নটরডেম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

| সালমা আঞ্জুম লতা, অ্যারিজোনা থেকে |

২০০৩ সাল। এইচএসসি পরীক্ষার আর কয়েক মাস বাকি। শ্রীলঙ্কা সফরের জন্য যখন আমার ছেলে শাহরিয়ার নাফীস সিলেক্ট হলো, আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কি করবো? কলেজ থেকে কিভাবে পারমিশন নিবো? দেড় মাস ক্লাশ না করলে ওরই বা কি হবে?

একটা অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে সোজা চলে গেলাম ওর কলেজে। অ্যাপ্লিকেশন এর সাথে আমাকে অনেক অনুনয় বিনয়ও করতে হলো। এর আগেও একবার সেন্ট যোসেফ স্কুলে এমনটা করতে হয়েছিল। অনূর্ধ-১৫ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে যখন মালয়েশিয়া গিয়েছিল। একই অবস্থা এবারও। তবে এবার একটা সুবিধা ছিল ততদিনে ওকে টিচাররা চিনতে শুরু করেছেন।

পেপারে মাঝেমধ্যেই ছবি, ইন্টারভিউ আসতো। শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি পাওয়া গেলো। শ্রীলঙ্কা থেকে আসার দুই আড়াই মাস পড়েই ওর ফাইনাল পরীক্ষা হয়েছিল। যেদিন ওর রেজাল্ট বেরুবে আমি ওর সাথে কলেজে গিয়েছিলাম। খুব টেনশন হচ্ছিল। সম্ভবত বেলা চারটার দিকে রেজাল্ট পেলাম।

মায়ের সাথে ছোট্ট নাফীস

বানিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ ৪.৪০ পেয়েছিল। ওদের সময় (ব্যাচ ২০০৩) চতুর্থ বিষয় যোগ হয়নি। ওর রেজাল্ট পেয়ে আমি খুব খুশি হলাম। সেদিনই পাকিস্তান ট্যুরের জন্য টিম ঘোষনা করার কথা। কলেজ থেকে জাতীয় স্টেডিয়ামে গিয়ে শুনলাম আবীর ১৫ জনের দলে আছে। খুশীর এই খবরটি আমাকে দিয়েছিল জাভেদ ইসলাম তাপশ। একই দিনে দু’দুটো সুসংবাদ নিয়ে সেদিন বাসায় ফিরেছিলাম।

গতকাল আমার ইনবক্সে মো: জাহিদ হাসান বাপ্পি আমাকে একটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিটা ২০০৪ সালের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজনেস ফ্যাকাল্টির করিডোরে। আবীরের পাশে একজন চা বিক্রেতা। ছবিটা সেসময় পত্রিকায়ও এসেছিল। অনেকক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখলাম।

দেখতে দেখতে আমি ফিরে গেলাম আজ থেকে ১৭ বছর আগে। ২০০৩ সাল। বড় ছেলে শাহরিয়ার নটরডেম কলেজ থেকে কেবল এইচএসসি পাশ করেছে। ওকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার খুব ইচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেই তো হবেনা। ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাশ তো করতে হবে। সেজন্য রেজাল্টের কিছুদিন পরেই খোঁজ খবর নিয়ে কোচিংয়ে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

কলেজের বন্ধুদের সাথে নাফীস

যাতাযাত সুবিধার জন্য ইউসিসি’র ফার্মগেট শাখায় ভর্তি করালাম। কোচিংয়ে ভর্তি হবার পরপরই চলে গেলো বিকেএসপিতে। একটা দীর্ঘমেয়াদী ক্যাম্প ছিল। সেখান থেকে ফিরে আসার কিছুদিনের মধ্যেই ওর ভর্তি পরীক্ষা হলো। ইউসিসিতে ৩০০০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়ে মাত্র তিন দিন ক্লাশ করেছে।

ওই সময়টায় শুধু দাঁতে দাঁত চেপে থাকতাম। আর আল্লাহর কাছে বলতাম আল্লাহ তুমি কি না করতে পারো। ছেলে তো মোটেই সিরিয়াস না। কি হবে? ওকে বলতাম, ‘যত যাই বলো, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কিন্তু আমি তোমাকে পড়াতে পারবোনা। সেই সাধ্য আমার নেই।’

