আগুনে বাঁজপাখির ডানা

অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সেরা উইকেটরক্ষক হিসেবে ইয়ান হিলির নামটা সবার আগে উচ্চারিত হলেও খুব একটা পিছিয়ে নেই গিলিও। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে স্বচ্ছন্দ গিলির পজিশনিং, মুভমেন্ট, ডাইভিং, রিফ্লেক্স, অ্যাক্রোব্যাটিক স্টাইল এবং প্রেজেন্স অফ মাইন্ড ছিল এককথায় টপ ক্লাস। উইকেটের দু'পাশেই বোলারদের দারুণ ফলো করতে পারতেন এবং জায়গা বদল করতেন বাঘের ক্ষিপ্রতায়। ব্রেট লি কিংবা শন টেইটের মত এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলার, শেন ওয়ার্ন কিংবা স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের মত বিগ টার্নারের বিপক্ষেও তাঁর গ্লাভওয়ার্ক ছিল প্রায় শতভাগ নির্ভুল।

আধুনিক ক্রিকেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পেশালাইজড রোল হচ্ছে উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। প্রসঙ্গটি উঠলেই সবার আগে যার নাম মাথায় আসে তিনি হলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। যাকে ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।

শুরুতেই দিচ্ছি উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান সংক্রান্ত কিছু পরিসংখ্যান। গিলক্রিস্ট কেন সেরা তা পরিসংখ্যান দেখে হলেও কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।

  • আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ডিসমিসালের মালিক হচ্ছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (৯০৫)। এক নম্বরে আছেন মার্ক বাউচার (৯৯৯)।
  • উইকেটরক্ষকের ভূমিকায় খেলা আন্তর্জাতিক ম্যাচে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের রেকর্ডটা কুমার সাঙ্গাকারার (১৭,৫৯৯)। তবে খুব একটা পিছিয়ে নেই গিলক্রিস্টও; ১৫,২৫২ রান নিয়ে আছেন তৃতীয় স্থানে। দুই নম্বর জায়গাটা মহেন্দ্র সিং ধোনির (১৭,২৬৬ রান)।
  • ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে সাঙ্গাকারা, ধোনি এগিয়ে থাকলেও টেস্টের রেকর্ডটা আজও গিলক্রিস্টের (৯৬ টেস্টে ৫৫৭০ রান) দখলে। দুই নম্বরে আছেন মার্ক বাউচার (১৪৭ টেস্টে ৫৫১৫ রান)।
  • সীমিত ওভারের ক্রিকেটে নিয়মিত কিপিং করলেও টেস্টে সাঙ্গাকারা কখনোই রেগুলার উইকেটকিপার ছিলেন না। পুরো ক্যারিয়ারে কিপিং করেছেন মাত্র ২৯ টেস্টে, অপরদিকে গিলক্রিস্ট কিপিং করেছেন একটানা ৯৬ টেস্টে যা একটা রেকর্ডও বটে!
  • রান এবং ডিসমিসালের দিক থেকে শীর্ষস্থানটা ধরে রাখতে না পারলেও সেঞ্চুরিতে আবার গিলিই সবার চেয়ে এগিয়ে। সর্বোচ্চ ৩৩টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি নিয়ে কিপার-ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শীর্ষে আছেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ২৯টি সেঞ্চুরি নিয়ে সাঙ্গাকারার অবস্থান দ্বিতীয় (পুরো ক্যারিয়ার নয়, শুধুমাত্র উইকেটকিপার হিসেবে খেলা ম্যাচে)।

আসলে ব্যাটিং এবং কিপিং দুই বিভাগেই সমান দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা ছিল বলেই নিজেকে গ্রেটদের কাতারে নিয়ে যেতে পেরেছেন গিলক্রিস্ট। তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ক্রিকেট ইতিহাসে খুব কম ব্যাটসম্যানই আছেন যারা কিনা গিলক্রিস্টের মতো এত স্বচ্ছন্দে বল পেটাতে পেরেছেন। বলা যায় হার্ডহিটিংকে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি।

ক্রিকেটের সব ফরম্যাটেই গিলক্রিস্টের স্ট্রাইক রেট ছিল ঈর্ষনীয়। টেস্টে ৮১.৯৮, ওডিয়াইতে ৯৬.৯৪ ও টি২০-তে ১৪১.৬৭ স্ট্রাইক রেটই বলে দেয় ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি ঠিক কতটা বিধ্বংসী ছিলেন। উল্লেখ্য, টেস্টে গিলির চাইতে বেশি স্ট্রাইক রেট আছে শুধুমাত্র বীরেন্দর শেবাগ (৮২.২৩) এবং শহীদ আফ্রিদির (৮৬.৯৭)।

টেস্ট ক্রিকেটে ১০০ ছক্কা মারা প্রথম ব্যাটসম্যান হলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। টেস্টের তৃতীয় দ্রুততম (৫৭ বল) সেঞ্চুরি এবং অষ্টম দ্রুততম (২১২ বল) ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ডটাও গিলির দখলে৷ ওয়াসিম আকরাম একবার বলেছিলেন, ‘গিলক্রিস্টকে বল করে কখনোই স্বস্তিতে থাকতে পারতাম না। ওভারের সেরা বলটাতেও বাউন্ডারি মেরে দিতে পারত ও।’

সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক নাসের হুসেইনের মতে, ‘ওর মধ্যে কোনদিন ভয় ব্যাপারটা কাজ করতে দেখি নি। উল্টো বোলাররাই ভয় পেত ওকে, মারের চোটে খেই হারিয়ে ফেলত। গিলির কাছে টেস্ট আর ওয়ানডের মাঝে কোন ফারাক ছিল না। আসলে ওর খেলার ধরনটাই ছিল এমন যে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে যেকোন মুহূর্তে খেলাটা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখত।’

একদিনের ক্রিকেটে ‘ওপেনিং’ আর টেস্টে ‘নাম্বার সেভেন’ পজিশনে গিলক্রিস্টের ‘কাউন্টার অ্যাটাক’ স্টাইলের আগ্রাসী ভয়ডরহীন ব্যাটিং অস্ট্রেলিয়াকে সবসময় একটা বাড়তি সুবিধা এনে দিত। তাঁর ছিল শক্তিশালী ফোর আর্মস, নিখুঁত ব্যালেন্স এবং মুহূর্তের মধ্যে শরীরের ওয়েট ট্রান্সফার করার ক্ষমতা। চোখের পলকে পড়ে ফেলতে পারতেন বলের লেন্থ; আর ছিল দুর্দান্ত হ্যান্ড আই কো-অর্ডিনেশন।

গিলির ট্রেডমার্ক শট ছিল লফটেড পুল আর স্কয়ার কাট। এছাড়া ড্রাইভিং ‘অন দি আপ’, ফ্লিক, আপার কাট, হুক আর স্পিনারদের বলে কাউ কর্নার দিয়ে বিশাল বিশাল ছক্কা হাঁকানোতেও ছিলেন পারদর্শী।

গিলক্রিস্টের ব্যাটিং টেকনিকের বিশেষত্ব ছিল ব্যতিক্রমধর্মী ‘হাই গ্রিপ’ বা ‘লং হ্যান্ডেল’। ব্যাট গ্রিপ করতেন হাতলের একদম শেষের দিকে, যেন টপ হ্যান্ডের কন্ট্রোল আরও ভাল হয়।

এবারে আসি গিলক্রিস্টের কিপিং স্কিল প্রসঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সেরা উইকেটরক্ষক হিসেবে ইয়ান হিলির নামটা সবার আগে উচ্চারিত হলেও খুব একটা পিছিয়ে নেই গিলিও। উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে স্বচ্ছন্দ গিলির পজিশনিং, মুভমেন্ট, ডাইভিং, রিফ্লেক্স, অ্যাক্রোব্যাটিক স্টাইল এবং প্রেজেন্স অফ মাইন্ড ছিল এককথায় টপ ক্লাস। উইকেটের দু’পাশেই বোলারদের দারুণ ফলো করতে পারতেন এবং জায়গা বদল করতেন বাঘের ক্ষিপ্রতায়। ব্রেট লি কিংবা শন টেইটের মত এক্সপ্রেস ফাস্ট বোলার, শেন ওয়ার্ন কিংবা স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলের মত বিগ টার্নারের বিপক্ষেও তাঁর গ্লাভওয়ার্ক ছিল প্রায় শতভাগ নির্ভুল।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ২০০৫ সালে একবার গ্লেন ম্যাকগ্রার বলে ক্রেইগ ম্যাকমিলানকে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় লেগ সাইড স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেছিলেন গিলক্রিস্ট। বলটির গতি ছিল ঘন্টায় ১৩৬ কিলোমিটার!

গিলক্রিস্টের কিপিং গুরু রডনি মার্শের ভাষায়, ‘ওর ব্যাটিং প্রতিভা ছিল ন্যাচারাল। তবে কিপিংটা অনুশীলন করেই রপ্ত করতে হয়েছে। আর ছোটবেলা থেকেই ওর মধ্যে শেখার আগ্রহ ছিল প্রবল। রাত-দিন খেটে নিজের কিপিং দক্ষতাকে বিশ্বমানে নিয়ে গেছে সে।’

সতীর্থ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ভাষায়, ‘নেটে অনুশীলনের নব্বইভাগ সময়ই ও ব্যয় করত কিপিংয়ের পেছনে, ব্যাটিংয়ে দিত মাত্র দশভাগ।’

অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের রেকর্ডধারী উইকেটরক্ষক তিনি। অথচ গিলক্রিস্টের সামর্থ্য নিয়ে একসময় খোদ অস্ট্রেলিয়ানদের মনেই ছিল সংশয়। অতিরিক্ত লম্বা হওয়ায় ইয়ান হিলির ‘ফাইননেস’ তাঁর ছিল না। এমনকি ড্যারেন বেরি, ফিল এমেরিদের উইকেটরক্ষক হিসেবে গিলির চাইতে বেশি নম্বর দেওয়া লোকেরও অভাব ছিল না। কিন্তু ওপেনিং কিংবা সাত নম্বরে নেমে মারকাটারি ব্যাটিং, কখনও ম্যাচ বাঁচাতে বা কখনও ম্যাচ জেতাতে দুঃসাহসী কাউন্টার অ্যাটাক, খেলা শুরুর আগেই প্রতিপক্ষকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেওয়া ‘নিষ্ঠুর’ সব ইনিংস আর কাছ থেকে পেত অস্ট্রেলিয়া?

