১৯৮৩ ও ২০১১ – ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসেই অবিস্মরণীয় দুটি সময়, দু’টি বিশ্বকাপ জয়ের বছর। কাকতালীয় ভাবে দু’টি বিশ্বকাপ ফাইনালেই দু’টি ভিন্ন ভূমিকায় ছিলেন রবি শাস্ত্রী।
প্রথম টিতে তিনি ছিলেন প্রায় কোনো ভূমিকা না রাখা তরুণ, দ্বিতীয়টিতে তিনি ছিলেন ধারাভাষ্যকার। যার কণ্ঠ থেকেই এসেছিল ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের ঘোষণা। কোনোটাই কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নয়।
রবি শাস্ত্রী আসলে কে? কেন তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় ক্রিকেটে?
এক কথায় এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। এক সময়ের স্টাইলিশ অলরাউন্ডার, স্বল্প মেয়দের ভারতীয় অধিনায়ক, দর্শকপ্রিয় ধারাভাষ্যকার, ভারতের লম্বা সময়ের কোচ। কখনো তিনি ভালোবাসার পাত্র, কখনো তিনি সমালোচনার পাত্র। সংক্ষেপে বলা যায়, নন্দিত ও নিন্দিত এক ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব।
দীর্ঘদেহী ক্রিকেটাররা বরাবরই পেস বোলার হয়ে উঠতে চান। এক্ষেত্রে রবি শাস্ত্রী ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম একজন। ৬ ফুট ৩ ইঞ্চির বিশালাকৃতির হয়েও তিনি পেস বোলিং না করে স্পিন বোলিংকে বেছে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি ব্যাটিংও ভালোবেসে গেছেন। ব্যাটিং-বোলিং দু-দিক দিয়েই নিজেকে ঢেলে দিয়েছিলেন। এক কথায় অল-রাউন্ডারের কমপ্লিট প্যাকেজ যাকে বলা হয়।
ব্যাটসম্যান পরিচয়ে খুব বড় কোনো কীর্তি না করতে পারলেও সাদা পোশাকের ওডিআই ও টেস্ট ক্রিকেটে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। ব্যাট হাতে তিনি ছিলেন সব্যসাচী এক সৈনিক। জাতীয় দলের হয়ে ব্যাট করেছেন প্রায় সকল পজিশনে। ক্রিকেটে তার ‘চাপাতি শট’ ছিলো ব্যাপক জনপ্রিয়। প্যাডের কাছ থেকে ফ্লিক করে বহুবার বল কে বাউন্ডারি ছাড়া করেছিলেন। একসময় এই শট তার নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়। স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে তার পারদর্শিতা ছিলো আকাশচুম্বী। যেকোনো সময় নিতে পারতেন স্পিনারদের বিপক্ষে বড় শট। পেসারদের বিপক্ষে রান করতে যদিও তাকে অনেক ভুগতে হয়েছে পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই।
ইতিহাসের পাতায় শাস্ত্রী দারুণ কিছু রেকর্ডের অধিকারী। ১৯৮৫ সালে চ্যাম্পিয়ন নির্বাচিত হয়েছিলেন ক্রিকেট চ্যাম্পিয়নশিপে; অস্ট্রেলিয়ার মাঠে। ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়কে যারা উপহাস করতো, তাদের জন্য শাস্ত্রীর পারফরম্যান্স স্রেফ একটা নীরব জবাব ছিলো। একই মৌসুমেই গ্যারি সোবার্সের পর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ছয় বলে ছয় ছক্কা হাঁকানোর অনন্য কীর্তি গড়ে তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করেন শাস্ত্রীও।
