কী অদ্ভুত পরস্পর বিরোধী এক চরিত্র!

রাত এগারোটার কিছু বেশি। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায় নি গাড়ির একমাত্র সওয়ারিকে। হ্যাঁ গাড়িতে একাই ছিলেন সাইমন্ডস। একা। এতদিন খুব বেশি খোঁজ করিনি তাঁর। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখছি মানুষটাকে আমরা ক্রিকেট অনুরাগীরা বোধহয় ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। জীবনের থেকে ও নিজেকে বড়ো দেখানোর একটা প্রাণপণ তাগিদ ছিল তাঁর। কিন্তু কেন?

সিমো, আপনি কি রমন লাম্বা নামটা শুনেছিলেন কখনো? শোনার সম্ভাবনা অবশ্য কম কারণ লাম্বা যখন শেষ টেস্ট খেলে ফেলেছেন তখন আপনি মাত্র বারো। আর চার টেস্ট আর কুড়িটা মত ওয়ান ডে ম্যাচ খেলা লাম্বার ক্রিকেট জীবনের ঝুলিতে এমন কিছু ছিল না যা আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছবে।

ক্রিকেট ইতিহাসের অনুরাগী পাঠক হিসেবেও আপনার তেমন বিরাট খ্যাতি ছিল তেমন কোনো খবর নেই। কিন্তু কি জানি আপনার চলে যাওয়ার খবর শুনে খালি মিরাটে জন্ম নেওয়া দিল্লী ওপেনারই স্মৃতিতে আসছেন। খুব কম ক্রিকেটারই ইমরান খানকে স্কোয়ার কাট করে ছক্কা মারার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু লাম্বা কে আপনার মৃত্যুর পরে মনে পড়ার কারণ সেটাও নয়।

১৯৯৮ সালের বিশ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে আবাহনির হয়ে খেলা লাম্বাকে যখন বাঁ হাতি স্পিনার সফিউল্লাহ খানের বলে ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে দাঁড়াতে বলা হয়েছিল তখন বারবার হেলমেট নিতে বলা হয়েছিল তখন তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে মাত্র তো তিনটে বল বাকি ওভারের! এর জন্য আবার হেলমেট!

এবং ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ইমেজ লাম্বার ক্রিকেট জীবন জুড়ে – ইমরান খানকে ছক্কা মারা বা ভারতীয় দলে নিজের অভিষেকের আগেই হোটেলের ঘরে একাধিক বান্ধবি নিয়ে আসা বা পশ্চিমাঞ্চলের ক্রিকেটার রশিদ প্যাটেলকে তাড়া করা, এবং সব শেষ বিনা হেলমেট এ ফরওয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং!

এর পাশাপাশি আপনার একটা ছবি। শ্রীলঙ্কার সাথে কোনো ম্যাচ। নন স্ট্রাইক এন্ডে মাইকেল ক্লার্ক। সোজা ব্যাট এ খেললেন আপনি নিরীহ বলটা। এমনিতে মিড অফ আর মিড অন ওপরে থাকলে ওটা চারই হতো হয়তো। কিন্তু বলটা ক্লার্কের প্যাডে লেগে একটু অদ্ভুত জায়গায় দাঁড় করানো ফিল্ডারের হাতে গেল বল। ক্যাচ। অন্য যে কেউ হলে ভেঙে পড়ত। কিন্তু আপনি কী করলেন।

প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটতে, হাঁটতেও পিছন ফিরলেন এবং চোখ মটকে ক্লার্ককে ইশারা করলেন , একটা ড্রিঙ্ক ট্রিট দেওয়ার জন্য। ক্লার্ক তখনো ঘটনার আকস্মিকতা হজম করতেই পারেন নি। সেই লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ কে ছোঁয়ার চেষ্টা! কাউন্টি ক্রিকেট এ এক ইনিংস এ ছয়ের বন্যা বইয়ে দেওয়া ক্রিকেটার, যিনি বহুবার অস্ট্রেলিয়ার প্রাথমিক পতন সামলে ইনিংস কে মজবুত করেছেন, সেই তিনি ই মাছ ধরার কারণে টিম মিটিং এ এসেছেন দেরি করে অথবা অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবনের কারণে ২০০৯ এ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আসর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাঁকে।

কী অদ্ভুত পরস্পর বিরোধী এক চরিত্র! যিনি সতীর্থের সমর্থনে হরভজন সিংয়ের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হন সেই তিনি ই সাক্ষাৎকার দেন, যে এক বিশেষ অস্ট্রেলিয়ান সতীর্থের বাড়িতে ডিনার এ যাওয়াটা বেশ আকর্ষণীয় কারণ সতীর্থের সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকবার দৃষ্টি বিনিময় করা যায়।

চিন্তা করতে পারেন যে সৌরভ বা রাহুলের বাড়িতে গিয়ে অনিল কুম্বলে বা শচীন টেন্ডুলকার এমন মন্তব্য করছেন! কিন্তু লোকটার নাম যখন অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস, তখন সবই সম্ভব। হ্যাঁ, সতীর্থের নামটা বলা হয়নি , ম্যাথু হেইডেন। সেই হেইডেন যাঁর সঙ্গে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে মাছ ধরার নৌকা ডুবে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন দুজনে।

সিমোর জীবনটা এরকমই। সেখানে নুনের কোনো অভাব নেই। আলোনা স্বাদ বলে কিচ্ছু নেই। ২৬ টেস্টে চল্লিশের ওপরে ব্যাটিং গড় এবং চব্বিশ উইকেট। খুব ফেলে দেওয়ার মতন কি? না বোধহয়। কিন্তু দলে ঢোকা এবং বেরোনোটা প্রায় রুটিন করে ফেলেছিলেন তিনি। এবং দল থেকে বেরোনোর পিছনে অক্রিকেটিয় কারণটাই বেশি ছিল বেশিরভাগ সময়েই।