১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর, নিউ সাউথ ওয়েলসের অন্তর্গত ছোট্ট মফস্বল শহর বেলিঞ্জেনে জন্মগ্রহণ করেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ১৯৯২-৯৩ মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে তাসমানিয়ার বিপক্ষে গিলির ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক। অভিষেক ইনিংসে আউট হবার আগে করতে পেরেছিলেন মাত্র ১৬ রান। পুরো মৌসুমটাই গিলক্রিস্ট খেলেছিলেন মূলত ব্যাটসম্যান হিসেবে; কারণ তখনও গ্লাভস হাতে ‘অটোমেটিক চয়েজ’ হয়ে উঠতে পারেন নি তিনি।

বছরখানেক বাদে সেই তাসমানিয়ার বিপক্ষেই হয়েছিল গিলক্রিস্টের লিস্ট-এ অভিষেক। কাকতালীয়ভাবে সে ম্যাচেও তিনি আউট হয়েছিলেন মাত্র ১৬ রানে! ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে নিউ সাউথ ওয়েলস ছেড়ে তিনি পাড়ি জমান ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে গিয়ে প্রথম মৌসুমেই গড়েন অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ডিসমিসালের (৫৫) রেকর্ড।

ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে অভিষেকেও গিলক্রিস্ট প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছিলেন তাসমানিয়াকে! এবারে অবশ্য রানের খাতাই খুলতে পারেন নি তিনি। অপরদিকে একই ম্যাচে তাসমানিয়ার হয়ে খেলা রিকি পন্টিং হাঁকিয়েছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি!

১৯৯৫-৯৬ সালে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে নিজের দ্বিতীয় মৌসুমে আবারও সর্বোচ্চ ডিসমিসালের (৫৮) রেকর্ড গড়েন গিলি। ওই মৌসুমে তিনি ধারাবাহিকতা দেখিয়েছিলেন ব্যাট হাতেও। ৫০.৫২ গড়ে করেছিলেন ৮৩৫ রান।

১৯৯৬ সালের ২৫ অক্টোবর, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার জার্সিতে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষিক্ত হন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ভেন্যু ছিল ভারতের ফরিদাবাদ। ব্যক্তিগত ১৮ রানের মাথায় বোল্ড হয়েছিলেন অ্যালান ডোনাল্ডের বলে।

নিয়মিত উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলি অসুস্থ থাকায় সেবার ভারত সফরে দুটো ওয়ানডে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন গিলি। গিলির ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক ডিসমিসাল ছিলেন হ্যান্সি ক্রনিয়ে (০); পল রেইফেলের বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি।

১৯৯৭ সালের মার্চে ইয়ান হিলি দুই ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হলে আবারও সুযোগ আসে গিলির সামনে। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আয়োজিত সিরিজের সবগুলো ম্যাচেই খেলেছিলেন সেবার। কারণ দুই ম্যাচ পর হিলি ফিরলেও মার্ক ওয়াহর ইনজুরিতে গিলক্রিস্টকে রেখে দেয়া হয় একাদশে; খেলানো হয় স্পেশালিষ্ট ৬ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসাবে।

৬ ম্যাচ খেলে ২১.৬৭ গড়ে গিলক্রিস্ট করেছিলেন ১২৭ রান। ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটিটা হাঁকিয়েছিলেন ডারবানে সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে। ৫ চার ও ২ ছক্কায় ৮৮ বলে ৭৭ রান করে ম্যাচসেরাও হয়েছিলেন গিলি।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ১৮টি ম্যাচে গিলক্রিস্ট ব্যাট করেছেন ৬ এবং ৭ নম্বরে। একদিন হঠাৎ কী মনে করে স্টিভ ওয়াহ সিদ্ধান্ত নিলেন এখন থেকে ওপেন করবে গিলি। সিদ্ধান্তটা এসেছিল সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে একটা ম্যাচের ইনিংস ব্রেকের সময়। নিয়মিত ওপেনার মার্ক ওয়াহর সাথে প্যাড-গ্লাভস পড়ে রেডি হচ্ছিলেন টম মুডি। হুট করে স্টিভের খেয়াল হল, যা হচ্ছে তা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। টমের জায়গায় ওপেন করা উচিত গিলির।

ওপেনার হিসেবে খেলা ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে গিলি করেছিলেন ২০ বলে ২৭ রান। আর এর মধ্য দিয়েই অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসে একটা নতুন যুগের সূচনা ঘটে। বিশ্বব্যাপী বোলারদের জন্য যার ফলাফল ছিল ভয়ঙ্কর। পুরো এক দশকজুড়ে গিলির ব্যাটের তান্ডব সহ্য করতে হয়েছে তাদের।

১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে ওপেনারের ভূমিকায় নিজের ‘দ্বিতীয়’ ম্যাচেই সেঞ্চুরি হাঁকান গিলক্রিস্ট। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ১০৪ বলে ১০০ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে জিতিয়েছিলেন ম্যাচটাও। উল্লেখ্য, ম্যাচটা ছিল একটি ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল!

