অল্প ছুটে এসে বুকের কাছ থেকে চাবুকের তীব্রতায় বাঁ হাত ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া মৃত্যুবাণ – ক্রিকেট ফলো আরম্ভ করার অল্প কিছুদিন পর থেকেই এই ছিপছিপে তরুণ আমাদের একই সঙ্গে আতঙ্ক আর ঈর্ষার কারণ। দুই দিকেই অনায়াসে আধ হাত করে স্যুইং করত বল। সঙ্গে ছিল গতি এবং প্রয়োজন মত বাউন্সারের হুমকি। মোটকথা যে কোন পরিবেশে, যে কোন পরিস্থিতিতে, নতুন বা পুরনো বল হাতে একটা স্পেলেই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারতেন ওয়াসিম আকরাম।
তবে ঈশ্বরদেরও আমরা সহজে ছেড়ে দিই না। তাঁদেরও পরীক্ষা দিতে হয়, প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ক্রিকেটের ভগবান সচিনকে নিয়েও এই গ্রুপেই বিস্তর কাটা-ছেঁড়া হয়েছে এর আগে। হয় বিরাট বা সানিকে নিয়েও। হয়ত একদিন ভিভকে নিয়েও হবে (নাকি অলরেডি হয়েছে?)।
এবার ‘সুলতান অব সুইং’এর পালা।
কিছুদিন আগে একটা ক্রিকেটের ওয়েবসাইট (howstat.com) দেখতে দেখতে হঠাৎই কিছু ইন্টারেস্টিং তথ্য পেয়ে গেলাম। সেখানে কোন বোলার কোন ক্রমের ব্যাটসম্যানদের কতবার আউট করেছে তার হিসেব দেওয়া আছে।
বেশ কিছু পছন্দের বোলারদের ক্ষেত্রে এই হিসেব দেখলাম। ১ থেকে ৩ নাম্বার ব্যাটসম্যানদের বেশি আউট করেছেন কপিল এবং ম্যাকগ্রা – নিজেদের মোট উইকেটের ৪০% এদের আউট করে পাওয়া। আর টেল এণ্ডার অর্থাৎ ৮ থেকে ১১ নাম্বার ব্যাটসম্যানদের বেশি আউট করেছেন আকরাম এবং ডেল স্টেইন – যথাক্রমে তাঁদের পাওয়া মোট উইকেটের ৩৫% আবং ৩২%। অন্যদের ক্ষেত্রে এই পারসেন্টেজ এই রকম – কপিল দেব ২৮%, ইমরান খান ২৯%, রিচার্ড হ্যাডলি ৩০%, গ্লেন ম্যাকগ্রা ২৫%।
তার মানে কি আকরামের উইকেটের মান অন্যান্যদের চেয়ে কমের দিকে? এবার একটু গভীরে ঢুকলাম। দেখা যাক কোন বোলার নিজের ক্রিকেট জীবনে কোন কোন ব্যাটসম্যানকে সবচেয়ে বেশিবার আউট করেছে। এতে তাদের উইকেটের মান সম্বন্ধে আরও স্পষ্ট ধারণা করতে পারব। আসলে স্কোরবোর্ড যতই গাভাস্কার আর মানিন্দার সিংএর উইকেটের দাম সমান ধরুক, আমরা তো জানিই যে সানিকে একবার আউট করার চেয়ে মানিন্দারকে দশবার আউট করা সহজ (গড় হিসেবে ১৩ বার কারন সানির গড় ৫১, মানিন্দারের ৩.৮)।
আকরাম যে পাঁচজন ব্যাটসম্যানকে সবচেয়ে বেশিবার আউট করেছেন তারা হলেন শ্রীকান্ত (৯ বার), এমব্রজ (৮), ফ্লাওয়ার (৮), মার্শাল (৬) এবং ওয়ালশ (৬)। কপিলের ক্ষেত্রে নামগুলি হচ্ছে মুদাসসার (১২), গুচ (১১), মার্শাল (১০), বর্ডার (১০) এবং গাওয়ার (১০)। ইমরান – গাভাস্কার (১১), ভেংসরকার (১০), গ্রিনিজ (৯), দোশি (৮) এবং ওয়েট্টেমুনি (৭)। ম্যাকগ্রা – আথারটন (১৯), লারা (১৪), অ্যাডামস (১২), ক্যাম্পবেল (১১) এবং সটুয়ার্ট (১০)।
এখানে দেখা যাচ্ছে আকরাম বাদে অন্য তিনজনের শিকার বেশ নামি দামী ব্যাটসম্যানেরা। আকরামের টপ ফাইভের মধ্যে ব্যাটসম্যান মাত্র দুইজন, আবার সেই দুইজনের গড়ই ৩০ এর নিচে। অন্যদিকে কপিল আর ইমরান দুজনেরই প্রথম পাঁচে চারজন ব্যাটসম্যান – তার মধ্যে একজনের গড় ৫০এর ঘরে, দুইজনের ৪০এর ঘরে। ম্যাকগ্রার ক্ষেত্রে পাঁচজনই ব্যাটসম্যান – একজনের গড় ৫০এর ঘরে, একজনের ৪০, বাকি তিনজন ৩০এর ঘরে।
আরও একটু বিস্তারিত অ্যানালাইসিস করেও সেই একই তথ্য পেলাম। লিস্ট হিসেবে ওপরের দিক থেকে এরা যে ব্যাটসম্যানদের ১০০ বা তার সামান্য বেশিবার আউট করেছেন তাদের ওয়েটেড এভারেজ বের করে পেলাম যে আকরামের ক্ষেত্রে এই গড় ২৯, কপিলের ৪১, ইমরানের ৩৬, হ্যাডলির ৩৭, ম্যাকগ্রা এবং এমব্রজের ৪০। এই অ্যানালাইসিস অবশ্য তাদের নেওয়া সবকটা উইকেটের মান নিয়ে করলে ভালো হত কিন্তু সেক্ষেত্রে পরিশ্রম অনেক বেশি।
