যতদিন বার্নাব্যু, ততদিন রাউল

১৬ বছর ধরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যু দেখেছিল এক কিংবদন্তির ঐশ্বরিক পথচলা। তিনি হয়ে উঠেছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের সমার্থক। লস ব্ল্যাঙ্কোসদের গ্যালাক্টিকো যুগে জিনেদিন জিদান, লুইস ফিগো কিংবা ডেভিড বেকহ্যাম, রবার্তো কার্লোস, রোনালদোদের মত তারকাদের ভিড়েও তিনি ছিলেন নিজের আলোয় উজ্জ্বল। বলা হচ্ছে রাউল গঞ্জালেস ব্ল্যাঙ্কোর কথা, বলা হচ্ছে ‘এল অ্যাঞ্জেল দি মাদ্রিদ’ বা ‘মাদ্রিদ দেবদূত’-এর কথা। রিয়াল মাদ্রিদের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনগুলোর একটি তিনি।

১৯৭৭ সালের ২৭ জুন স্পেনের মাদ্রিদ শহরেই জন্মেছিলেন রাউল। মাত্র দশ বছর বয়সে স্থানীয় ক্লাব সান ক্রিস্টোবালে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে ফুটবলে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতেখড়ি হয় রাউলের। এর বছর তিনেক পরে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের ক্যাডেট দলে ডাক পান তিনি। নিজের দক্ষতায় একাডেমিক দলটির হয়ে জাতীয় বয়স ভিত্তিক শিরোপাও জিতেছিলেন রাউল।

কিন্তু দু’বছর পরেই অর্থনৈতিক সমস্যায় অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তাদের যুব অ্যাকাডেমি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এরপরই প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদ সেই একাডেমির সব ছাত্রকে নিজেদের করে নেয়। আর এটিই সম্ভবত রাউল গঞ্জালেসের জন্য সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। লা ফেব্রিকাতে মাত্র দুইবছর কাটানোর পরই অসম্ভব প্রতিভাবান এই স্ট্রাইকারের জায়গা হয়ে যায় অল হোয়াইটদের মূল দলে।

শুরুটা কিন্তু একেবারেই সুন্দর হয়নি। উল্টো রাউল তিনটি সহজ সুযোগ মিস করায় রিয়ালকেই হারতে হয়েছিল সেবার। কিন্তু সকালের সূর্য তো সবসময় পুরো দিনের আভাস দেয় না। রাউলও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, পরের ম্যাচে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে এক গোল আর এক অ্যাসিস্টের পাশাপাশি দলকে এনে দিয়েছিলেন একটি পেনাল্টি। একক নৈপুণ্যে সেদিন রিয়ালকে মাদ্রিদ ডার্বিতে জিতিয়ে রাউল ঘোষনা দিয়েছিলেন তার আগমনী-বার্তা।

এরপরের ষোলটা বছর রাউল মাতিয়ে রেখেছিলেন পুরো সান্তিয়াগো বার্নাব্যুকে। জিতে নিয়েছিলেন সব মাদ্রিদিস্তাদের হৃদয়। মাদ্রিদের সফেদ জার্সিতে ৭৪০ ম্যাচ খেলে ৩২৩ গোল করে রাউল তাঁর সময়ে ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা। এছাড়া একজন স্ট্রাইকার হয়েও করেছেন ১১৪ টি অ্যাসিস্ট।

তবে রাউল নিজেকে আরো বেশি প্রমান করেছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চে। ১৯৯৮ থেকে ২০০২ এই পাঁচ বছরে রিয়াল মাদ্রিদকে তিনবারই মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের স্বাদ পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনি।ক্যারিয়ার শেষের আগ পর্যন্ত ছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসের সর্বোচ্চ গোলদাতা। দুই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি গোল, আর তিনবার হয়েছেন মৌসুম সেরা ফরোয়ার্ড। এমন কীর্তির স্বীকৃতি দিতে ভুল করেনি উয়েফাও; সর্বকালের সেরা চ্যাম্পিয়নস লিগ একাদশে রেখেছে রাউলের নাম।

তবে মাদ্রিদ-ভক্ত রাউল কখনোই চাননি দলের বোঝা হয়ে থাকতে। তাই যখনই মনে হয়েছে খেলায় সবচেয়ে সেরাটা তিনি দিতে পারছেন না তখনই বিদায় নিয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে সমর্থকদের হৃদয় ভেঙ্গে চলে গিয়েছিলেন জার্মানির শার্লকেতে। সেখানে গিয়ে মাত্র দুই বছরেই রীতিমতো ক্লাব কিংবদন্তিতে পরিনত হয়েছিলেন রাউল। তাকে এতটাই ভালবেসেছিল কর্মকর্তা এবং ভক্তরা যে, অনির্দিষ্টকালের জন্য রাউলের সাত নম্বর জার্সিকে তুলে রাখে তারা।

এরপর ইউরোপ ছেড়ে গিয়েছেন কাতারের আল সাদে। অধিনায়কত্ব করেছেন, দলকে লিগ জিতিয়ে এরপর বিদায় বলেছেন। ক্যারিয়ারের একবারে সায়াহ্নে এসে নিউইয়র্ক কসমস দলে যোগ দেন রাউল। আর সেখানেই সকার বৌল ট্রফি জিতে দীর্ঘ একুশ বছর পর নিজের বুট জোড়া তুলে রাখেন রাউল।

অবশ্য জাতীয় দল স্পেনের হয়ে ভাগ্যের প্রহসনের শিকারই হয়েছেন এই স্ট্রাইকার। কোচের সঙ্গে বিবাদের কারনে জায়গা পাননি ২০১০ বিশ্বকাপে, না হলে হয়তো বিশ্বজয়ের স্বাদটা পাওয়া হত তার। তারপরও প্রতিদ্বন্দ্বী কোচ পেপ গার্দিওলা’র মতে, রাউল স্পেনের ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১০২ ম্যাচে ৪৪ গোল করেছেন তিনি।

খেলোয়াড় হিসেবে রাউলের মাঝে দুর্দান্ত গতি, ড্রিবলিং কিংবা শক্তিশালী শট নেয়ার ক্ষমতা কোনটিই একেবারে সর্ব্বোচ্চ সেরা ছিল না। বরং এসব কিছুর নিঁখুত মিশেল ছিল তার মাঝে। এই যেমন সাবেক রিয়াল অধিনায়ক হিয়েরোর মতে, ‘রাউল কোন ফুটবলীয় দক্ষতাতেই দশে দশ ছিল না। তবে সব কিছুতে ছিল দশে সাড়ে আট।’ এর পাশাপাশি মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের দক্ষতার শতভাগ ব্যবহার করতে জানতেন রাউল। জানতেন জালের ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার উপায়৷

রাউল গঞ্জালেস রিয়াল মাদ্রিদের ক্লাব কিংবদন্তি, এতটুকুতে আসলে রাউলের বর্ণনা করা যায় না। রাউল শুধুই রিয়ালের খেলোয়াড় নয়, তিনি ক্লাবটির সেবক। সাধারন খেলোয়াড়, অধিনায়ক কিংবা অবসরের পর উপদেষ্টা – সব জায়গা থেকেই প্রানের ক্লাবটিকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

গোল সংখ্যায় হয়তো তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া যাবে, কিন্তু রাউলের রিয়াল-অধ্যায়কে ম্লান করা যাবে না। যতদিন রিয়াল মাদ্রিদ থাকবে, যতদিন এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যু থাকবে; ততদিনই মনে রাখা হবে রাউল গঞ্জালেসের কথা, মনে রাখা হবে ‘এল ফেরারি’-এর কথা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link