ক্রিকেট পাড়ার সবচেয়ে মহাকাব্যিক দ্বৈরথের একটি শচীন-ওয়ার্ন। ক্রিকেট বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছেন দু’জনই। একজন ব্যাট হাতে, আরেকজন বল হাতে বনে গেছেন কিংবদন্তি। ওয়ার্নের লেগ স্পিন জাদুর কাছে নতজানু হয়েছে বিশ্বের বাঘা বাঘা ক্রিকেটার। ওয়ার্ন নামটাই ছিল ব্যাটারদের জন্য আতংক। সেই ওয়ার্নি কিনা যমদূতের মতন ভয় পেতেন শচীন টেন্ডুলকারকে! ভাবা যায়?
এক সময় ক্রিকেট দুনিয়ার বাঘা বাঘা ব্যাটারদের শাসন করলেও শচীন টেন্ডুলকারের বিপক্ষেই যেন মাঠের চূড়ান্ত লড়াইটা জিততে পারেননি শেন ওয়ার্ন। শচীন সম্পর্কে ওয়ার্ন বলেছিলেন, ‘শচীন স্বপ্নে এসেও ছক্কা মারতো।’ অবশ্য স্রেফ ওয়ার্ন বললে ভুলই হবে, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শচীন যেন হয়ে উঠতেন অপ্রতিরোধ্য! অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের উপর শচীনের আগ্রাসী রূপটার দেখা মিলতো হরহামেশাই।
ব্যতিক্রম ছিল না ১৯৯৮ সালের কোকাকোলা কাপেও। সেবার ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে শচীন খেলেছিলেন অনবদ্য এক ইনিংস। শচীনের সেই ইনিংসটিকে ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ইনিংস হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বোলিং লাইন আপ সেদিন পাত্তা পায়নি শচীন তাণ্ডবের সামনে। মাইকেল ক্যাসপ্রোইচ, ড্যামিয়েন মার্টিনদেরও সেদিন পাড়ার বোলারদের মত পিটিয়েছিলেন এই লিটল মাস্টার।
আরব আমিরাতের মাটিতে মরুঝড়টা নিতান্তই সাধারণ ব্যাপার। তবে ২৪ বছর আগে শারজাহতে একসাথে দেখা গিয়েছিল দুই ঝড়! শচীন ঝড়ের সামনে সেদিন শুরু হয়েও থমকে যায় মরু ঝড়। মরুর বুকে শচীন সেদিন ঝড় তুলেছিলেন ব্যাট নামক তরবারি হাতে। শাসন করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার তারকা বোলারদের।
২২ এপ্রিল, ১৯৯৮। শারজাহতে ত্রিদেশীয় সিরিজের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। অজিদের দেওয়া ২৮৫ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা ভারতের সামনে। মাইকেল বেভানের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি আর মার্ক ওয়াহর ৮১ রানের ইনিংসে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা দাঁড় করায় অজিরা।
লক্ষ্যমাত্রা ২৮৫ হলেও ফাইনালে পৌঁছাতে ভারতের দরকার ছিল ২৫৪ রানের। ড্যামিয়েন ফ্লেমিং, মাইকেল ক্যাসপ্রোইচ, শেন ওয়ার্ন, টম মুডিদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী বোলিং লাইন আপের সামনে ২৫৪ রানকেও মনে হচ্ছিল পাহাড়সম উঁচু।
চ্যালেঞ্জিং সমীকরণ মাথায় নিয়ে ব্যাট করতে নামেন সৌরভ গাঙ্গুলি ও শচীন টেন্ডুলকার। কানায় কানায় পূর্ণ ছিল শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়াম। বলতে গেলে তিল ধারণের জায়গাই নেই। ওপেনিং জুটিতে ৩৮ রান তুলতেই গাঙ্গুলির বিদায়। এরপর নয়ন মঙ্গিয়াকে নিয়ে একপ্রান্তে ঝড় তুলেন শচীন। দলীয় ১০৭ রানে ব্যক্তিগত ৩৫ রানে ফেরেন মঙ্গিয়া।
