শচীন খেলছে…

তোমার ভ্যাকসিন হয়ে গেছে দু ডোজ। আমি পাইনি একটাও। আমি লাইন দিচ্ছি প্রতিদিন। অথচ আমরা শচীন দেখেছি ছেলেবেলায়। একসাথে। শচীন জানতে পারেনি কিছু। শচীন খেলছে৷ খেলেই চলেছে কতকাল। শচীন জানেনা তোমরা কত এসেনশিয়াল, আমরা নিছক ফাউ।

আমরা একটা টিভি নিয়ে এলাম ছাদে। ভাড়া করা। ১০ ঘন্টায় ২০০ টাকা। ৬ জনে ভাগ করে দেব। আমাদের পিকচার টিউব নড়বড়ে। স্কোরবোর্ডে একটা ডিজিট কম দেখায়। মনে মনে যোগ করে নিই। কতকিছুই তো মানুষ মনে মনে ধরে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়।

আমরা জানি ভারত জিতে গেলেও যেতে পারে আজ। আমরা জানি অস্ট্রেলিয়ার মুখচোখ। শচীন আছে। শচীন টেন্ডুলকার আমাদের জিতিয়ে দেবে ঠিক। কিংবা ‘একটুর জন্য কতকিছু হয়নি’! সন্ধ্যায় তোমার কমপ্ল্যান গুলে দিয়ে যাবে কাকিমা।

আমরা চা কিনে খেলে আড়চোখে দেখে বলবে ‘বেড়ে পাকা’, আমাদের লুকোনো সিগারেট আঙুলের ফাঁক থেকে গলে যাবে চটির তলায়। শচীনের ইনিংস তখন মাঝ আকাশে। প্যারাস্যুটের মতো ভাসছে দেশ। শচীন প্রাণপণে ভাসাচ্ছে রানরেট। ওর প্যাড আর গ্লাভস ফুলে উঠছে। দু হাঁটু হালকা ভেঙে আবার স্টান্সের জন্য চলে যাচ্ছে লেগস্টাম্পে।

তোমাদের স্কুলে কাল ইউনিট টেস্ট। আমাদের ফুটবল ম্যাচ। আজ পুরোটা দেখে ঘুমোব। শচীন ভানুমতীর খেল, আমি-তুমি ডুগডুগি হয়ে আছি টিভির সামনে। আউট হলেই অনেকে উঠে পড়বে। কালকের অফিসের জন্য ব্যাগ গুছোবে। তুমি চলে যাবে নতুন ফ্ল্যাটে।

আমাদের এই ছাদে একটা কাঠবেড়ালিও খেলা দেখছিল। ও দেখেছিল আমরা কেমন জাপটে ধরছিলাম কভার ড্রাইভ দেখে। আমাদের দুটো ভাড়া বাড়ির মাঝে ওয়াণ্ডারার্স। পেয়ারা গাছের ওপর রিল ক্যামেরা। শচীনের ইনিংস ভরে ফেলছে রিলে৷ এক দশক থেকে আরেক দশকে।

শচীন অসহ্য একঘেয়ে। শচীন ঠুলি পরা রাজমিস্ত্রী। প্রতিদিন একই ইঁটের ওপর ইঁট। টোস্টের ওপর জুস। নেটের ভেতর স্ট্রেট ড্রাইভ। শচীন টিভির ভেতর দেশ। তোমরা গণেশকে দুধ খাওয়ানোয় মতো সাবলীল হতে থাকো। আমাদের মিছিল পেরোতে থাকে গড়ের মাঠ। আমরা প্রেমপত্র লিখে বন্ধুকে কনুই দিয়ে গোঁতাই। তোমরা সিসিডির ভেতর ইন্সটা রিল, আমরা পল্টনদার কিশোরকুমার শুনি অনেক পথ হেঁটে। শচীনের খেলা শ্যামবাজার থেকে কালিঘাট অবধি লম্বা হয়ে যায়।

শচীন জানতেও পারে না ওর সামনে আমি তুমি একসাথে বসে থাকতাম অনেকদিন আগে।আমি বাজারের থলি নিয়ে বেরোই সকালে। আমি সি আর টি টিভির গায়ে কেবিলের জ্যাক নাড়িয়ে আলো কমাই। আমি তেরো টাকার অটোভাড়া নিয়ে বিদ্রোহ করি অফিসফেরত।

তোমার উবারের ফেয়ার সার্জ হয়ে যায় বৃষ্টি হলে। আমি শচীনের ডাক ইনিংস জমাই মানিব্যাগে, তুমি কুড়িয়ে নাও শারজাহ আর সেঞ্চুরিয়ান। মল্লিকবাজারের মোড় থেকে কেউ হাঁক দিয়ে জার্সি বেচে। ‘শচীন ১২০ টাকা, একদাম!’

উড়ছে টাকা। ঘুরছে চাকা। হারছে পাকিস্তান। তুমি লাফিয়ে উঠছ থেকে থেকে। আমাদের রিমোটও  ঘুরে গেছে বহুকাল। অথচ আমাদের জীবন শচীনের টেক্সটবই পড়ে। ভাস্কর বলেছিলেন ঘাস যেমন অল্প হাওয়ায় হেলে পড়ে শান্তিতে, আমি চাই সেই সহজ ফুরফুরে শান্তি। সেই অনাবিল শান্ত বিকেলে আমাদের হাওয়াই চটি উইকেট সাজেনা আর। আমাদের সমস্ত বল ওয়াইড হচ্ছে। তোমাদের গাড়ির কাচ ভাঙেনি বহুকাল। তোমাদের লুকিং গ্লাসে আমাদের ক্যাম্বিসের ছাপ।

তোমার ভ্যাকসিন হয়ে গেছে দু ডোজ। আমি পাইনি একটাও। আমি লাইন দিচ্ছি প্রতিদিন। অথচ আমরা শচীন দেখেছি ছেলেবেলায়। একসাথে। শচীন জানতে পারেনি কিছু। শচীন খেলছে৷ খেলেই চলেছে কতকাল। শচীন জানেনা তোমরা কত এসেনশিয়াল, আমরা নিছক ফাউ।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...