বরং একটু কম পরিশ্রমের কাজ হচ্ছে এরা নিজেদের ক্যারিয়ারে ‘গ্রেট’ ব্যাটসম্যানদের উইকেট কতবার নিয়েছেন তার হিসেব। এক্ষেত্রে যে ব্যাটসম্যানের গড় ৫০ বা তার বেশি তাদের গ্রেট ধরে আমি দেখতে পাচ্ছি আকরাম এই স্তরের ব্যাটসম্যানদের আউট করেছেন মোট ১৬ বার, কপিল ২৪, ইমরান ২৩, হ্যাডলি ২৬, ম্যাকগ্রা ৪৪ এবং অ্যাসব্রোস৩১ বার।
আকরামের সাফল্যও তুলনামূলক কম শক্তিশালী দেশ যেমন নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে বেশি। এই তিন দেশের বিরুদ্ধে মোট ১৭০ উইকেট নিয়েছেন আকরাম, গড় ১৯.৭৫। যদিও তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সফল কিন্তু এক্ষেত্রে তার উইকেটের বেশিরভাগই এসেছে ১৯৯০ বা তারপর (মোট ৭৯র মধ্যে ৬২ উইকেট) – এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়। তার সেরা বোলিং পারফর্মেন্সগুলোর বেশিরভাগই – ইনিংসে এবং ম্যাচে – অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলির বিরুদ্ধে।
এর থেকে একটা ব্যাপার মোটামুটি স্পষ্ট – ওয়াসিম আকরামের নেওয়া উইকেটের মান অন্যান্য আলোচ্য ফাস্ট বোলারদের চেয়ে অনেকটাই কম।
তবুও আকরামের গ্রেটনেস নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তার নতুন এবং পুরনো বলে দক্ষতা, যে কোন ধরনের উইকেটে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা বহু বড় বড় ব্যাটসম্যান মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। এবং তার বাঁ-হাতি হওয়াটা ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি অসুবিধের কারণ (এবং আকরামের সুবিধের)।
তবু তিনি টেস্ট ক্রিকেটের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলারদের লিস্টে সম্ভবত আসবেন না। অন্তত যদি না ‘বাঁ-হাতি’ বিশেষণটি ব্যাবহার করা হয়। নিজের ক্যারিয়রে তিনি কোনদিন আইসিসির লিস্টেও এক নাম্বার ছিলেন না – তার সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রম ২ (কপিলেরও তাই)। ইমরান ছিলেন। ছিলেন হ্যাডলি (৮ বছর), মার্শাল (৬ বছর), স্টেন (৭ বছর), এমব্রজ (৮ বছর) এবং ম্যাকগ্রা (৮ বছর)। যিনি নিজের কালের বা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ বোলার হতে পারেন নি তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কীভাবে হবেন? এমন কি আইসিসির হিসেবে আকরামের ক্যারিয়ারের হাইয়েস্ট বোলিং পয়েন্ট ছিল ৮৩০ যা কপিলের ৮৭৭এর চেয়েও অনেকটাই কম।
অনেককে বলতে শুনেছি শচীনের নাকি ভাগ্য ভালো যে সেরা ফর্মের আকরামের বিরুদ্ধে তাকে বিশেষ খেলতে হয় নি। আমার তো মনে হয় ভাগ্য আকরামের কিছুটা ভাল – সেরা ফর্মের শচীন বা রাহুলের বিরুদ্ধে বেশি খেললে হয়ত তার বোলিং গড় কিছুটা হলেও ভুগত।
একটা ডিসক্লেমার দেওয়া থাক – এই পর্যবেক্ষণ শুধুমাত্র টেস্ট ক্রিকেটের পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভর করে লেখা। আকরামের এক দিনের ম্যাচের পারফর্মেন্স এর মধ্যে ধরা হয় নি। একদিনের ক্রিকেটে তার স্থান সর্বকালের নিরিখে ঠিক কোথায় দাঁড়াবে সেই আলোচনা না হয় অন্যদিন।
এবার আপনাদের পালা। আমি জানি বেশ কিছু স্যুইং মেশানো ডেলিভারি ধেয়ে আসতে চলেছে। সেই সঙ্গে হয়ত কিছু বাউন্সার বা ইয়র্কারও। আসুক। এটাই তো খেলা।