তাঁর ব্যাটিং দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে কারো মাঝে কোনো সংশয় না থাকলেও, অফ-ফর্মের জ্বালা বারংবার পুড়িয়েছে তাঁকে। অফ-ফর্ম তার ক্যারিয়ারের সঙ্গী হয়ে ছিলো। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে জ্বলে না উঠতে পারাও তার ক্যারিয়ারের দূর্বলতম দিক। এ নিয়ে শাস্ত্রী সমালোচিতও কম হননি। এই কারণে এক ম্যাচের বেশি জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট অধিনায়কত্ব করার সুযোগ তার কপালে হয়নি।
শাস্ত্রী অবশ্য মনে করেন, তিনি ‘ইয়েস ম্যান’ ছিলেন না বলে লম্বা মেয়াদে অধিনায়কত্ব পাননি। এক টিভি সাক্ষাৎকারে শাস্ত্রী বলেন, ‘আমার ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে বিসিসিআইয়ের কাছে অধিনায়ক হিসেবে আমি শক্ত কোনো প্রার্থী ছিলাম না। তাদের প্রয়োজন ছিলো তাদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ বলা কাউকে।’
ভারতের ঘরোয়া লিগে রঞ্জি ট্রফিতে তিনি খেলে গিয়েছেন দাপটের সাথেই। মৌসুমের পর মৌসুম তিনি অন্যতম আকর্ষনীয় ক্রিকেটার হিসেবেই খেলেছেন ঘরোয়া লিগে। এর পাশাপাশি তিনি কাউন্টি ক্রিকেটেও নাম লিখিয়েছিলেন। খেলেছেন চার মৌসুম। ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী ভারত দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন শাস্ত্রী। ভারতের জার্সিতে ১১ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২৩০ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন দুই ফরম্যাট মিলিয়ে।
রান করেছেন প্রায় ৭ হাজার। উইকেট শিকার করেছেন ২৮০ টি। ৮০’র দশকের সাদা-কালো ক্রিকেটের জন্য একেবারে যথাযোগ্য ক্রিকেটারের প্রতিচ্ছবি তার ক্যারিয়ার পরিসংখ্যানে উঠে আসে। তার নিজ দল ও বিদেশের অন্যান্য ক্রিকেটারদের জন্য যা ছিলো ঈর্ষণীয়। ঘরোয়া লিগের পারফরম্যান্স তারচেয়েও ঈর্ষণীয়।
ব্যাট ও বল উভয়দিকেই সমান পারদর্শি হয়েও তিনি কিছু হতাশার ইনিংসেরও জন্ম দিয়েছিলেন। শাস্ত্রীর নামের সাথে যা ছিলো একেবারেই বেমানান। ১৯৯২ বিশ্বকাপের এক ম্যাচে তিনি ১১২ বলে মাত্র ৫৭ রানের ইনিংস খেলেন। ধীরগতির এই ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে দৃষ্টিকটু রান আউটের মাধ্যমে। ম্যাচের ফলাফলে ভারত কে স্বাদ নিতে হয় ৯ রানের পরাজয়ের। শাস্ত্রীর কচ্ছপ গতির ব্যাটিং কাল হয়ে দাঁড়ায় সেদিন।
দিনশেষে হারের ব্যবধান ছিলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র। ৯০ এর দশকের ক্রিকেটেও ৯ রানের পরাজয় ছিলো বর্তমান সময়ের মতোই সমান লজ্জার। ১৯৮৪ সালের শেষ দিনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইডেন গার্ডেন্সে তৃতীয় টেস্টে শতক হাঁকালেও তিনি মাঠে পার করে দেন ৪৫৫ মিনিট। ৩৫৭ বলে তিনি শতক আদায় করেন। টেস্টে এই ইনিংসকে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়া হলেও বিশ্বকাপের ইনিংসের জন্য শাস্ত্রী সমালোচিত হয়ে যান এখন অবধি।
মূলত খেলোয়াড় হিসেবে শাস্ত্রী শুরুতে ছিলেন মূলত স্পিনার এবং লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান। পরে তার বল পেটাতে পারার ক্ষমতার জন্য তাকে তুলে আনা হয় টপ অর্ডারে। এই জায়গাতেও বেশ ভালো মতো নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন শাস্ত্রী।
