সামান্য দেরি করেছে শুরু হতে। টাইব্রেকারে জিতে তখনও হুঙ্কার দেওয়া ছাড়ছে না দি মিনাউর। অ্যান্ডি মারের রিটার্নকে ‘বাপি বাড়ি যা’ বলে হাত মুঠো করে ঝাঁকিয়ে সেন্টার কোর্ট থেকে হেঁটে ঢুকছে লাউঞ্জে। অদূরে দাঁড়িয়ে জন ম্যাকেনরো। যিনি সহাস্যে পিঠ চাপড়েই মুহূর্তে গম্ভীর। চেয়ার আম্পায়ার রেডি, দুটো টিমের ক্যাপ্টেন নিজ নিজ স্থানে। এবার ভরা এরিনার গমগমে হাততালির মাঝে চিরপরিচিত ফেট্টি বেঁধে পায়ে পায়ে ঢুকলেন ওই দু’জন।
‘ওই দু’জন!’
যার একজনের ১৯৯৮-তে ক্যারিয়ার শুরু। প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জিতবে তারও বছর তিন পরে। অসম্ভবকে সম্ভব করে। ঘাসের কোর্টের অবিসংবাদী নায়ক পিট সাম্প্রাসকে উইম্বলেডনেই হারিয়ে শিরোপা অর্জন। আর তাকাতে হয়নি। যে লেভেলে গ্রাঁ পি-তে হুশ করে বেরিয়ে যেত মাইকেল শুম্যাখ্যার, ওই জেট গতিতে উত্থান।
পরপর গোটা কতক অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ইউ এস ওপেন জিতে একটা বেঞ্চমার্ক তৈরি করে নেওয়া এবং সাথে, ঘাসের কোর্ট উইম্বলেডনের পাশেই নিজের নাম জুড়ে নেওয়া- নিজের চারপাশে একটা অদৃশ্য বলয় বানিয়ে সেখানে একা এবং একা বিরাজ করছে একটা পনিটেল। অবাধ্য চুলগুলোকে সযত্নে ঠিকঠাক জায়গায় প্লেস করে ফের বাজপাখির ক্ষিপ্রতায় অপোনেন্টের দিকে তাকানো।
নাহ্, থেমে গেল তো। ওই তো থামল। কোত্থেকে মায়োর্কার একটা ষাঁড় এসে পুরো ছবিটা পাল্টে দিল। ফেডেরার নাগালই পেলেন না গোটাটা বোঝার। তার আগেই বীভৎস কিলার ইন্সটিংক্ট নিয়ে হাজির হয়ে গেছে আরেকটা লম্বা চুল। বাঁ হাতি, আর প্রতিপক্ষের উপর জাঁকিয়ে বসতে ব্যাপক পারে। এই সেই, যে ২০০৫-২০০৭ ডমিনেন্স দেখিয়ে এসেছে প্যারিসে। দু’বার ক্লে-তে স্ট্রেট সেটে ফেডেরারকে হারিয়েছে। এবার আর মাটি, সুরকি নয়। টোটাল ঘাস। নাদালের কাছে ফেড সেখানেও হাত তুললেন।
‘ওই দু’জন’।
যার একজন কাল নেট প্লে দেখাচ্ছিলেন আগের মতোই। ওয়ান হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ডের ছটা পড়ছে সেন্টার কোর্ট চত্বরে। পাওয়ার দিয়ে একজন ক্রমাগত স্পেস তৈরি করে দূরূহ কোণে সরে গিয়ে ফোরহ্যান্ড মারছে ক্রসকোর্টে। একটা বল সোজা গিয়ে পড়ল গ্যালারিতে। একজন অসাধারণ একটা ক্যাচ ধরলেন। নিচে হাসছে দু’জন। সেকেন্ড সেটের একটা সময় নেট গেম এত ফাস্ট এগোল, ওইখান থেকে বেসলাইনে বুদ্ধি করে প্লেস করে দিল জ্যাক সক। ব্যস! সব্বার মাথায় হাত, এটা কী করে করল! ফেড-রাফা পর্যন্ত হেসে ফেললেন, ইভেন, বাইরে থেকে ‘মাই গড’ বলে উঠল জকোভিচ, সিসিপাসরাও।
ম্যাচের শুরুতেই নাদালের ডাবল ফল্ট। এরপর যত এগিয়েছে, বেশ বোঝা গেছে যে এটাই শেষ ম্যাচ, আর দু’জনের কেউই একেবারে ফিট নয়। তাও প্রথম সেট কোনওরকমে ৬-৪ ফেভারে হল। কিন্তু সেকেন্ড সেটে টিফো-সক আগুনে ক্ষিপ্রতায় ব্যাক করছে। ফোরহ্যান্ডের উত্তরে সহজ রিটার্ন ফস্কাচ্ছে নাদাল। পাশে ফেড হাসছে।
