৬/৬: অবিশ্বাস্য! দু:সাধ্য বোলিং ফিগার!

৬ রানে ৬ উইকেট! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। পাড়ার ক্রিকেটেও তো এমন কীর্তি গড়া যায় না সহজে। অথচ এই অবিশ্বাস্য, দু:সাধ্য এক বোলিং ফিগারেরই মালিক সাকিব আল হাসান; বিশ্বমঞ্চে যিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। সাত বছর আগে, ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভালে সবাইকে চমকে দিয়ে অসাধারণ এই রেকর্ডটি তিনি গড়েন।

সেটি ছিল ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল)-এর প্রথম আসরের একটি ম্যাচ। ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোব্যাগো রেড স্টিলের বিপক্ষে বার্বাডোজ ট্রাইডেন্টসের হয়ে খেলতে নামেন সাকিব। টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় ত্রিনিদাদ। কিন্তু তারা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি, তাদের উপর কী ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞটাই না চালাতে চলেছেন সাকিব! নিজে বল হাতে হয়তো ছয়টি উইকেট পান তিনি, তবে সব মিলিয়ে আটটি উইকেটে থাকে তার প্রত্যক্ষ অবদান।

দলীয় ৬ ও ১৫ রানের ত্রিনিদাদ হারায় তাদের প্রথম দুইটি উইকেট। সেই দুইটি উইকেট জেসন হোল্ডার এবং শ্যানন গ্যাব্রিয়েল পেলেও, বল তালুবন্দি করার কাজটি করেন সাকিবই। তিনি নিজে যখন বোলিংয়ে আসেন ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে, ততক্ষণে ত্রিনিদাদ হারিয়ে ফেলেছে তিনটি উইকেট, ২৯ রানের বিনিময়ে। প্রথম বলেই সাকিব তার ঘূর্ণিজাদুতে এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেলেন রস টেইলরকে। ওই ওভারে স্রেফ এক রান দেন তিনি। অষ্টম ওভারে আবার আক্রমণে এসে কোনোদিন উইকেট পাননি বটে, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে তিনটি সিঙ্গেলের বিপরীতে তিনটি ডট আদায় করে নেন।

দশম ওভারটি ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। ইতোমধ্যেই ৪০ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে ত্রিনিদাদ। নির্মম সাকিব ওই ওভারের প্রথম বলেই সাজঘরে পাঠান ডোয়াইন ব্র্যাভোকে। এবারও সেই একই কায়দায়, ব্যাটসম্যানকে এলবিডব্লিউ’র ফাঁদে ফেলে। পরের দুইটি বল ডট দেয়ার পর চতুর্থ বলে তিনি রানের খাতা খোলার আগেই বিদায় বলে দেন নিকোলাস পুরানকে। আউটসাইড অফে যাওয়া বলে ইনসাইড এজের মাধ্যমে শর্ট লেগে ক্যাচ উঠলে, সেটিকে তালুবন্দি করেন কিয়েরন পোলার্ড। এরপরের বলটি আবার ডট।

ওভারের শেষ বলটি ফুলার দেন সাকিব। কেভন কুপার সুইপের চেষ্টা করলেও, ব্যাটে-বলে করতে ব্যর্থ হন। বরং বল সোজা গিয়ে উপড়ে নেয় তার স্ট্যাম্প। তিনটি ডট ও তিনটি উইকেটের মাধ্যমে ইনিংসে নিজের তিন নম্বর ওভারটির সমাপ্তি ঘটান সাকিব। ত্রিনিদাদের স্কোর তখনো অপরিবর্তিত; ৪০ রান, কিন্তু উইকেট নেই সাতটি।

দ্বাদশ ওভারে ফের সাকিব। এবারও প্রথম বলেই সফল তিনি। তার বলের গতিপ্রকৃতি না বুঝেই স্লগ করার চেষ্টা করেন স্যামুয়েল বদ্রি। মিস করেন তিনি এবং বল গিয়ে আঘাত হানে সোজা উইকেটে। একপ্রকার যেন নিজের উইকেটটি ছুঁড়ে দিয়েই আসেন তিনি। ফলে ফাইফার সম্পন্ন হয় সাকিবের। পরের তিন বলে একটি লেগ বাই এবং দুইটি সিঙ্গেল দেন তিনি। ষষ্ঠ বলে কেভিন ও’ব্রায়েনও সাকিবের বলের ধাঁধাঁ বুঝতে না পেরে ব্লেডের কানায় খোঁচা লাগিয়ে বল তুলে দেন সিলি পয়েন্টে। ওই জায়গার অতন্দ্র প্রহরী পোলার্ডের একদমই ভুল হয় না বলটিকে ঠিকঠাক লুফে নিতে।