এর এক মাস পরই ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাঁকান ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি, ১১৭ বলে ১১৮ রানের চমৎকার এক ইনিংস খেলে জিতে নেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। একই বছর নভেম্বরে নিজের তৃতীয় ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা (১০৩) হাঁকান লাহোরে পাকিস্তানের বিপক্ষে।

১৯৯৯ সালের কার্লটন এন্ড ইউনাইটেড ত্রিদেশীয় সিরিজে গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে আসে ৪৩.৭৫ গড়ে সর্বোচ্চ ৫২৫ রান; ইংল্যান্ড (১১৮ বলে ১৩১) ও শ্রীলঙ্কার (১২৯ বলে ১৫৪) বিপক্ষে দুটি জয়সূচক সেঞ্চুরিসহ।

১৯৯৯ বিশ্বকাপে অবশ্য ব্যাট হাতে নিজের সেরাটা দিতে পারেন নি গিলি। মাত্র ২১.৫৪ গড়ে করেছিলেন ২৩৭ রান। দুটো ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন বাংলাদেশ (৩৯ বলে ৬৩) এবং ফাইনালে পাকিস্তানের (৩৬ বলে ৫৪) বিপক্ষে।

১৯৯৯ সালের ৫ নভেম্বর, পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্রিসবেনের গ্যাবায় গিলির টেস্ট অভিষেক। বাজে ফর্মের কারণে বাদ পড়া উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলির স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি।

টেস্টে নিজের অভিষেক ইনিংসে গিলি নেমেছিলেন ৭ নম্বরে; খেলেছিলেন ১০ বাউন্ডারিতে সাজানো ৮৮ বলে ৮১ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। এছাড়া শেন ওয়ার্নের বলে দারুণ একটি স্টাম্পিংসহ ৬টি ডিসমিসালও আদায় করেছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ১০ উইকেটে।

গিলক্রিস্ট তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটা খেলেছিলেন হোবার্টে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে। পাকিস্তানের দেয়া ৩৬৯ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে ১২৬ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ভয়ানক চাপে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। এদিকে ওয়াসিম, ওয়াকার, শোয়েব, সাকলাইন আর আজহার মাহমুদকে নিয়ে গড়া পাকিস্তানের তৎকালীন বোলিং আক্রমণ ছিল বিশ্বসেরা। এমন সময় ক্রিজে আসলেন গিলক্রিস্ট। এসেই স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শুরু করলেন কাউন্টার অ্যাটাক। জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে (১২৭) নিয়ে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে যোগ করলেন ২৩৮ রান! ১৩টি চার এবং ১টি ছয়ের সাহায্যে খেললেন ১৬৩ বলে অপরাজিত ১৪৯ রানের ‘দুঃসাহসিক’ এক ইনিংস! ৪ উইকেট হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে তরী ভেড়াল অস্ট্রেলিয়া। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি হাঁকানোর জন্য এর চাইতে ভালো উপলক্ষ বোধ হয় আর হতে পারত না!

পাকিস্তানি বোলারদের সেদিন গিলক্রিস্ট যেভাবে শাসন করেছিলেন, বিশেষ করে সাকলাইনের মত অফ স্পিনারকে তিনি যেভাবে সামলেছিলেন তার প্রশংসা করে উইজডেন লিখেছিল, ‘The way he took apart Saqlain with his booming cover drives, clockwork sweeps and massive pulls over mid-wicket gave the world one of the first glimpses of what Adam Gilchrist was capable of.’

২০০০ সালে নিউজিল্যান্ড সফরের তৃতীয় টেস্টে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ১০ ডিসমিসালের ‘অস্ট্রেলিয়ান রেকর্ড’ গড়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। টেস্ট ক্রিকেটে এক ম্যাচে তাঁর চেয়ে বেশি ডিসমিসাল আছে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের জ্যাক রাসেল (১১), দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স (১১) এবং ভারতের ঋষভ পান্তের (১১)।

টেস্ট সিরিজে ব্যাট হাতে তেমন সুবিধা করতে না পারলেও সফল হয়েছিলেন ওয়ানডে সিরিজে। ৪১.৮৩ গড়ে করেছিলেন ২৫১ রান। ক্রাইস্টচার্চে সিরিজের ৪র্থ ম্যাচে ৯ বাউন্ডারি ও ৭ ছক্কায় মাত্র ৯৮ বলে ১২৮ রানের বিস্ফোরক ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। ৬৫ বলে ৭৭ রানের ঝড়ো ফিফটি হাঁকিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন তার আগের ম্যাচেও।

২০০১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মত ভারত সফরে যান গিলক্রিস্ট। ভারতের মাটিতে নিজের প্রথম টেস্ট ইনিংসেই হাঁকান সেঞ্চুরি, মাত্র ৮৪ বলে! ১১২ বলে ১২২ রানের বিধ্বংসী ইনিংসটিতে ছিল ১৫টি চার এবং চারটি ছক্কার মার!