পেশাদারিত্বের চরম পর্যায়ে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ টেনিস প্লেয়ার নিজের শেষ ডাবলসে দাঁড়িয়ে অপোনেন্টের মিসে হেসে ফেলছে। কোথাও কি সূক্ষ্ম বেদনা লুকিয়ে ছিল হাসির ভিতরে? ফেড কি জানতেন, উল্টোদিকের অস্ত্রকে রোখার মতো অস্ত্র তাঁর ভাণ্ডারে আর নেই, জানতেন তিনি হেরে যাবেন? রাফাও হাসলেন, তিনটে বলের আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাফাকে সেটাই বলছিলেন কি তিনি? শেষে তিনবার ডিউস করিয়েও তো লাভ কিছুই হল না।
কিন্তু, ‘ওই দু’জন’।
৬-৬, টাইব্রেকার। আর সেখানে পরপর পয়েন্ট তুলে নিশ্চিন্ত জায়গায় রজার-রাফা। ৩-০। এরপরেই তাল কাটল। ৩-০ থেকে ৩-৩, ৩-৪। শেষমেশ এমন পরিস্থিতি যে ৯-৯। কী যে হল, ফ্রিক পয়েন্টে কেমন করে ম্যাচ নিয়ে গেল চিলে, ফেড দাঁড়িয়ে।
তবুও যে, ‘ওই দু’জন!’
যার একজনের শেষ ইন্টারভিউতে ডেকে নিলেন সমস্ত সতীর্থদের। একে একে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বিয়ন বর্গ, অ্যান্ডি মারে, সিসিপাসরা। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রাফা। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। রজারের চোখের জল বাঁধ মানছে না। আর ভোর ছ’টার সময় সার দিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে ২০০৮ উইম্বলেডন, ২০০৯ উইম্বলেডন, ২০০৬-০৭ ফ্রেঞ্চ ওপেন, ২০১৯ উইম্বলেডন সেমি।
কখনও এটিপি ট্যুরে একসাথে জুটি বেঁধে খেলা, কখনও একে অপরকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে নেওয়ার বোবাযুদ্ধ। শেষ পর্যায়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলা। নাদালের মাসল যদি হয় ক্ষমতা প্রদর্শনের সর্বোত্তম ধাপ, নোভাকের রোবটসম ট্যাকটিক্স যদি হয় গ্রেটেস্ট হয়ে ওঠার জবরদস্ত ফর্মুলা তবে সেই জ্যাজ-রকের মধ্যেই হঠাৎ মঞ্চে উঠে গাইতে শুরু করলেন-
‘বিরহের জ্বালার পরে মধুর লাগে, বড় মধুর লাগে মিলন সুধা পান…’
একটা হারমোনিয়াম নিয়ে যে গোটা রক কনসর্টক নিমেষে চুপ করিয়ে দিতে পারতেন, তিনিই কাল বললেন, বৌ ছিল বলেই ৪০ বছর ধরে খেলতে পারলাম। না হলে আরও আগেই।
রজার কেঁদে ফেলছেন। রাফা আজকের পর আরও একা। সবাই বলছেন রজার আর আসবে না, ফেড একটাই, এক এবং একমেবাদ্বিতীয়ম – ইতোমধ্যে ক্যামেরায় ধরা পড়ল নোভাক জকোভিচ। যিনি অনেক চেষ্টা করছেন চোখের জল আড়াল করতে, কিন্তু রাতের ঝলমলে সেন্টার কোর্টে সেটা যে আরও বেশী করেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। নোভাক, আপনি আজ দেখতে দিন।
নিছক স্ট্যাট, বিশ্লেষণের দিন পড়েই তো রইল। কেউ না কেউ এসে ক্যাঁক করে ধরবে। ধরুক, আজ আর কিছু যায় আসে না। পরে ওসব আবার হবে কোনও একদিন, যখন এই বিদায়গুলো ধীরে ধীরে সয়ে যাবে। বিরহগাথার মতো।
রজার চললেন। রাফাও যাবেন। একটা ডিকেডের অনেক অনেক বছর পর মধ্যরাতের সেন্টার কোর্ট হাসবে। এমনিই, কোনও কারণ ছাড়াই। আজি হতে শতবর্ষ পরে… ‘মাঝে মাঝে মন্দ হলে, মন্দ কী!’