এভাবেই ১.৫০ ইকোনমি রেটে এক মেইডেনসহ ৬ রানে ৬ উইকেটের বোলিং ফিগার নিয়ে টানা চার ওভারের এক ঐন্দ্রজালিক স্পেলের ইতি টানেন সাকিব। ত্রিনিদাদের সংগ্রহ তখন ৯ উইকেটে ৪৬। এরপর আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি তাদের ইনিংস। ত্রয়োদশ ওভারের পঞ্চম বলেই ৫২ রানে গুটিয়ে যায় তারা।

৫৩ রানের অতি সহজ লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে ব্যাট করতে নামা বার্বাডোজের পথচলাও যে একেবারে মসৃণ ছিল, তা বলা যাবে না। সুলেমান বেনের প্রথম ওভারেই ডোয়েইন স্মিথ আর জোনাথন কার্টার ২০ রান তুলে নিলে বার্বাডোজের ম্যাচ জয় সময়ের ব্যাপার মনে হলেও, পরের ওভারেই তাদের দুজনকে আউট করে দিয়ে নাটকীয়তার আভাস দেন ফিদেল এডওয়ার্ডস। পরবর্তী ওভারে বেন শোয়েব মালিকের উইকেট তুলে নিলে, তিন ওভার শেষে ৩০ রানে তিন উইকেট হারিয়ে প্রথম বারের মত অস্বস্তিতে পড়ে বার্বাডোজ। তাদের অস্বস্তির মাত্রা আরো বেড়ে যায় এডওয়ার্ডসের পরের ওভারে উমর আকমল সাজঘরে ফিরলে।

এরপর ক্রিজে আসেন সাকিব। কিন্তু বল হাতে দুর্দান্ত সাকিব ব্যাট হাতে হন চরম ব্যর্থ। ষষ্ঠ ওভারের প্রথম বলেই তিনি পরিণত হন এডওয়ার্ডসের চতুর্থ শিকারে। ছয় বল থেকে করে যান মাত্র এক রান। ফলে ৩৬ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে দিশেহারা তার দল। ওই ওভারেরই পঞ্চম বলে এডওয়ার্ডস কাইল মেয়ার্সকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজের পাঁচ উইকেট সম্পন্ন করলে, ৩৯ রানে ৬ উইকেটে পরিণত হয় সাকিবরা।

জয়ের বন্দর থেকে তখনো ১৪ রানের দূরত্ব থাকায় মনে হতে থাকে, ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচটির অবতারণা বুঝি ঘটতে চলেছে ব্রিজটাউনে। কিন্তু অধিনায়ক পোলার্ড আর অ্যাশলে নার্স মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরের এক ডজন বল মোকাবেলার পর, অষ্টম ওভারের শেষ ডেলিভারিতে মিড উইকেট দিয়ে বল সীমানা ছাড়া করে দলের জয় নিশ্চিত করেন নার্স। এভাবেই শেষ পর্যন্ত আর বৃথা যায় না সাকিবের অবিস্মরণীয় বোলিং, যেটি তৎকালীন সময়ে ছিল টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার।

মাত্র এক রান বেশি দেয়ায় সেরাদের সেরা হওয়া হয়নি সাকিবের। সেই জায়গাটি বরাদ্দ ছিল এভি সুপ্পিয়াহ নামের এক বোলারের জন্য, যিনি ২০১১ সালের জুলাইয়ে ইংলিশ কাউন্টি দল সামারসেটের হয়ে গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে তিনি ৬ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ রানের বিনিময়ে। সাকিবের ৬ রানে ৬ উইকেট অবশ্য এখনও তালিকায় ওপরের দিকেই আছে। অবশ্য সুপ্পিয়াহও এখন আর সবার ওপরে নেই।

কারণ ২০১৯ সালের আগস্টে সুপ্পিয়াহকেও পেছনে ফেলে দেন লিস্টারশায়ার ফক্সেসের অধিনায়ক কলিন অ্যাকারম্যান। বার্মিংহাম বিয়ার্সের বিপক্ষে ১৮ রানের বিনিময়ে ৭টি উইকেট তুলে নেন তিনি। ২০২৩ সালে এসে সেই রেকর্ড ভেঙে দেন মালয়েশিয়ার সিয়ারজুল ইসরাত। তিনি চীনের বিপক্ষে আট রান দিয়ে নেন সাত উইকেট।

জানিয়ে রাখা ভালো, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অন্যতম সেরা বোলিং ফিগারটি কিন্তু বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত। কেননা সেটি হলো ৭ রানে ৬ উইকেট, যে রেকর্ড ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর নাগপুরে সফরকারী বাংলাদেশের বিপক্ষে গড়েন ভারতের দীপক চাহার। তবে সে যা-ই হোক, সাকিবের ৬ রানে ৬ উইকেটের রেকর্ডটি কিন্তু সিপিএলের ইতিহাসে আজো সেরা। তাই তো ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেরা বোলিং স্পেলের জন্য ‘সিপিএল অস্কার’ জয় করেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link