মুম্বাই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ভারতের করা ১৭৬ রানের জবাব দিতে নেমে হরভজন সিংয়ের ঘূর্ণিতে মাত্র ৯৯ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে ওপেনার ম্যাথু হেইডেনকে (১১৯) নিয়ে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে মাত্র ৩২ ওভারে ১৯৭ রান যোগ করেন গিলক্রিস্ট (১২২)। যার সুবাদে ১৭৩ রানের বড় লিড পায় অস্ট্রেলিয়া। মুম্বাই টেস্টে ভারতকে ১০ উইকেটে হারিয়ে টানা ১৬টি টেস্ট জয়ের বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিল স্টিভ ওয়াহর নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া। ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।

২০০১ সালের জুলাইতে ইংল্যান্ডের মাটিতে গিলক্রিস্টের অ্যাশেজ অভিষেক। এজবাস্টনে সিরিজের প্রথম টেস্টেই ১৪৩ বলে ১৫২ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে যথারীতি হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। সেবার অস্ট্রেলিয়া সিরিজ জিতেছিল ৪-১ ব্যবধানে যেখানে গিলির অবদান ছিল ৬৮.০ গড়ে ৩৪০ রান এবং ২৬ টি ডিসমিসাল।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে গিলক্রিস্ট তাঁর ক্যারিয়ারের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটি হাঁকান দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানেসবার্গে। ১৯টি চার এবং ৮টি ছয়ের সাহায্যে মাত্র ২১৩ বল খেলে তিনি উপহার দেন অপরাজিত ২০৪ রানের ‘মহাকাব্যিক’ এক ইনিংস! অ্যালান ডোনাল্ড, মাখায়া এনটিনি, আন্দ্রে নেল, জ্যাক ক্যালিস ও নিকি বোয়েকে নিয়ে গড়া প্রোটিয়া বোলিং লাইনআপ ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী।

অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটা জিতেছিল মাত্র তিনদিনেই! এক ইনিংস ও ৩৬০ রানের বিশাল ব্যবধানে। গিলক্রিস্টের দুঃসাহসিক সেই ইনিংস সম্পর্কে উইজডেন লিখেছিল, ‘A brutal exhibition of power hitting seldom seen – especially in Test cricket.’ সেসময় টেস্ট ক্রিকেটের দ্রুততম ডাবল সেঞ্চুরি (২১২ বল) ছিল এটাই। পরবর্তীতে সেটি ভেঙে দেন কিউই ব্যাটসম্যান নাথান অ্যাস্টল (১৫৩ বল, বিপক্ষ ইংল্যান্ড)।

কেপটাউনে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেও রান উৎসবে মেতে উঠেছিল গিলক্রিস্টের ব্যাট। খেলেছিলেন ২২ বাউন্ডারি আর ৩ ছক্কায় সাজানো ১০৮ বলে অপরাজিত ১৩৮ রানের আরেকটি বিস্ফোরক ইনিংস। তিন ম্যাচ সিরিজে গিলক্রিস্টের সংগ্রহ ছিল ১৫৭.৬৬ গড়ে ৪৭৩ রান! স্ট্রাইক রেট ১০০.২১!

২০০২ সালের ভিবি ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজে ক্যারিয়ারের অষ্টম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটি তুলে নেন গিলক্রিস্ট। মেলবোর্নে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১০৪ বলে ১২৪ রানের (১২×৪, ৪×৬) জয়সূচক ইনিংস খেলে হন ম্যাচ সেরা। ২০০২-০৩ অ্যাশেজটাও অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৪-১ ব্যবধানে। ৫৫.৫০ গড়ে গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে এসেছিল ৩৩৩ রান। একমাত্র সেঞ্চুরিটি (১২১ বলে ১৩৩) হাঁকিয়েছিলেন সিডনিতে সিরিজের শেষ টেস্টে। ২০০২ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট।

২০০৩ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ১০ ম্যাচ খেলে গিলক্রিস্ট করেছিলেন ৪০৮ রান। গড় ৪০.৮০ হলেও স্ট্রাইক রেট ছিল ১০৫.৪৩! চারটি ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন যথাক্রমে জিম্বাবুয়ে (৬১), শ্রীলঙ্কা (৯৯), কেনিয়া (৬৭) এবং ফাইনালে ভারতের (৫৭) বিপক্ষে। এছাড়া উইকেটরক্ষক হিসেবে গড়েছিলেন বিশ্বকাপের এক আসরে সর্বোচ্চ (২১) ডিসমিসালের রেকর্ড। শুধু তাই নয়, নামিবিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের এক ম্যাচে সর্বোচ্চ (৬) ডিসমিসালের রেকর্ডটাও নিজের করে নেন গিলক্রিস্ট।

২০০৩ পঞ্জিকাবর্ষে ৪০.৬৭ গড়ে ১০৯৮ রান করে অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ওডিআই ক্রিকেটার নির্বাচিত হন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ২০০৪ সালের ১৬ জানুয়ারি, হোবার্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে ক্যারিয়ার সেরা ১৭২ রানের ইনিংস খেলেন গিলক্রিস্ট; মাত্র ১২৬ বলে (১৩×৪, ৬×৬)!২০০৪ পঞ্জিকাবর্ষেও অস্ট্রেলিয়ার বর্ষসেরা ওয়ানডে ক্রিকেটার হিসেবে বেছে নেয়া হয় গিলক্রিস্টকেই। সে বছর তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল ৪৮.৮৩ গড়ে ৮৭৯ রান।

২০০৪ সালের মার্চে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। ক্যান্ডিতে সিরিজ নির্ধারণী টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৮৫ বলে ১৪৪ রানের একটি অমূল্য ইনিংস। যার সুবাদে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল মাত্র ২৭ রানে।

