সাঞ্জু ‘দ্য সুপারম্যান’ স্যামসন

সুপারম্যান আখ্যা পাওয়া এই তরুণ ক্রিকেটার ইতোমধ্যেই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের শৈল্পিক ব্যাটিং আর উইকেটকিপিং দেখিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। অল্প বয়সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন অধিনায়কত্বের। সব মিলিয়ে অপেক্ষা এখন জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা পাঁকা করার পথেই আছেন তিনি।

ছোট কাঁধের বড় ব্যাটসম্যান সাঞ্জু স্যামসনকে তার উইকেটকিপিং আর ফিল্ডিংয়ের জন্য সুপারম্যানও ডাকা হয়। একটা সময় ছিলো যখন মহেন্দ্র ধোনির অবসরের পর যে কয়জন খেলোয়াড়ের নাম নির্বাচকদের বিবেচনায় ছিলো এর মধ্যে একজন ছিলেন সাঞ্জু স্যামসন।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) ২০২১ সালের এবারের আসরে তাকে রাজস্থান রয়েলসের অধিনায়ক করা হয় আর পাঞ্জাবের বিপক্ষে অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচেই করেন সেঞ্চুরি। আইপিএলে একটা সময় তিনি সবচেয়ে কম বয়সী ফিফটি করা খেলোয়াড় ছিলেন। ২০১৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই এই কৃর্তী করেন তিনি।

যুব অবস্থায় নিজের খেলা দিয়ে সবার নজর কেড়েছেন এমন একজন হলেন সাঞ্জু স্যামসন। তার পুরো নাম সাঞ্জু বিশ্বনাথ স্যামসন। ১৯৯৪ সালের ১১ নভেম্বর ভারতের কেরাল রাজ্যের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হয় সাঞ্জু স্যামসনের। তার পিতার নাম বিশ্বনাথ স্যামসন ও মায়ের নাম লিলি স্যামসন।

সাঞ্জুর বাবা ছিলেন দিল্লী পুলিশের একজন কন্সটেবল। যার কারণে সাঞ্জুর প্রথম দিকের পড়াশোনা দিল্লীতেই হয়৷ তার বাবার সাপোর্টের কারণেই তিনি আজ এতোদূর আসতে পেরেছেন। সাঞ্জুকে ক্রিকেটার বানাতে তার বাবা এক পর্যায়ে চাকুরিও ছেড়ে দেন। সাঞ্জুর ভাই স্যালি স্যামসনও ক্রিকেট খেলতেন।

কিছুদিন পর তার পরিবার কেরালে চলে আসেন। সেখানে হাই স্কুল জীবনের পড়াশোনা শুরু করেন সাঞ্জু। স্কুলে থাকাকালীনই তিনি ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই কেরালের অনূর্ধ্ব-১৩ দলে সুযোগ পান সাঞ্জু৷ অনূর্ধ্ব-১৩ দলের নিজের খেলা প্রথম ম্যাচেই তিনি সেঞ্চুরি হাঁকান।

শুধু তাই নয় তার খেলা প্রথম পাঁচ ম্যাচের চার টিতেই সেঞ্চুরি করেন তিনি। তার পারফরম্যান্স দেখার পর তাকে অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কেরাল রাজ্যর অধিনায়ক বানানো হয়৷ অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে গোয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে ১৩৮ বলে অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।

এরপর ২০১২ ও ১৩ সালে দুই মৌসুমেই ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ দলে সুযোগ পান তিনি। দুই মৌসুমেই চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত৷ ২০১৩ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে সাঞ্জু স্যামসন সেঞ্চুরি করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন।

তাঁর দূর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখার পর তাকে ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও সুযোগ দেয়া হয়। সেবার অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তিনি ভারতের পক্ষে সবচেয়ে বেশি রান করেন। ২০১১ সালে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক করা সাঞ্জু ২০১৫ সালের রঞ্জি ট্রফিতে কেরাল দলের অধিনায়ক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। এর মাধ্যমে রঞ্জি ট্রফির ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী অধিনায়ক হন তিনি।

২০১৬-১৭ রঞ্জি ট্রফিতে তিনি দূর্দান্ত পারফরম্যান্স করেন। ওই মৌসুমে ৭ ম্যাচে তিনি ৬২৭ রান করে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি রান সংগ্রাহকও হন। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বোর্ড প্রেসিডেন্ট ইলেভেনের অধিনায়ক বানানো হয় তাকে৷ ২০১৯-২০ বিজয় হাজারে ট্রফিতে সাঞ্জু স্যামসন কেরালের হয় গোয়ার বিপক্ষে ১২৯ বলে ২২২ রানের এক দূর্দান্ত ইনিংস উপহার দেন। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে যা কিনা লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।

