হোয়াট আ প্লেয়ার, হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল প্লেয়ার!

দুর্ধর্ষ অস্ট্রেলিয়ান বোলারদের আগুনে গতি এক মুহুর্তের জন্য যেন থমকে গেল আম্পায়ারের একটা ছোট্ট ঈশারায়। এক ঝটকায় পারস্য উপসাগরের তীরের ঐতিহাসিক শারজাহ স্টেডিয়ামকে স্তব্ধ করিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর আছড়ে পড়ল মরু ঝড়। তবে আসল ঝড়ের পূর্বাভাস হয়ত সেদিন অস্ট্রেলিয়ানরা তখনও টের পান নি।

সালটা ১৯৯৮, ২২ এপ্রিল। শারজাহ-স্টেডিয়ামে ভারত-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটি ভারতের কাছে সেদিন কার্যত ফাইনাল। ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচগুলি জেতার সৌজন্যে অজিরা ইতিমধ্যেই ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে ফেলেছে।

ভারত ও নিউজিল্যান্ডের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য একমাত্র মাপকাঠি ছিল এই ম্যাচ। ভারতের জয় অথবা দারুণ রান রেট শচীন-সৌরভের টিম ইন্ডিয়ার সামনে খুলে দিতে পারত ফাইনালের দরজা।

অজি ব্যাটসম্যানদের দাপটে ২৮৫ রানের পাঁচিল খাড়া করেছে ক্যাঙ্গারু-র দেশ,ভারতের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তৎকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বোলিং লাইন-আপ, নড়বড়ে ভারতীয় টিমের কাছে কাজটা হয়ে উঠছিল কার্যত অসম্ভব।

ম্যাচের বয়স তখন তিন ওভার, ভারতের জিততে গেলে ন্যুনতম ২৩৭ রান প্রয়োজন। এই সময়ই ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। শারজাহ-র মাটিতে আছড়ে পড়ল মরুঝড় যদিও ক্রিকেট দুনিয়া সেদিনই পেয়ে গিয়েছিল তাদের চিরকালীন আইকনকে, মরুঝড়ের প্রবল শক্তি আর অজি বোলারদের আগুনে বোলিংকে যিনি কার্যত একা হাতে ধ্বংস করে দিলেন – ভারত তথা বিশ্বক্রিকেটের বন্দিত সম্রাট শচীন রমেশ টেন্ডুলকার।

ভারতের ক্ষয়ে যেতে থাকা ব্যাটিং লাইন আপে ভিভিএস লক্ষ্মণকে সাথে নিয়ে শচীন শুরু করলেন তার সংহার। চার উইকেট হারিয়ে ভারত বেকায়দায়। মরুঝড়ের রেশ কাটেনি তখনও। ঠিক তখনই যেন সুর-তাল-ছন্দ-লয়ে বেঁধে রাখা রাগের মতোই লাল হরফের এমআরএফ ব্যাটটা সবুজ ঘাসে একের পর এক স্ট্রেট ড্রাইভ, কভার ড্রাইভ আর স্কোয়ার কাটের রংতুলি দিয়ে এঁকে দিল ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ নকশাখানা।

আসমুদ্র হিমাচল দেখল এক ছোট্ট খাট্টো চেহারার ক্রিকেটীয় ঈশ্বর ভেঙেচুড়ে দিচ্ছেন বিশ্বের তাবড় বোলারদের মেরুদণ্ড। ১৩১ বলে ১৪৩ রান করে ভারতকে সচিন পৌঁছে দিলেন টুর্নামেন্টের ফাইনালে।

পারস্য উপসাগরের হাওয়ায় ভেসে আসছে টনি গ্রেগের গলা তখন কাঁপছে। বলছেন, ‘হোয়াট আ প্লেয়ার, হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল প্লেয়ার!’

গেল দুই যুগে ক্রিকেট দুনিয়ায় ঘটে গেছে অজস্র ঘটনা। ২০১১-য় মহেন্দ্র সিং ধোনির হাত ধরে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ভারত পেয়েছে বিশ্বক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা-বিশ্বকাপ, শচীন স্বয়ং ভেঙে দিয়েছেন ব্যাটিং দুনিয়ার সমস্ত রেকর্ড।

তবু ক্রিকেট বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের কাছে শচীনের এই শারজাহ-র ইনিংসের গুরুত্ব অপরিসীম।ভারত হেরে গেলেও শচীনের ইনিংসটি আইসিসি’র বিচারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইনিংস হিসেবে উঠে আসে বারবার। ক্রিকেট শিক্ষার্থীদের গাইডলাইন হিসেবে দেখানো হয় ক্রিকেট ঈশ্বরের এই বিখ্যাত ম্যাচটি। ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার বিশেষজ্ঞরা বারে বারে এই ইনিংসকে বিশ্লেষণ করেছেন ‘দ্য মোস্ট পারফেক্ট ইনিংস’ নামে।

শুধু তো রান নয়, শচীন যেন শেন ওয়ার্ন, মাইকেল ক্যাসপ্রোভিচ, জেসন গিলেস্পি-দের বোলিং এর সামনে সেদিন মেলে ধরেছিলেন তার গগনচুম্বী প্রতিভাকে। বেটিং-ফিক্সিং-এ নুইয়ে থাকা ভারতীয় ক্রিকেট সেদিন যেন আন্দোলিত হয়েছিল এক বিপুল গর্জনে – ‘শচীন… শচীন…!’, বিশ্বের কাছে লিটিল মাস্টারের ইনিংসটি স্মরণীয় হয়ে থাকলো ‘মরুঝড়ের ইনিংস’ বা ‘ইনিংস অফ স্যান্ডস্টর্ম’ হিসেবেই।

ইতিহাস ফিরে আসে হয়তো, কিন্তু শচীন তেন্ডুলকররা ফিরে আসেন না। মরুঝড়ের ইনিংস ফিরে আসে না। ভারতীয় ক্রিকেট সরণিতে বহু কিংবদন্তী বহুবার তার ছাপ ফেলে গেছেনভ ইডেনে দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ, লর্ডসে সৌরভ গাঙ্গুলি আরও কত কে! তবু এখনও যেন ঝড়ের বুকে কান পাতলে শোনা যায় টনি গ্রেগের সেই বিখ্যাত কণ্ঠ – ‘হোয়াট আ প্লেয়ার, হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল প্লেয়ার!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link