কুরবানী ঈদের আগে লিখিত পরীক্ষা হলো। রেজাল্ট দিতে খুব বেশী দেরী হয়নি। সেদিন সম্ভবত শুক্রবার ছিল। ভোর বেলা পেপারটা হাতে নিয়ে যখনই দেখলাম ‘সি’ ইউনিটের লিখিত পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো। আমি কাউকে কিছু না বলে ওর অ্যাডমিট কার্ডটা বের করে খুজঁতে থাকলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে

যতক্ষণ না ওর রোল নম্বরটা পাচ্ছিলাম ততক্ষণ যে আমার কি অবস্থা বোঝাতে পারবো না। বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এই সময়টুকু মনে হয়েছে অনন্তকাল। ওর রোল নম্বরটা চোখে পড়তেই এক চিৎকার। আবীর আর আদীব দুই ভাই ঘুমাচ্ছিল। মশারীর ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে বললাম, আবীর তোমার রেজাল্ট দিয়েছে। পাশ করেছো।

আমার দিকে একবার তাকিয়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে গেলো। যেন ধরেই নিয়েছিল ও পাশ করবে। কিন্তু আমি জানি এত সহজ ছিল না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ছেলে আমার স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। তখন বন্ধু বান্ধবীদের মধ্যে সেলিমা বেগম ডলির ছেলে মেডিকেলে পড়ে।

আমার জানা মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনো কেউ ভর্তি হয়নি। আবীর ভর্তি হবার পরে জেনেছি শাহিদা ইয়াসমিন ডলির মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি তে, জাহরা হাসিনা পারভিনের মেয়ে অর্থনীতিতে আর ইলা ইমামের মেয়ে সামান্থা আইইআর-এ পড়ে। আবীরের পরে কামরুল আখতারিরর মেয়েও পড়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয় নিয়ে।

তখন তিনি জাতীয় দলের বড় তারকা

আবীর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এবার মৌখিক পরীক্ষা। মেধা অনুযায়ী কে কোন ডিপার্টমেন্টয়ে যাবে সেটাই নির্ধারণ হবে। ছেলের মনের ইচ্ছা মার্কেটিং। ও ৪০০ জন এর ভিতরেই ছিল। তাই বুঝতে পারছিলাম না মার্কেটিং পাবে কি পাবেনা। ভাইবার লম্বা লাইন। অপেক্ষা করছি। ছেলে অস্থির! আমি সবসময় ওকে সাহস দিয়ে এসেছি। বললাম, মার্কেটিংই পাবে। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে মার্কেটিং এ পড়ার সুযোগ হলো।

ভর্তির জন্য ডিপার্টমেন্ট, রেজিস্টার বিল্ডিং, জনতা ব্যাংক (টিএসসি শাখা), এস এম হল সব জায়গায় এক এক করে ছেলেকে নিয়ে আমি গিয়েছি। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তখন ছেলের সাথে আমার নিজের ভর্তির গল্প করতাম। ক্লাশ শুরু হওয়া পর্যন্ত কয়েকদিন গেলাম ওর সাথে। ছেলে বড় হয়ে গেছে। এখন তো ছাড়তেই হবে। মাস খানেক নিজে গাড়িতে দিয়ে আসতাম। আসার সময় ও একাই চলে আসতো।

একদিকে লেখাপড়া আর একদিকে ক্রিকেট। দুটো চালিয়ে যেতে ওরও পরিশ্রম করতে হয়েছে। আজ ভাবি কেমন করে দিনগুলো চলে গেলো। একটা সন্তানকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসা খুব সহজ নয়। কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সে শুধু বাবা মায়েরাই জানেন। প্রত্যেকটা বাবা মা-ই চান তাদের সন্তানরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। মানুষের মত মানুষ হোক। সমস্ত ভাল কাজের সাথে সম্পৃক্ত হোক। সন্তানরাও যেন ভুলে না যায় বাবা মায়ের বিশেষ করে মায়েদের এই ত্যাগের কথা। সকল বাবা মায়ের প্রতি শুভকামনা।

লেখক: ক্রিকেটার শাহরিয়ার নাফিসের মা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link