২০১২ সালে তাকে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) কলকাতা নাইট রাইডার্স দল কিনে নেয়। কিন্তু সেবার তিনি এক ম্যাচেও খেলার সুযোগ পাননি। এরপর ২০১৩ সালের আইপিএলের নিলামে রাজস্থান রয়েলস তাকে কিনে নেয়। ৪ই এপ্রিল ২০১৩ – কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলেন তিনি৷

যেখানে তিনি নিজের ব্যাটিং আর উইকেটকিপিং দিয়ে সবার নজর কাড়েন। পরের ম্যাচেই ব্যাঙ্গালুরুর বিপক্ষে ৪২ বলে ৬৩ রানের ইনিংস খেলে দলের জয়ের সাথে সাথে ম্যাচ সেরার পুরষ্কারও জেতেন তিনি। ২০১৫ সালে রাজস্থান রয়েলস ৪ কোটি রুপিতে তাকে আবারো দলে রেখে দেয়৷

২০১৬ সালে রাজস্থান রয়েলস ফিক্সিং কাণ্ডে আইপিএলে না থাকায় স্যামসনকে নিলাম থেকে কিনে নেয় দিল্লী ডেয়ারডেভিলস। সেই মৌসুমে দিল্লীর হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে পুনের বিপক্ষে নিজের প্রথম আইপিএল সেঞ্চুরি করেন স্যামসন। এরপর ২০১৮ সালে আইপিএলে ফিরে তাকে পুনরায় ৮ কোটি রুপিতে কিনে নেয় রাজস্থান রয়্যালস।

এখন পর্যন্ত আইপিএলে তিনি তিনটি সেঞ্চুরি করেছেন। ২০১৭ সালে রাইজিং পুনে সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে প্রথম, ২০১৯ সালে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের বিপক্ষে দ্বিতীয় ও সবশেষ এবারের আসরের আইপিএলে প্রথম ম্যাচে পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে নিজের তৃতীয় সেঞ্চুরি করেন৷

অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক ম্যাচেই সাঞ্জু শতক গড়েছেন যা ধোনি, রোহিত কিংবা কোহলি, গম্ভিররা কেউই করতে পারেননি। সাঞ্জু স্যমসন আইপিএলে এখন পর্যন্ত ১০৮ ম্যাচ খেলে ২৮ গড়ে ১৩৫ স্ট্রাইক রেটে ২৭০৩ রান করেছেন, যেখানে আছে তিন সেঞ্চুরি ও ১৩টি হাফ সেঞ্চুরি৷

২০১৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ওয়ানডে ও ১ টি-টোয়েন্টির জন্য সাঞ্জু স্যামসনকে জাতীয় দলের স্কোয়াডে রাখা হয়। তবে সে আসরে তিনি এক ম্যাচেও খেলার সুযোগ পাননি। ২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আম্বাতি রায়ডুর বিকল্প হিসেবে তাকে স্কোয়াডে নেওয়া হলেও, এক ম্যাচেও সুযোগ পাননি তিনি। এরপর একই সিরিজের দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতে নিজের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে অভিষেক করেন তিনি। এরপর পুনরায় জাতীয় দলে ফিরতে তার সময় লাগে ৫ বছর! ২০২০ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে তিনি পুনরায় জাতীয় দলের একাদশে সুযোগ পান।

অধিনায়ক হিসেবে আইপিএল খেলা নিজের প্রথম ম্যাচে টস করা কয়েনটি স্মৃতি হিসেবে রেখে দেন তিনি। সাঞ্জু স্যামসন, রিশভ প্যান্ত, ইশান কিষান, কামলেশ নাগরকটি, শ্রেয়াস আইয়ার এই সবার মধ্যে একটা কমন ব্যাপারে হলো – রাহুল দ্রাবিড়! হ্যাঁ ভারতের ‘দ্য ওয়াল’ খ্যাত রাহুল দ্রাবিড়ই অন্যতম কারণ এই নামগুলো এতো পরিচিতি পাবার পেছনে। এদের সবাই তাদের ক্যারিয়ারের একটা সময় রাহুল দ্রাবিড়ের কাছে কোচিং করেছেন।

সাঞ্জু স্যামসনের প্রেমিকার নাম ছিলো চারুলতা গোমেজ। ২০১৮ সালে তাঁদের বিয়ে হয়। দুইজনই তাদের কলেজ জীবনে একসাথে পড়াশোনা করেছেন। দীর্ঘদিন প্রেম করার পর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০১৩ সালে প্রথমবার কোনো এক রাতে ১১ টা ১১ মিনিটে চারুকে ‘হাই’ মেসেজ পাঠান স্যামসন। এরপর চারুর সাথে নিজের প্রথম ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে ৫ বছর অপেক্ষা করেন স্যামসন।

সুপারম্যান আখ্যা পাওয়া এই তরুণ ক্রিকেটার ইতোমধ্যেই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের শৈল্পিক ব্যাটিং আর উইকেটকিপিং দেখিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। অল্প বয়সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন অধিনায়কত্বের। সব মিলিয়ে অপেক্ষা এখন জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা পাঁকা করার পথেই আছেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...