সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান বাছতে বসলে একটি যুক্তি সর্বদা দেয়া হয়, ‘দুটি আলাদা প্রজন্মের তুলনা চলতে পারে না।’ তা যুক্তিটা অকাট্য। কিন্তু ক্রিকেট রোমান্টিকের মন তা মানে না। সে মনে মনে ভাবে, শচীন টেন্ডুলকার যদি ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টসদের পেতেন, তাহলে কি একই গড় ধরে রাখতে পারতেন?
বা ভিভ রিচার্ডস যদি বডিলাইন সিরিজে খেলতেন, তাহলে ইয়ান বোথাম-বব উইলিস দের মতো ভোস বা লারউডকেও কি চুইং গামের মতো ছিবড়ে করে ফেলতেন? ডন যদি আজ খেলতেন তাহলে তাঁর গড় কত হতো? এইরকমই কিছু ক্রিকেট ফ্যান্টাসির ডালা খুলে বসলাম এই সিরিজে। আজ প্রথম পর্বে থাকবে শচীন বনাম মার্শাল-রবার্টস-হোল্ডিং-গার্নার মানে ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারি।
এই মর্মে প্রথমেই যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হবো, তা হলো কোন সময়ের শচীন নিয়ে কারবার করবো? আসলে শচীন নামক বিস্ময়ের ক্রিকেটীয় ক্যানভাস এতটাই বড়ো, যে তুলির আঁচড় কোথা থেকে শুরু করবো ভাবতে ভাবতেই দিন কাবার হয়ে যায়। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ এর শচীন অসীম প্রতিভার অধিকারী। তবে বড়ো রান সেই সময় খুব একটা পেতেন না শচীন।
আক্রমণাত্মক শতরান বা আকর্ষণীয় ৫০, এই ধরণের ইনিংস খেলতেই তাঁকে বেশি দেখা যেত। প্রতিভার ঝলকানি সেইসময়তেও বহুবার দেখা গেছে, যেমন ১৯৯২ এর পার্থ, ১৯৯২ এর জোহানেসবার্গ বা ১৯৯০ এর ম্যানচেস্টার। কিন্তু সেগুলো ক্ষণস্থায়ী। বেশিরভাগ সময়ই দর্শককুলকে হতাশ করে আউট হতেন লিটল মাস্টার।
১৯৯৪ পরবর্তী, দীর্ঘ সময় দলের ব্যাটিংয়ের একমাত্র ভরসা ছিলেন শচীন। এরপর ১৯৯৬ তে সৌরভ-দ্রাবিড় আসার পর চাপমুক্ত মনে আবার খেলা শুরু করেন তিনি। মধ্যিখানের এই বছর দুয়েক সচিনকে স্বমহিমায় বিশেষ দেখা যায়নি। বিশেষত টেস্ট ক্রিকেটে। তবুও ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অনুপম ৯০, এবং শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ইডেনের খোঁয়াড়ে ৬৫ ছিল।
কিন্তু, সেইসময় মনে হতো যেন খুব বেশি চাপ নিয়ে ফেলছেন সাড়ে পাঁচ ফুটের মারাঠি। ১৯৯৬ এ ইংল্যান্ড সফরে চাপমুক্ত সচিন কিন্তু রানের ফুলঝুড়ি ছুটিয়েছিলেন। কিন্তু বছরের শেষে তাঁর কাঁধে এসে পড়ে (অবাঞ্চিত?) অধিনায়কত্বের চাপ। এইসময়টাও শচীন স্বমহিমায় বিরাজ করেননি। ভারতীয় ক্রিকেটের টালমাটাল সময়ে (১৯৯৬ থেকে ২০০০) সচিন বিক্ষিপ্ত ভাবে (১৯৯৮) নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেছেন। সার্বিকভাবে নয়। লারা বা স্টিভ ওয়া সেই সময় অনেক বেশি ধারাবাহিক।