লাল বলের থেকে সাদা বলের ক্রিকেটেই তাঁর ‘ইমপ্যাক্ট’ বেশি ছিল । তাঁর আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, তাঁর উপযোগী বোলিং , ফিল্ডিংয়ের সময় তাঁর চূড়ান্ত অ্যাথলেটিসিজম – এগুলো প্রতিটাই আলাদা করে আলোচনার বিষয় হতে পারত। ভারতের বিরুদ্ধে এসসিজিতে ১৬২ নট আউট, ২০০৬-০৭’র অ্যাশেজে বক্সিং ডে টেস্টে দল যখন পাঁচ উইকেটে চুরাশি তখন হেডেনের সঙ্গে ২৭৯ এর পার্টনারশিপ এবং তাঁর ব্যক্তিগত ১৫৬ অনায়াসে আলোচনার বিষয়বস্তু হতেই পারত।

কিংবা ২০০৩ বিশ্বকাপের সেই ১৪৩! চার উইকেটে ছিয়াশি থেকে আট উইকেটে ৩১০ এ গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু হয়নি। কেন ? উত্তর অজানা। তিনি আলোয় থেকেছেন মাঙ্কি গেট বা ওইরকম ই সব আনুষঙ্গিক কারণে। ১৯৮ ওডিআই তে পাঁচ হাজারের ও বেশি রান বা ১৩৩ উইকেট, চল্লিশের কাছাকাছি গড়। কেউ সেই সব নিয়ে মাথা ঘামায় নি।

সিমো মানেই হাতে গরম সব বিতর্ক। কখনো ক্রিকেট মাঠে নামা দর্শক কে তাড়া করছেন তো কখনো অন্য কিছু। পূর্ণ বিনোদন। সব সময়। ভাবতে পারেন যে ক্রিকেট ক্যারিয়ার এর মাঝখানেই রাগবিতে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতেও চলে গিয়েছিলেন!

ব্যাটসম্যান সাইমন্ডসই বোধহয় বেশি আলোচিত তাঁর ক্রিকেটিয় দক্ষতার নিরিখে। বা বোলার সাইমন্ডস। কিন্তু রিকি পন্টিং তাঁকে তাঁর দেখা সেরা ফিল্ডার বলেছেন। পন্টিং তাঁকে হার্শাল গিবস বা জন্টির থেকেও এগিয়ে রেখেছেন । কারণ পন্টিংয়ের মতে ওই দুজনের থেকে বেশি লম্বা হওয়ার কারণে অনেক বেশি গ্রাউন্ড কভার করতে পারতেন সিমো

পন্টিংয়ের সঙ্গে একমত আপনি নাই হতে পারেন কিন্তু ফিল্ডার হিসেবে সিমো তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন এটা মানতেই হবে। অন্য অনেক ফিল্ডার এর থেকে তাঁর তফাৎ টা এখানেই ছিল যে, তিনি চাইতেন বল তাঁর দিকেই সুক সবসময়। প্যাশন ছিল ফিল্ডিংয়ের জন্য । আর সঙ্গে ছিল জন্মগত অ্যাথলেটিসিজম!

আসলে অ্যান্ড্রু সাইমন্ডস বোধহয় এক প্রহেলিকা ছিলেন । আমাদের কাছে শুধু নয় নিজের কাছেও । এক স্বভাব বোহেমিয়ান। ক্রিকেটের স্কোর কার্ড বোধহয় খুব বেশি গুরুত্ব পায় নি তাঁর কাছে । আর এই বোহেমিয়ান স্বভাবের শিকড় টা বোধহয় ছিল ই তাঁর। জন্মদাতা পিতা সম্ভবত ছিলেন অ্যাফ্রো – ক্যারিবিয়ান রক্তের এবং মা কোনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশের।

কী আসলে চেয়েছেন তা বোধহয় জানা ছিল না তাঁর নিজের ও। বার্মিংহ্যামের হাসপাতাল থেকে কেন এবং বারবারা সাইমন্ডস তুলে এনেছিলেন যে বারো সপ্তাহের শিশুকে , যাঁর জন্ম বৃত্তান্তেও ঘন কুয়াশা, মৃত্যুতেও যেন সেই রকমই আকস্মিকতা। হার্ভি রেঞ্জ, গ্রানাইট ভেল , কুইন্সল্যান্ডের পার্বত্য অঞ্চল। সেই অঞ্চলেই অ্যালিশ রিভার ব্রিজের কাছাকাছি অঞ্চলে ঘাসের জমির ওপরে উল্টে পড়েছিল গাড়িটা।

রাত এগারোটার কিছু বেশি। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায় নি গাড়ির একমাত্র সওয়ারিকে। হ্যাঁ গাড়িতে একাই ছিলেন সাইমন্ডস। একা। এতদিন খুব বেশি খোঁজ করিনি তাঁর। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখছি মানুষটাকে আমরা ক্রিকেট অনুরাগীরা বোধহয় ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি। জীবনের থেকে ও নিজেকে বড়ো দেখানোর একটা প্রাণপণ তাগিদ ছিল তাঁর। কিন্তু কেন?

উত্তর যিনি দিতে পারতেন তিনি বোধহয় এতক্ষণে ওয়ার্নির সঙ্গে বসে পড়েছেন রঙিন গ্লাস হাতে। আর পুরু করে জিঙ্ক অক্সাইড মাখা ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি।তাঁর মোটামুটি নিরীহ অফ স্পিন পড়তে পেরেছি আমরা। কিন্তু ওই হাসিটা বোধহয় পড়া গেল না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...