গুঞ্জন ছিল অনেক আগে থেকেই, এবার সে গুঞ্জনকে সত্যি করে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল ক্লাব চেলসি এফ.সি থেকে বিদায় নিয়েছেন রাশিয়ান ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ। লস অ্যাঞ্জেলস ডজার্স বেসবল দলের মালিক টড বোয়েলির নেতৃত্বাধীন কনসোর্টিয়াম প্রায় ৪.২৫ বিলিয়ন ইউরো বা ৫.২ বিলিয়ন ইউএস ডলারের বিনিময়ে চেলসিকে কিনে নিয়েছে।
প্রায় দেড়যুগ আগে, ২০০৩ সালে ইংলিশ ক্লাব চেলসি’র ইতিহাসে আগমন ঘটে রোমান আব্রামোভিচের। তিনি ১৪০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে সেবার চেলসি’র মালিকানা অর্জন করেছিলেন। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে ক্লাবটিতে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন আব্রামোভিচ। তার আমলেই চেলসি তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা সময় কাটায়।
২০০৩ সাল থেকে ২০২২ সাল এই উনিশ বছরে চেলসি জিতেছিল পাঁচটি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা, জিতেছিল দুইটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ-ও। কারনটাও স্পষ্ট, ব্লুজদের প্রতি আব্রামোভিচের ভালবাসা ছিল নি:স্বার্থ। বিশাল অংকের টাকা বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও চেলসি’কে কখনোই নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাবতেন না এই রাশান। তাই তো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লগ্নি করেও চেলসি থেকে মুনাফা হিসেবে কোন টাকা নেন নি রোমান আব্রামোভিচ।
তবে এত এত সুখ কপালে সয় নি চেলসি’র। রাশিয়া-ইউক্রেন যু্দ্ধের বলির পাঁঠা হতে হয়েছে ক্লাবটিকে৷ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘরের লোক হওয়ায় যুক্তরাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে এসেছিল রোমান আব্রামোভিচের উপর। এমনকি ইংল্যান্ডে থাকা তার সমস্ত সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় যুক্তরাজ্য সরকার।
ফলে চেলসি’র কার্যক্রমে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাঘাত ঘটে। ক্লাবটির নতুন খেলোয়াড় ক্রয়, বর্তমান খেলোয়াড়দের চুক্তি নবায়নে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটির সরকার। পাশাপাশি ম্যাচ আয়োজনে অর্থ খরচে কড়াকড়ি, জার্সি বিক্রি সহ নানাধরনের ফুটবল সম্পর্কিত কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয় চেলসিকে। এমন পরিস্থিতিতে ক্লাবটিকে রক্ষা করতে আবারো এগিয়ে আসেন রোমান আব্রামোভিচ। সিদ্ধান্ত নেন নিজের সন্তানসম ক্লাবটিকে বিক্রয়ের।
বিক্রয়ের সময় চেলসি’র বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। বিশাল মূল্যের এই ক্লাবটি ক্রয়ের দৌড়ে শেষপর্যন্ত জিতেছেন আমেরিকান উদ্দ্যোক্তা টড বোয়েলি। এছাড়া বোয়েলি’র কনসোর্টিয়ামে সুইস বিলিয়নিয়ার হ্যান্সজর্গ উইস এবং ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী জোনাথন গোল্ডস্টেইনও রয়েছেন। ২০১৯ সাল থেকেই এই আমেরিকান ব্যবসায়ী ক্লাবটি কেনার চেষ্টা করেছিলেন, সেসময় রোমানকে রাজি করাতে না পারলেও এবার সফল হয়েছেন তিনি। অবশ্য রোমান আব্রামোভিচকে বাধ্য হয়েই রাজি হতে হয়েছে, সেটি বলাই যায়।
চেলসি’র মালিকানা পেতে এখন বোয়েলি এবং তার নিয়ন্ত্রাধীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাজ্যের একটি ফ্রোজেন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্রায় ৩.১ বিলিয়ন ইউএস ডলার জমা দিতে হবে। এবং বাকি ২.১৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার চেলসি’র মানোন্নয়নে বিনিয়োগ করা হবে। চেলসি’র প্রতি নিবেদিত প্রাণ আব্রামোভিচ চেলসি’কে বিক্রি করার কোন টাকা নিজের পকেটে নিতে চান নি৷ তাই তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফ্রোজেন অ্যাকাউন্টের সব টাকা চলে যাবে ইউক্রেন যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য।
২০০৩ সালে যে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল চেলসি’র ইতিহাসে, এবার সে রোমান সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটেছে। রোমান আব্রামোভিচ বিশ্বের সেরা ক্লাব-মালিকদের একজন হয়েই শেষ করেছেন চেলসি অধ্যায়, আর চেলসি’র ইতিহাসে হয়তো সবচেয়ে সেরা তিনিই। অবশ্য কাগজে কলমে বিদায় নিলেও রোমান আব্রামোভিচ থেকে যাবেন চেলসি ক্লাবের, বিদায় বলা যাবে না; সন্তান পিতা থেকে দূরে সরে গেলেও কি বিদায় বলা যায়?