২০০৫ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিডনি টেস্টে অস্ট্রেলিয়া জিতেছিল ৯ উইকেটের ব্যবধানে। ১৪০ রানে ৮ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল হলেও আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তানকে সেদিন ম্যাচ থেকে বের করে দিয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। প্রথম ইনিংসে ছয় নম্বরে নামা গিলক্রিস্ট খেলেছিলেন ১৪ বাউন্ডারি ও ৫ ছক্কায় সাজানো ১২০ বলে ১১৩ রানের একটি স্ট্রোকবহুল ইনিংস। যার সুবাদে অস্ট্রেলিয়ার লিডটা চলে গিয়েছিল সফরকারীদের নাগালের বাইরে।

২০০৫ সালের অ্যাশেজটা ছিল স্মরণকালের মধ্যে সবচাইতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দ্বৈরথ। অস্ট্রেলিয়া হেরেছিল ২-১ ব্যবধানে। তবে সেবার ব্যাট হাতে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন গিলক্রিস্ট। পাঁচ টেস্ট খেলে মাত্র ২২.৬৩ গড়ে করেছিলেন ১৮১ রান!

টেস্টে পরাজিত হলেও ওয়ানডেতে ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ওভালে সিরিজ নির্ধারণী শেষ ম্যাচে গিলক্রিস্টের ঝোড়ো সেঞ্চুরিতেই (১০১ বলে ১২১*) ৮ উইকেটের বড় জয় তুলে নিয়েছিল সফরকারীরা।

২০০৫ সালে অক্টোবরে তারকাসমৃদ্ধ বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে টেস্ট (১-০) এবং ওয়ানডে (৩-০) সিরিজে জয়লাভ করেছিল অস্ট্রেলিয়া। বিশ্ব একাদশে ছিলেন লারা, ক্যালিস, সাঙ্গাকারা, শেবাগ, দ্রাবিড়, ইনজামাম, গেইল, পোলক, মুরালিধরন, পিটারসেন, ফ্লিনটফ, ভেট্টোরি, শোয়েব আখতারদের মত সুপারস্টাররা।

গিলক্রিস্ট তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি খেলেছিলেন এই সিরিজেই। মেলবোর্নে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ৮ চার ও ৪ ছক্কার সাহায্যে করেছিলেন ৭৯ বলে ১০৩ রান। সে ম্যাচে গিলির হাতে বেধড়ক পিটুনি খাওয়া বিশ্ব একাদশের বোলারদের ইকোনমি রেট ছিল দেখার মত। মুরালি (৪.৩) বাদে কমবেশি মার খেয়েছিলেন প্রায় সবাই; পোলক ৬.১৩, শোয়েব ৭.৬৩, ফ্লিনটফ ৮.০, ক্যালিস ১১.০, ভেটোরি ৫.৪!

২০০৬ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ভিবি ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজে ২টি সেঞ্চুরিসহ গিলক্রিস্টের ব্যাট থেকে এসেছিল ৪৮.০ গড়ে ৪৩২ রান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের দ্রুততম (৬৭ বলে) সেঞ্চুরিটা হাঁকিয়েছিলেন ফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২০০৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ফতুল্লা টেস্টের প্রথম ইনিংসে গিলক্রিস্টের সেঞ্চুরিটাকেই টার্নিং পয়েন্ট বলে মনে করেন অনেকে।

বাংলাদেশের করা ৪২৭ রানের জবাবে খেলতে নেমে রফিক, এনামুল জুনিয়রদের ঘূর্ণিতে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৯৩ রান তুলতেই হারিয়ে বসে ৬ উইকেট! কেবল ফলোঅন এড়াতেই তখনো লাগে ১৩৪ রান! এমন সংকটময় পরিস্থিতি থেকে গিলক্রিস্টই তাদের বাঁচিয়েছিলেন সেদিন। উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক উইকেটে গিলক্রিস্ট খেলেছিলেন ২১২ বলে ১৪৪ রানের (১৫×৪, ৬×৬) দুঃসাহসিক এক ইনিংস।

২০০৬-০৭ অ্যাশেজটা ৫-০ ব্যবধানে জিতে ‘মধুর প্রতিশোধ’ নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। পার্থে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারের দ্রুততম (৫৭ বলে) সেঞ্চুরিটা তুলে নিয়েছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। হাঁকিয়েছিলেন ১২টি চার ও ৪টি ছক্কা! গিলির ৫৯ বলে ১০২ রানের বিধ্বংসী সেই ইনিংস প্রসঙ্গে জাস্টিন ল্যাঙ্গার বলেছিলেন, “He made a hundred in just about an hour. It was brilliant, freakish, unbelievable, the best thing I’ve ever seen in a cricket field.”

