয়ে ওয়ার্কশায়ারের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ে এসেছিলেন পূজারা। ৩১১ রানের বিশাল লক্ষ্য তাড়া করতে ছুটছিল সাসেক্স। আর সেসময় মাত্র ৭৯ বলে ১০৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন ভারতীয় ব্যাটার। সাত চার আর দুই ছয়ে ১৩৫ এর বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেও অবশ্য দলকে জেতাতে পারেননি তিনি।

আর সেই পাপ মোচন করেন পরের ম্যাচেই। এদিন আরো বিধ্বংসী হয়ে উঠেছিলেন চেতেশ্বর পুজারা। ৯ রানে দুই উইকেটের পতনের পর নেমেছিলেন পূজারা। এরপর টম ক্লার্ককে সাথে নিয়ে গড়েন ২০৫ রানের জুটি। সেঞ্চুরি পূর্ণ করে ক্লার্ক আউট হওয়ার পরে আরো ক্ষুরধার হয়ে উঠেন পুজারা। ১০৩ বলে তিন অঙ্কের ঘরে প্রবেশের পরে রীতিমতো অচেনা কেউ হয়ে যান তিনি।

এ সময় তাকে দেখলে মনে হবে পুরোদস্তুর কোন হার্ড হিটার। পরের ২৮ বলে চেতেশ্বর পূজারা তুলে নিয়েছেন ৭৪ রান। সব মিলিয়ে ২০ চার এবং পাঁচ ছয়ের সাহায্যে মাত্র ১৩১ বলে ১৭৪ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলেন তিনি। সেই সাথে সাসেক্সকে পৌঁছে দেন ৩৭৮ রানের পাহড়সম উচ্চতায়। বোলিংয়ে এসে বড় জয় তুলে নিতে সমস্যা হয়নি দলটির।

অফ ফর্ম এসেছিল কিংবদন্তি রাহুল দ্রাবিড়ের ক্রিকেট জীবনে, অফ ফর্ম এসেছেন আধুনিক দ্রাবিড় খ্যাত চেতেশ্বর পুজারার ক্যারিয়ারেও। টানা ব্যর্থতা সঙ্গী হয়ে উঠেছিল তার।

লম্বা সময় ধরে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে রান করতে পারেননি তিনি। ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে বাদ পড়তে হয়েছিল জাতীয় দল থেকেও।স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন লম্বা সময় ধরে ভারতীয় টেস্ট দলের টপ অর্ডার সামলানোর দায়িত্বে থাকা এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান।

ব্যাট হাতে একের পর এক দৃষ্টিকটু আউট, রান খরা সব মিলিয়ে ক্যারিয়ারের শেষ ভাগে এসে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন পূজারা। চেতেশ্বর পূজারার অফ ফর্ম কাটিয়ে উঠার সুযোগ হয়েই আসে ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেট। সাসেক্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান এই অভিজ্ঞ ব্যাটার।

ইংলিশ কন্ডিশনে নিজের পরিচিত ফর্মে ফিরতেও সময় লাগে নি পূজারার। সাসেক্সের হয়ে ডার্বিশায়ারের বিপক্ষে অভিষেকেই ম্যাচেই করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি। পরের ম্যাচে উস্টারশায়ারের বিপক্ষে করেন সেঞ্চুরি।

অফ ফর্মে থাকা পুজারার ব্যাটে দেখা মিলেছে রানের ফোয়ারা। সবমিলিয়ে প্রথম পাঁচ ম্যাচেই দুই সেঞ্চুরি আর একটি ডাবল সেঞ্চুরি করে প্রমাণ করেন তিনি ফুরিয়ে যান নি।

এরপর তাঁকে আবার ফিরিয়ে আনে ভারতীয় নির্বাচকরা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ওপেনিংয়ে নেমে ৬৬ রানের ধৈর্যশীল ইনিংস পুরোনো পুজারার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। জাতীয় দলের বিরতি কাটিয়ে কাউন্টি ক্রিকেটে ফিরে রান করা আরো বাড়িয়ে দেন চেতেশ্বর পূজারা।

প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির পর ডারহাম এবং মিডলসেক্সের বিরুদ্ধে করেন আরো দুইটি ডাবল সেঞ্চুরি। আর এখন সীমিত ওভারেও কাউন্টি ক্রিকেটের অবিসংবাদিত রান মেশিন হয়ে উঠছেন এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান।

এখন পর্যন্ত রয়্যাল লন্ডন ওয়ানডে কাপে ৫ ম্যাচে ৯১.৭৫ গড় এবং ১২০.৭২ স্ট্রাইক রেটে ৩৬৮ রান করেছেন। এর আগে কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে করেছিলেন ১০৯৪ রান। সে টুর্নামেন্টে গড় ছিল ১০৯.৪০। সেঞ্চুরি করেছিলেন মোট ৫টি যেখানে আবার তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি।

৩৪ বছর বয়স চেতেশ্বর পূজারার। লম্বা সময় ভারতকে সার্ভিস দেওয়া অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের জন্য আর দেখিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তারপরও যখন ক্যারিয়ারের শেষে গেল গেল রব উঠে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রলের শিকার হতে হয় তখন আর স্থির থাকা যায় না। জবাবটা দিতে হয়; তাই ব্যাট হাতে বাইশ গজে আরেকবার যুদ্ধে নেমে গিয়েছেন চেতেশ্বর। 

ব্যাট দিয়ে যেমন থামিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষ বোলারদের ছোড়া তূণ তেমনি থামিয়ে দিয়েছেন চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনা। চেতেশ্বর পুজারা ফর্মে ফিরেছেন দাপটের সাথে, জাতীয় দলে আবার জায়গা করে নিয়েছেন; এরই সাথে নিন্দুকদের আরেকবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি দেয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেন বাইশ গজে, আবার অনায়াসে বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করতেও জানেন।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link