১৯৮১ সালের শুরুর সময়। তাসমান সাগরের তীরে অজি মুলুকে সেবার মুখোমুখি ভারত-অস্ট্রেলিয়া। ভারত তখনো ঠিক বড় দল হয়ে উঠতে পারেনি। মেলবোর্নে প্রথম টেস্টটাও হেরেছে বাজেভাবেই। দ্বিতীয় টেস্টে অ্যাডিলেডে তাই সম্মান বাঁচানোর লড়াই ভারতীয়দের। কিন্তু কিম হিউজের দ্বিশতক আর গ্রাহেম উডের শতকে অজিদের বিশাল সংগ্রহের নিচে চাপা পড়ে তাঁরা।
অজিদের হয়ে বিশ্বজুড়ে তখন ত্রাস ছড়াচ্ছেন ডেনিস লিলি, রডনি হগ, ব্রুস ইয়ার্ডলি, লেন প্যাসকোরা। দেড়শ পেরোনোর আগেই ভারত হারালো চার উইকেট। লিলিদের চোখমুখে তখন ভারতের লেজগুটিয়ে ইনিংস ব্যবধানে ম্যাচ জয়ের স্বপ্ন। এমন সময় ব্যাট করতে নামলেন ২৪ বছরের এক ভারতীয় যুবা, বছরখানেক যাবত দলের সাথে থাকলেও যে কিনা জায়গা পাকা করতে পারেনি।
কিন্তু সেদিন লিলি কিংবা হগ কেউই পাত্তা পায়নি তাঁর কাছে, কখনো দারুণ সব কাভার ড্রাইভ আবার কখনো চমৎকার সব পুল শটে বল সীমানাছাড়া করেছেন। দলীয় ৩৯৯ রানের সময় যখন আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন ততক্ষণে কেটে গেছে ঘোর অমানিশা, পুরো অ্যাডিলেড ফেটে পড়ছে হাততালির শব্দে। ২৪০ বলে ২২ চার এবং এক ছয়ে ১৭৪ রানের ইনিংসের পুরোটা সময় দর্শকদের যেন মোহাবিষ্ট করে রেখেছিলেন। সেদিনের তরুণ ভারতোয় যুবাটি ছিলেন সন্দীপ পাতিল, ভারতের মিডল অর্ডারের আস্থার প্রতীক। শুধু ইনিংস না দর্শকদেরও টানতে জানতেন তিনি।
১৯৫৬ সালে মুম্বাইতে জন্ম সন্দীপ পাতিলের। তিনি যে ক্রীড়াবিদর হবেন এটা বোধহয় ছোটবেলাতেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। প্রথমত তার বাবা-মা উভয়েই ছিলেন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়, একত্রে জুটি বেঁধে মিক্সড ডাবলসে জাতীয় পর্যায়ে পদকও আছে তাদের।
এছাড়া তার বাবা মধুসূদন বোম্বের হয়ে ছয়টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচও খেলেছেন। দ্বিতীয়ত তার জন্ম এবং বেড়ে উঠা শিবাজি পার্ক স্ট্রিটে। যেখানকার অলিতেগলিতে খেলেই বড় হয়েছেন সুভাষ গুপ্তে, বিজয় মার্চেন্ট, বিজয় মাঞ্জেরেকার, রমাকান্ত দেশাই, অজিত ওয়াদেকারের মতো ক্রিকেটাররা। দেখার বিষয় ছিল পাতিল কাকে বেছে নেন, বাবা-মার ব্যাডমিন্টন নাকি পাড়ার দাদাদের ক্রিকেট। শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন ক্রিকেট, ভাগ্যিস ক্রিকেটই নিয়েছিলেন নইলে কি আর ভারত পেত মিডল অর্ডারে নির্ভরতার প্রতীক।
১৯৭৮-৭৯ মৌসুমে ঘরোয়া ক্রিকেটে বিধ্বংসী ব্যাটিং করে হইচই ফেলে দেন পাতিল। সে মৌসুমে তিনি ১০২ টি ছয় হাঁকান। এরমাঝে পার্সি জিমখানার বিপক্ষে এক ম্যাচেই হাঁকান ২১ ছয়। একটি ছয় নাকি এতই বড় ছিল, সোজা গিয়ে পড়েছিল আরব সাগরে। এছাড়াও সৌরাষ্ট্রের বিপক্ষে ম্যাচে ২১০ রানের ইনিংস খেলার পথে ছক্কা মেরে পাশের হকি স্টেডিয়ামে বল পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কেবল ব্যাটিং নয়, ডানহাতে দারুণ মিডিয়াম পেস বল করতেন তিনি।
১৯৮০ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্থানের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে তার। যদিও অভিষেকে তেমন আলো ছড়াতে পারেননি। তিনি নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন পরের বছরের অস্ট্রেলিয়া সফরে। সেবার ৬২.২০ গড়ে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩১১ রান করেন। তার স্ট্রাইক রেট ছিল প্রায় ৭৮, যেটা সে সময়ে প্রায় অকল্পনীয়। ম্যানচেস্টারে একবার বব উইলিসের এক ওভারে ছয়টা চার মেরেছিলেন। সে ম্যাচে অপরাজিত ১২৯ রান করে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন তিনি।
তিনি মারাত্নক মারকুটে ব্যাটসম্যান ছিলেন। নিজের দিনে ছাড় দেননি প্রতিপক্ষের কোনো বোলারকে। ১৯৮৩ সালে গর্ভনর একাদশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি তুলে নেন লাঞ্চের আগেই, মাত্র দুই ঘন্টায়। ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী ভারতীয় ক্রিকেট দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন তিনি। মাত্র ছয় বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ২৯ টেস্টে প্রায় ৩৭ গড়ে করেছেন ১,৫৮৮ রান। একদিনের ক্রিকেটেও তার রেকর্ড নেহাত মন্দ নয়, ৪৬ ম্যাচে করেছেন ১,০০৫ রান। এছাড়া বল হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়েছেন ৮৬ উইকেট।
ভালো খেলার পাশাপাশি নেতৃত্বগুণ এবং খেলাটাকে ভালো বুঝতে পারার ক্ষমটা ছিল পাতিলের। মুম্বাইকে নেতৃত্ব রঞ্জি জিতিয়েছেন খেলোয়াড়ি জীবনে। অবসরের পর কোচিং পেশায় নিযুক্ত হন তিনি। তার অধীনেই ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলে কেনিয়া।
বহুগুণের অধিকারী পাতিল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন বলিউডেও, অভিনয় করেছিলেন ‘কাভি আজনাবি’ নামের এক সিনেমায়। ২০১২ সালে ভারতীয় ক্রিকেট দলের নির্বাচক হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। এখনো বহাল আছেন সেই পদেই। নিজে বিশ্বকাপ জিতেছেন, বহুবার ভারতকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন এখন খুঁজে ফেরেন ভারতের ভবিষ্যত তারকাদের।