টেস্টে গিলক্রিস্টের চেয়ে কম বল খেলে সেঞ্চুরি আছে শুধুমাত্র স্যার ভিভ রিচার্ডস (৫৬ বল), মিসবাহ্ উল হক (৫৬ বল) এবং ব্রেন্ডন ম্যাককালামের (৫৪)। ২০০৭ বিশ্বকাপের শুরুতে কিছুটা অফ ফর্মে ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। ফাইনালের আগে ১০ ম্যাচ খেলে করেছিলেন মাত্র ৩০৪ রান। দুটো ফিফটি হাঁকিয়েছিলেন ‘দুর্বল’ নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের বিপক্ষে।

পুরো টুর্নামেন্টে ফ্লপ গিলক্রিস্ট বাজিমাত করেছিলেন ফাইনালে। নিজের সেরাটা বোধ হয় ফাইনালের জন্যই তুলে রেখেছিলেন এতদিন! ১৩ চার ও ৮ ছক্কায় উপহার দিয়েছিলেন ১০৪ বলে ১৪৯ রানের এক বিধ্বংসী মাস্টারক্লাস! বিশ্বকাপের ফাইনালে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে যেটি টিকে আছে আজও।

বৃষ্টি ও আলোকস্বল্পতার কারণে ৩৮ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে গিলক্রিস্টের ইনিংসটা ঠিক কতটা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তা বোঝানোর জন্য কিছু পরিসংখ্যান দিচ্ছি। হেইডেন-গিলির উদ্বোধনী জুটিতে তোলা ১৭২ রানের মধ্যে হেইডেনের অবদান ছিল মাত্র ৩৮! ১০৪ বলে ১৪৯ করে গিলক্রিস্ট যখন আউট হলেন, অস্ট্রেলিয়ার স্কোর তখন ৩০.৩ ওভারে ২২৪। অর্থাৎ দলীয় সংগ্রহের ৬৬.৫২% রানই এসেছিল গিলির ব্যাট থেকে!

লঙ্কান অধিনায়ক মাহেলা জয়াবর্ধনের ভাষায়, ‘One of the finest innings ever played in odi cricket. Unfortunately, I was the opposition captain looking at it.’

খেলার প্রথমার্ধেই ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়া লঙ্কানরা শেষ পর্যন্ত হেরেছিল ৫৩ রানে। প্রতিপক্ষের জায়গায় অস্ট্রেলিয়ার নাম লেখা থাকলেও তাদের আসল প্রতিপক্ষ ছিল গিলক্রিস্ট। ভাসের সুইং, মুরালির ঘূর্ণি, ফার্নান্দোর গতি কিংবা মালিঙ্গার ইয়র্কার — কোন কিছু দিয়েই আটকানো সম্ভব হয় নি যাকে!

২০০৮ সালে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন এই বাঁহাতি কিপিং লিজেন্ড। ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজে ৪ টেস্ট খেলে ২১.৪২ গড়ে করেছিলেন মাত্র ১৫০ রান। তবে অবসরে যাওয়ার আসল কারণ সেটা ছিল না। উইকেটের পেছনে ভিভিএস লক্ষণের একটি সহজ ক্যাচ ছাড়ার পরই নাকি অনুধাবন করেন, সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছেন তিনি!

অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রুড অবশ্য সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন গিলক্রিস্টকে। সে অনুরোধ রেখেছিলেন গিলি, অংশ নিয়েছিলেন দেশের মাটিতে আয়োজিত কমনওয়েলথ ব্যাংক ত্রিদেশীয় সিরিজে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের শেষ ফিফটি (৮৩) ও সেঞ্চুরি (১১৮) দুটোই হাঁকান শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। মজার ব্যাপার হল, দুটো ম্যাচেই সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।

অবসরের পর হায়দারাবাদ ডেকান চার্জার্স এবং কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের হয়ে আইপিএল খেলেছেন ছয় মৌসুম। একবার অধিনায়কের ভূমিকায় ডেকান চার্জার্সকে শিরোপাও জিতিয়েছেন। তিনটি ওয়ানডে বিশ্বকাপ, চারটি অ্যাশেজ, টানা ১৬টি টেস্ট জয়, ভারতের মাটিতে সিরিজ জয়, দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ডিসমিসাল — একজন সফল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে যা যা দরকার প্রায় সবই জিতেছেন গিলক্রিস্ট। ২০১৩ সালে আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাঁকে।

 গিলক্রিস্টের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান

  • টেস্ট: ৯৬ টেস্টে ৪৭.৬০ গড়ে এবং ৮১.৯৮ স্ট্রাইক রেটে তাঁর সংগ্রহ ৫৫৭০ রান। সেঞ্চুরি ১৭টি, হাফ সেঞ্চুরি ২৬টি। ক্যারিয়ার সেরা ২০৪*, বিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা।
  • ওয়ানডে: ২৮৭ ম্যাচে ৩৫.৮৯ গড়ে ও ৯৬.৯৪ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৯৬১৯ রান। ১৬টি শতকের পাশাপাশি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন ৫৫টি। সর্বোচ্চ ১২৬ বলে ১৭২, বিপক্ষ জিম্বাবুয়ে।
  • আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি: ১৩ ম্যাচে ২৭২ রান। গড় ২২.৯৬, স্ট্রাইক রেট ১৪১.৬৬। সর্বোচ্চ ২৯ বলে ৪৮, বিপক্ষ ইংল্যান্ড। এছাড়া উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে তাঁর রয়েছে টেস্টে ৪১৬টি (দ্বিতী সর্বোচ্চ), ওয়ানডেতে ৪৭২টি (দ্বিতীয়য সর্বোচ্চ) এবং টি-টোয়েন্টি ১৭টি ডিসমিসাল।
  • অধিনায়কত্ব: ছয়টি টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গিলক্রিস্ট জিতেছেন চারটিতে, হেরেছেন মাত্র একটি টেস্ট। এছাড়া ওয়ানডেতে গিলির অধীনে ১ ১টি জয়ের বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ার হার মাত্র চারটি।
  • বিশ্বকাপ রেকর্ড: ৩১ টি বিশ্বকাপ ম্যাচে গিলক্রিস্টের সংগ্রহ ৩৬.১৬ গড়ে ১০৮৫ রান; স্ট্রাইক রেট ৯৮.০১! সেঞ্চুরি ১টি, ফিফটি ৮টি। ডিসমিসাল সংখ্যা ৫২ টি।

