হার না মানার দৃঢ়তা
ব্যক্তিজীবনেও ছিল রুবেলের হার না মানার মানসিকতা। ২০১৯ সালে ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পরেও ২৪টা কেমোথেরাপি নিয়ে তিনি ওই বছরই ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেন। সে বার বিপিএল চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের সদস্য ছিলেন তিনি। খেলেছিলেন একটি ম্যাচ। কিন্তু এ বছরের শুরুতে আবারো তাঁর মস্তিষ্কে জেঁকে বসে টিউমার। এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। শরীরের এক ভাগ অবশ হয়ে যাবার পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লড়াই করে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় পাঁচদিন আগে ঘরে ফিরেও ব্রেন টিউমারের বিপক্ষে অবশেষে হার মানতেই হলো তাঁকে।
চৌদ্দবছর আগের সে দিনটার কথা বেশ মনে পড়ছে। দিনটা ছিল খুব সম্ভবত শনিবার। স্কুল থেকে ফিরে বিকেলবেলা ঘরে বসে এনটিভির সাপ্তাহিক আয়োজন ‘গ্যালারি’ দেখছিলাম। খেলাধুলার যাবতীয় তথ্য নিয়ে সাজানো সে আয়োজন ভুলেও মিস হতো না আমার।
তখন সদ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য স্পিনার মোহাম্মদ রফিক। তাই রফিককে ট্রিবিউট দিয়ে নাসিমুল হাসান দোদুলের করা একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে ‘গ্যালারি’র ওই পর্বটা শুরু হয়।
মোহাম্মদ রফিকের অবসর নিয়ে তখন নানা বিতর্ক। নিজের বিপক্ষে বোর্ডের নানাবিধ সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে অবসর নিতে একপ্রকার বাধ্য হন বলেই তিনি জানান সে সময়। ২০০৮ সালের নিউজিল্যান্ড সফর থেকে বাদ পড়ার পরেই অভিমানের বশে ব্যাট-প্যাড তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন রফিক। আর যাবার আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নিজের উত্তরসূরির নামটাও বলে যান তিনি যা গ্যালারির ওই পর্বের মাধ্যমে জানতে পারি আমি। চৌদ্দবছর আগে মোহাম্মদ রফিকের মুখে উচ্চারিত সেই নামটি মোশাররফ হোসেন রুবেল।
রুবেল পরবর্তীতে মোহাম্মদ রফিকের উত্তরসূরি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যোগ্য উত্তরসূরি হতে পারেননি। রফিক অবসর নেওয়ার পরের সিরিজেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে রুবেলের। অভিষেক সিরিজে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিনটি ওয়ানডে খেলে আশানুরূপ কিছু করতে না পারায় বাদ পড়েন দল থেকে। পাঁচবছর পর ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা সফরের ওয়ানডে দলে পুনরায় ডাক পান তিনি। কিন্তু সুযোগ পাননি একটি ম্যাচেও।
ওই সফরের পরপরই বিপিএল ফিক্সিংয়ে সন্দেহভাজনদের তালিকায় নাম আসলে সাময়িক নিষিদ্ধ হন রুবেল। এরকম ধাক্কা অবশ্য সে বারই প্রথম খেতে হয়নি তাঁকে। এর আগে ২০০৮ সালে আইসিএল খেলতে যাওয়ায় দশ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ২০০৯ সালে আইসিএল বর্জন করলে পরের বছর থেকে নিষেধাজ্ঞামুক্ত হন রুবেল। ঠিক তেমনি ২০১৩ সালে ফিক্সিংকাণ্ডে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পান তিনি।
বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলার স্বপ্নটা সবসময় লালন করে গেছেন রুবেল। যে কারণে ঘরোয়া ক্রিকেটটা তিনি জান-প্রাণ দিয়ে খেলতেন। ঘরোয়ায় অধিকাংশ সময় তিনি কাটিয়েছেন বহু ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্স করে। ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগেও এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বেশ চাহিদা ছিল তাঁর। তাছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও তাঁর নামের পাশে রয়েছে চারশর কাছাকাছি উইকেট।
তবে একজন ক্রিকেট-অনুসারী হিসেবে মোশাররফ হোসেন রুবেল সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত সব স্মৃতি ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সকে ঘিরে আবর্তিত। বিপিএলের প্রথম দুই আসরেই তিনি খেলেছিলেন ঢাকার হয়ে। আর আমি বরাবরই ঢাকার কট্টর সমর্থক, হোক সেটা গ্ল্যাডিয়েটর্স, ডায়নামাইটস বা অন্যকিছু।
তো বিপিএলের প্রথম দুই আসরেই গ্ল্যাডিয়েটর্সের চ্যাম্পিয়ন হবার পেছনে রয়েছে রুবেলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান। কখনো ব্রেকথ্রু দিয়ে, কখনো উইকেট না তুলেও কৃপণ বোলিং করে, কখনো-বা আঁটোসাঁটো বোলিং দ্বারা ব্যাটারদের চাপে ফেলে অপর প্রান্ত থেকে সতীর্থকে উইকেট তুলে নিতে সাহায্য করার মাধ্যমে অবদান রাখেন তিনি। মনে পড়ে, বিপিএলের দ্বিতীয় আসরের ফাইনালসেরাও তিনিই হয়েছিলেন। পরিসংখ্যান ঘাটলে অবশ্য গ্ল্যাডিয়েটর্সের হয়ে তাঁর ইমপ্যাক্টটা পুরোপুরি বুঝা যাবে না। এককথায় আনসাং হিরো হিসেবে পর্দার আড়ালে থেকেই নিজের কাজটা সফলতার সাথে করে গিয়েছিলেন তিনি।
মাঠ এবং মাঠের বাইরে হার না মানার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন মোশাররফ হোসেন রুবেল। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার কারণেই দীর্ঘ বিরতির পরেও বারবার দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের পর ২০১৩ সালে ফিরে আবারো বাদ পড়ে ২০১৬ সালে পুনরায় দলে জায়গা পান তিনি। কিন্তু কোনোবারই নিজের অবস্থানটা পাকাপোক্ত করতে পারেননি।
ব্যক্তিজীবনেও ছিল রুবেলের হার না মানার মানসিকতা। ২০১৯ সালে ব্রেন ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পরেও ২৪টা কেমোথেরাপি নিয়ে তিনি ওই বছরই ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন করেন। সে বার বিপিএল চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের সদস্য ছিলেন তিনি। খেলেছিলেন একটি ম্যাচ। কিন্তু এ বছরের শুরুতে আবারো তাঁর মস্তিষ্কে জেঁকে বসে টিউমার। এবার আর শেষ রক্ষা হয়নি। শরীরের এক ভাগ অবশ হয়ে যাবার পর নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে লড়াই করে মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় পাঁচদিন আগে ঘরে ফিরেও ব্রেন টিউমারের বিপক্ষে অবশেষে হার মানতেই হলো তাঁকে।
তবে ব্যাধির বিপক্ষে হারলেও ঠিকই সকলের মন জয় করে নিয়েছেন রুবেল। সেটা জীবদ্দশায় তাঁর অমায়িক ব্যবহারের জন্য তো বটেই, হার না মানা মানসিক দৃঢ়তার জন্যেও। ভালো থাকবেন, প্রিয় মোশাররফ হোসেন রুবেল!