বরং ২০০১ থেকে ২০০৪-এই সময়টা শচীন নিজের হৃতগরিমা আবার পুনরুদ্ধার করেন। এই সময়টা বিভিন্ন ধরনের ইনিংস এসেছে সচিনের ব্যাট থেকে। তীব্র আক্রমণাত্মক (ব্লুমফন্টেন ২০০১), অসম্ভব সংযমী (সিডনি ২০০৪) বা চাপের মুখে ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস (২০০২ ইডেন)-এই সময়টা সবই পেয়েছি আমরা শচীনের থেকে। ২০০৪ থেকে ২০০৬ অব্দি অবশ্য চ্যাপেল এবং টেনিস-এলবোর যৌথ আক্রমণে বিদ্ধস্ত যে লোকটাকে আমরা ব্যাট করতে দেখেছি তিনি সচিন নন, তাঁর ছায়া মাত্র।
আমার মূল্যায়নে ওয়েস্ট-ইন্ডিজের চতুর্বর্গকে খেলার জন্যে আমি যে সচিনকে বেছে নেবো, তিনি ২০০৭ বিশ্বকাপ পরবর্তী সচিন। ২০০৭ থেকে ২০১১-এই সময়টা শচীন অসম্ভব ফিট ছিলেন, বড়ো রান করার ক্ষিদেটা এই সময়ে যেন বেশি করে প্রকট হয়। ওয়ানডেতে এইসময় বিনা রানারে বিশাল বড়ো বড়ো ইনিংস খেলেন সচিন। কলম্বোতে ১৩৮, গোয়ালিয়রে ২০০, হায়দরাবাদে অজি পিটিয়ে ১৭৫, ক্রাইস্টচার্চে ১৬০-ইত্যাদি ইনিংস গুলো এই সময়টাতেই খেলা।
টেস্টেও এই সময় তিনি যাকে পেয়েছেন, তার বিরুদ্ধে রান করেছেন। চেন্নাইয়ের গরমে চতুর্থ ইনিংসে ঐরকম খেলা, ২০০৭-০৮ এর মহাবিতর্কিত অস্ট্রেলিয়া সফর বা ২০০৭ এর ইংল্যান্ড সফর-সবেতেই ধারাবাহিক ছিলেন তিনি। ২০১০ এর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে স্টেইন-মরকেল পিটিয়ে যে দুটি সেঞ্চুরি তিনি করেছিলেন, সেই দুটি একমাত্র তিনিই পারেন।
এ তো গেলো কোন সময়ের শচীন নিয়ে আমরা ভাবছি তার কচকচি। এবার দেখা নেয়া যাক, তাঁর ২৪ বছরের ক্রিকেট জীবনে সর্বোচ্চ পর্যায়ের পেস বোলারদের কেমন খেলেছেন তিনি। ওয়াসিম-ওয়াকার-ইমরানের ত্রিফলার বিরুদ্ধে সচিনের গড় (৩৫) এমন আহামরি কিছু না। কিন্তু এই তিন মহীরুহকে যখন একত্রে খেলেছেন তিনি, তখন তাঁর বয়েস মাত্র ১৬।
কিন্তু, ওয়াসিম আকরাম-শোয়েব আখতারদের বিরুদ্ধে এর দশ বছর পর ঘরের মাঠেও বিশাল কিছু প্রভাব কিন্তু সচিন বিস্তার করেননি। চেন্নাইয়ের ১৩৬ বাদ দিলে সেরকম কিছু পড়ে থাকেনা সেই সিরিজেও। ম্যাকগ্রার বিরুদ্ধে সচিনের গড় বেশ ভালো। ১৯৯৯ এর অস্ট্রেলিয়া সফরে ৪৬ গড় ছিল তাঁর। ডোনাল্ড-পোলককে একত্রে খেলে অবশ্য তেমন সুবিধা করতে পারেননি তিনি।
এই দুজনের বিরুদ্ধে তাঁর গড় মাত্র ৩৮.৭০। আম্ব্রোসের বিরুদ্ধে তিনি খেলেছেন একটাই সিরিজ। ১৯৯৭ এর সেই অভিশপ্ত সফরে, বার্বাডোজ ছাড়া বাকি সব ম্যাচেই পিচ ছিল মন্থর গতির। কাজেই এতো কম স্যাম্পেল স্পেসে ৫৭.৮৯ এর গড়, বিশাল কিছু প্রমান করে না।