গিলক্রিস্টকে বলা হতো ‘বিগ স্টেজ পারফরমার’। বিশ্বকাপ বা যেকোন বড় টুর্নামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ নক আউট ম্যাচের জন্য নিজের সেরাটা জমিয়ে রাখতেন সবসময়। তিনবার বিশ্বকাপ খেলে তিনটিতেই শিরোপা জেতা গিলির একটি অনন্য রেকর্ড হচ্ছে তিনটি ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালেই (১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭) তিনি অন্তত একটা ফিফটি হাঁকিয়েছেন!

অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার মনে করা হয় গিলক্রিস্টকে। তাঁর ১৬টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির সবক’টিতে জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া! এমনকি টেস্টেও গিলির ১৭ সেঞ্চুরির মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছিল অস্ট্রেলিয়া!

২০০৭ সালে প্রকাশিত এক জরিপে অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা ওয়ানডে ক্রিকেটার নির্বাচিত হন গিলক্রিস্ট। ১৬৮ জন ভোটারের মধ্যে ৬৫ জন অর্থাৎ ৩৯ শতাংশই রায় দিয়েছিলেন গিলির পক্ষে।

ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটা আক্রমণাত্মক, মানুষ হিসেবে ঠিক ততটাই নিরীহ ছিলেন গিলক্রিস্ট। তাঁর মত সৎ, বিনয়ী ও নিপাট ভদ্রলোক খুব কমই দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। বাচ্চাদের মতো অমন নিষ্পাপ হাসি যার, সে কীভাবে দিনের পর দিন বোলারদের নির্দয়ভাবে পেটাত, ভাবলেই অবাক লাগে।

শেষ করবো একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ দিয়ে। ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আম্পায়ার আউট না দেয়া সত্ত্বেও প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা অর্থাৎ ‘ওয়াক’ করেছিলেন গিলক্রিস্ট। সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে বিখ্যাত ওয়াক এটাই। পরে অবশ্য বারবার রিপ্লে দেখেও পরিষ্কার হয় নি যে আদৌ তিনি আউট ছিলেন কিনা!

ওই ঘটনার পর থেকে ক্রিকেট মাঠের অতি পরিচিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায় গিলক্রিস্টের ‘ওয়াক’। এজন্য তাঁকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে অনেকবার। কখনও কখনও সতীর্থরাই তাঁর ওপর বিরক্ত হয়েছে। তাঁকে সমর্থন না দিয়ে উল্টো বিরোধিতা করেছে। রিকি, স্টিভরাও বিষয়টা ভাল চোখে দেখতেন না। তারপরেও তিনি ‘ওয়াক’ করেছেন।

একবার বাংলাদেশের বিপক্ষেও ‘ওয়াক’ করেছিলেন গিলক্রিস্ট। পরে রিপ্লেতে দেখা গেছে, ব্যাটে-বলে সংযোগ হয়নি!

ব্রিটিশ ক্রীড়ালেখক ম্যাট ক্লিয়ারি একবার গিলক্রিস্টের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘ওয়াক করে বলে গিলক্রিস্ট কি ভাল? আমি বলি ‘না।’ একটি আপিলের পর সে হয়তো নিজেকে জিজ্ঞেস করে আচ্ছা, এটা কি আউট? ইয়েস অর নো? ইয়েস! ওকে লেটস ওয়াক! আপিল এবং আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আম্পায়ারের সম্মতি যে ব্যাটসম্যানের ‘আউট’ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ — বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করছে সে। এটা কি ঠিক?’ এতকিছুর পরেও গিলিকে অনুসরণ করে ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ওয়াক করেন জেসন গিলেস্পি ও মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ।

নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক স্টিফেন ফ্লেমিংয়ের স্পষ্ট অভিযোগ ছিল, গিলক্রিস্ট নাকি ‘ওয়াকিং ক্রুসেড’ শুরু করেছেন। একবার পরিষ্কার কট বিহাইন্ড হয়ে উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্রেইগ ম্যাকমিলানকে ওয়াক করতে বলেন গিলক্রিস্ট। প্রত্যুত্তরে কিউই অলরাউন্ডার বলেছেন, ‘সবাই ওয়াক করে না! গিলির তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘সবাইকে ওয়াক করতে হয়ও না, বন্ধু!’ ঠিক তার পরের বলেই প্লাম্ব এলবিডব্লিউ হয়ে যান ম্যাকমিলান। ওয়াক করতে হয়নি; আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই তর্জনী উঠিয়ে দেন আম্পায়ার!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...