শুরুতেই বলেছি তিনি একাধারে বিস্ময়কর, নন্দিত ও নিন্দিত।
মাঠের পারফরম্যান্সে তিনি সর্বদাই নন্দিত হলেও, মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন অনেকাংশেই নিন্দিত। ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য, ড্রেসিংরুমে নিয়ম ভেঙে বিয়ার পান ছাড়াও আরোকিছু কর্মকান্ডে তার মাঠের ও মাঠের বাইরের জীবন হয়েছে তুমুল সমালোচিত। এই সমালোচনা কে সঙ্গী করেই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিচরণ করেছেন। সাফল্য কে কাছে টেনেছেন।
দ্রুত ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে হাঁটুর ইনজুরির কারণে। ভারতের দলে ১৯৯২ এর পর আর তাকে দেখা যায়নি। এরপর তিনি যোগ দেন ধারাভাষ্যের ক্যারিয়ারে। ভারতের ম্যাচগুলোতেই তিনি বক্তা হিসেবে দায়িত্ব পেতেন। হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে তার রক্ত গরম করা কন্ঠ সবসময় উত্তেজিত করেছে দর্শক হৃদয়।
এছাড়াও টিভি পর্দায় ক্রিকেটের নানানধর্মী বিশ্লেষণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বহুবারে। আইপিএলে একজন মূল ধারাভাষ্যকারও তিনি ছিলেন। বোর্ডের ডিরেক্টরের দায়িত্বও পালন করেছেন অনেক বছর। এসব ছাপিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন ভারতের ক্রিকেট কে মাঠের মত কোচ হিসেবেও নেতৃত্ব দেওয়ার। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে বছর তিনেকের অধিক। ভারতের মূল কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ভারতের ক্রিকেটের গতিতে নতুন করে শক্তি বাড়াতেই নিত্যনতুন পরিকল্পনায় কাজ করে যাচ্ছেন শাস্ত্রী। কাজ করবেন চুক্তি অনুযায়ী ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত।
এখানেও অবশ্য একটা ফিসফাঁস আছে।
বলা হয় নিজের যোগ্যতা দিয়ে নয়, বিরাট কোহলির পছন্দের কারণেই তিনি এখন ভারতের কোচ। তার আগে কোচ ছিলেন অনিল কুম্বলে। কিন্তু কোহলির পছন্দ ছিলো না কুম্বলেকে। প্রথম দফায় সৌরভ-শচীনদের কমিটি তাকে পছন্দও করেনি। পরে কোহলির চাপে তাকে কোচ করা হয় বলে বলা হয়ে থাকে।
শাস্ত্রীর ক্রিকেট ক্যারিয়ারকে বর্তমান প্রজন্ম নিজ চোখে, মাঠে বসে বা টিভি স্ক্রিনে উপভোগ না করতে পারলেও এ প্রজন্মের ভারত সমর্থকদের অন্তরে শাস্ত্রী সদা বিরাজমান। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের কানায় কানায় ভরতি গ্যালারি অপেক্ষায় দ্বিতীয়বারের মত শিরোপা জয়ের উদযাপনের সাক্ষী হতে। অন্যদিকে কমেন্ট্রিবক্সে শাস্ত্রীও ছিলেন প্রস্তুত তার কণ্ঠে ভারতের দ্বিতীয় বিশ্বজয় কে রাঙিয়ে তুলতে।
শাস্ত্রীর তার কণ্ঠেই বেঁচে থাকবেন এ প্রজন্মের ভারতীয় সমর্থকদের কাছে ২০১১ বিশ্বকাপের সেই লাইন গুলোর জন্য — ‘Dhoniiiii finishes off in style. A magnificent strike into the crowd. India lift the World Cup after 28 years. The party’s started in the dressing room. And it’s an Indian captain, who’s been absolutely magnificent, in the night of the final.’