এবারে ভাবুন জ্যামাইকার ‘ফুটন্ত কড়াইয়ে’ বোলিং মার্কে দাঁড়িয়ে ম্যালকম মার্শাল। বল ৮ ওভার পুরোনো। ভারত ২০ রানে ২ উইকেট। ৪ স্লিপ, ১ গালি, ১ শর্টলেগ। শচীন ২০০৭ পরবর্তী ব্যাকলিফট অনেক কমিয়ে ফেলেছিলেন। মার্শালের বল পিচে পড়ে যে একটু স্কিড করে আসতো, সেই সমস্যাটার মোকাবিলা করার জন্যে সচিন তৈরি। আন্দাজ করছি, মার্শালের মতো ধূর্ত বোলার অযথা শর্ট বল করে শচীনকে সেট হয়ে যাবার বিশেষ সুযোগ দেবেন না। কারণ এই পর্যায়ে সচিন পুল-হুক নিজের তুনে সযত্নে তুলে রেখেছিলেন।
শর্ট বল ছেড়ে দেয়াটাই তাঁর দস্তুর ছিল সেই সময়ে। গুড-লেন্থের কয়েক ইঞ্চি আগে মার্শাল বল ফেলবেন। বিশ্বস্ত ব্যাকফুট ডিফেন্স ইনিংসের শুরুর দিকে শচীনের ভরসা হবে। ২০০৭ পরবর্তী শচীন একটা শট খুব খেলতেন-গালি এবং পয়েন্টের মাঝামাঝি জমি ঘেঁষে ‘গাইড’। এই শট টি খেলে বহু রান পেয়েছেন তিনি। কিন্তু ৪ স্লিপ এবং ১ গালি থাকায় এই শটটি এতো সহজে খেলতে পারবেন না তিনি।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, মার্শাল নয়, চার পেসারের মধ্যে শচীনকে সবচেয়ে বেশি বেগ দেবেন রবার্টস। ক্রিজের ব্যবহার, দুই রকমের বাউন্সার এবং তীব্র গতি-এই তিন মিলিয়ে রবার্টস কিন্তু সচিনকে পেড়ে ফেলতে পারেন। শচিন-বনাম রবার্টস ডুয়েল সবচেয়ে মনোগ্রাহী হবে বলে মনে হয়। শচীন কিন্তু রবার্টসকে মেরে খেলতে চাইবেন, যাতে তিনি শচীনের মাথায় চেপে বসতে না পারেন।
গার্নারকে স্বচ্ছন্দে খেলে দেবেন শচীন। গার্নারের বিরুদ্ধে তাঁর মোলাকাত হবে দাবার ভাষায় স্টেলমেট। গার্নার অত্যন্ত কৃপণ বোলিং করবেন, একই লেন্থ এবং অফ স্টাম্প লাইনে। তিনি গার্নারকে ক্রমাগত ব্যাকফুটে খেলে যাবেন। এবং একেবারে টপ-অব-অফ না হলে ছেড়ে দেয়াই শ্রেয় মনে করবেন। হোল্ডিং কিছুটা মার্শাল ঘরানার বোলার। তীব্র গতিতে স্কিড্ করে ব্যাটে আসবে।
ইনিংসের প্রথম দিকে পায়ের নড়াচড়া একটু শ্লথ হলেই তাঁর বিদায় ঘন্টা বেজে যেতে পারে। হোল্ডিং বা মার্শালের বলে বোল্ড বা এলবিডব্লিউ হয়ে। সেই সময়টা কাটিয়ে দিতে পারলে সচিন বড়ো ইনিংস খেলে দিতে পারেন। কারণ এই চার বোলারের কেউই রিভার্স-সুইংয়ের সাথে খুব পরিচিত নন।
চূড়ান্ত রায় – শচীন ৬৫। আক্রমণাত্মক ইনিংস। মার্শাল বা হোল্ডিং বেশ কয়েকবার ইনসাইড এজ বিট করেছেন। রোবর্টসকে খুব স্বচ্ছন্দে খেলেছেন। মার্শালকে অন ড্রাইভ মেরেছেন। শেষমেশ রবার্টসের বলে গালিতে ক্যাচ দিয়ে আউট।
রবার্টস আগের বলটা ওয়াইড অফ দি ক্রিজ করেছেন শর্ট অফ লেন্থে। কিন্তু নমনীয় গতিতে। শচীন ব্যাকফুট ডিফেন্স করেছেন মিড্-ব্যাট দিয়ে। পরের বলটা একই জায়গা থেকে করা শুধু কয়েক গজ জোর। শচীন ব্যাকফুটে ডিফেন্সই করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গতির তীব্রতা শেষ মুহূর্তে বোঝেন। গ্লাভস ঠিক সময় নামাতে না পেরে গালির হাতে জমা দিয়ে ফিরে যান।
এ সবই আমার কল্পনাপ্রসূত। এর সাথে সত্যের মিল পাওয়া গেলে তা একান্তই কাকতালীয়।