এরপর হঠাৎ করেই শারজাহর বুকে মরুঝড়। প্রায় ২০-২৫ মিনিটের মতন ধূলায় সব অন্ধকার। ঝড় থামার পর ভারতের সামনে নতুন সমীকরণ দাঁড়ায় ৪৬ ওভারে ২৭৬ রান। আর ফাইনালে যেতে হলে করতে হবে ২৩৭। মরুঝড় থেমে গিয়েও যেন থামেনি। দিয়ে গেছে এক নতুন ঝড়ের ইঙ্গিত। হ্যাঁ, শচীন ঝড়।
ফ্লেমিং, ওয়ার্ন, মুডি কেউই পাত্তা পায়নি শচীনের সামনে। অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর কোনো অস্ত্রই কাবু করতে পারছিল না শচীনকে। ক্যাসপ্রোইচকে পর পর দুই বলে মারা লং অন আর মিড উইকেটের উপরদিকে মারা ছক্কাগুলো আজও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে তাজা।
মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন, অজয় জাদেজারা ফিরেছেন দ্রুতই। ১৩৮ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে খাঁদের কিনারেও দাঁড়িয়ে ছিল দল। তবে শচীন ঝড় থামেনি। তিনি এসবের পরোয়াই করেননি। সেদিন যেন কিছু একটা পণ করেই নেমেছিলেন। না ম্যাচটা জেতাতে ঠিক পারেননি, কিন্তু ভারতকে তুলে দিয়েছিলেন ফাইনালে।
শচীনের মারা একেকটি ছক্কা আছড়ে পড়ছিল গ্যালারিতে। দর্শকদের উল্লাস আর হৈচৈতে পুরো শারজাহ যেন কেঁপে উঠছিল। সিঙ্গেল নিয়ে যখন ভারতের ফাইনাল নিশ্চিত করলেন পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে খুশির বাঁধভাঙ্গা উল্লাস।
১৩১ বলে ৫ ছক্কা ও ৯ চারে ১৪৩ রানের বিধ্বংসী ইনিংসে ভারতকে ফাইনালের দরজায় পৌঁছে দেন শচীন। দলীয় ২৪২ রানে শচীন যখন ফ্লেমিংয়ের শিকার হলেন ভারত ততক্ষণে ফাইনালে। অবশ্য স্পোর্টসম্যানশিপের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনও করেছিলেন শচীন।
মার্টিনের বলটা অফ সাইডে চেপে খেলতে গিয়ে ব্যাট লেগে উইকেটরক্ষক অ্যাডাম গিলক্রিস্টের গ্লাভসে। অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডাররা উদযাপনে মেতে উঠলেও তাদের আবেদনে কর্ণপাত করেননি আম্পায়ার। গিলক্রিস্ট, মার্টিনরা যখন হতাশ চেহারায় তাঁকিয়ে আছে আম্পায়ারের দিকে; ব্যাট বগলদাবা করে ড্রেসিং রুমের দিকে হাঁটা দেন শচীন।
খুব সম্ভবত ২০ বলে ৩২ রান প্রয়োজন ছিল ভারতের। শচীন চাইলেই খেলে যেতে পারতেন। কিন্তু ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেট তত্ত্বটা প্রমাণ করে বড় বড় পা ফেলে হেঁটে চলে গেলেন মাঠের বাইরে। এরপর ভারতের হালটা কেউ ধরতে পারেনি। শচীন শুরু করেছিলেন, শচীনই যেন শেষ করে বিদায় নিয়েছেন।
শচীনের একক দাপটে ৪৬ ওভারে ৫ উইকেটে ২৫০ রান সংগ্রহ করে ভারত। ২৬ রানে ম্যাচ হারলেও শচীনের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ফর্মের তুঙ্গে থাকা ওয়ার্ন সেই ম্যাচে ৯ ওভারে ৩৯ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শূন্য।
দু’দিন বাদেই ছিল শচীনের জন্মদিন। শারজাহতে ফাইনালে নিজের জন্মদিনে আরেকটি বিধ্বংসী ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলেন শিরোপা। শচীনের ব্যাটের কম্পনে মরুর ঝড়ও যেন কোথায় মিলিয়ে গিয়েছিল সেদিন। ওই ফাইনালেও ওয়ার্নকে বেধরক মার মেরেছিলেন টেন্ডুলকার। ১৩১ বলে ১৩৪ রানের ইনিংসে ৬ উইকেটের জয়ে ভারতকে শিরোপা জেতান শচীন।