কাগজে-কলমে তিনি বড় কোনো ক্রিকেটার নন। ভিড়ের মধ্য থেকে আলাদা করে চেনার তেমন উপায় নেই। তবে, যেদিন নিজের ছন্দে থাকবেন, সেদিন আপনি তাঁকে চিনতেই শুধু নয় – তাঁর ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে বাধ্য হবেন। সত্যিই সৈকত আলী এক সারপ্রাইজ প্যাকেজ।
সৈকত আলী বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক ক্রিকেট কাঠামোর আবিষ্কার। ২০০৮ ও ২০১০ – দু’টি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন তিনি। যুব পর্যায়ে এক আন্তর্জাতিক ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন, আরেক ম্যাচে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ১১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন তিন উইকেট।
এখন তাঁর পরিচয়টা মূলত একজন মারকুটে ব্যাটসম্যানের হলেও এক সময় বেশ নিয়মিতই মিডিয়াম পেস বোলিংটা করতেন। সেখানে সাফল্যও পেয়েছেন। তবে, এখন পুরোদস্তর ব্যাটসম্যান। যদিও, আজো আদর্শ মনে করেন সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার জ্যাক ক্যালিসকে।
যদিও, ব্যাটারশিপে তিনি জ্যাক ক্যালিসের পুরোপুরিই বিপরীত ঘরানার। রয়েসয়ে নয়, বরং বলটাকে পেটাতেই বেশি আনন্দ পান সৈকত আলী। সৈকতের ব্যাটিংয়ের সবচেয়ে আলোচিত ব্যাপার হচ্ছে, তিনি হঠাৎ করে নেমেই ম্যাচের মোড় ঘুড়িয়ে দিতে পারেন। পজিশন সেখানে যাই হোক না কেন।
এই যেমন, ২০২২ সালের বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) ফাইনাল। ফরচুন বরিশালের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন পুরা টুর্নামেন্ট জুড়ে তাঁর প্রয়োজনই বোধ করেনি। যদিও টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই টপ অর্ডারে অনেক অদল বদল করেছেন দলটির অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। তবে ক্রিস গেইল, নাজমুল হোসেন শান্ত কিংবা মুনিম শাহরিয়ারদের ভীরে কখনো তাঁর নামটা কখনো আসেইনি।
অথচ বিপিএলের সবচেয়ে বড় ম্যাচে, বড় প্রতিপক্ষের উপর তাঁর ব্যাটই হয়ে উঠলো বরিশালের ত্রানকর্তা। যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। বিপিএল ফাইনালের চাপ সামলে সবার উপরে সৈকত আলীর নামটাই উচ্চারিত হল।
মাঠের ক্রিকেট কিংবা কাগজ কলম দুই জায়গাতেই বিপিএলের সবচেয়ে শক্তিশালী দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ও ফরচুন বরিশাল মুখোমুখি হয়েছিল ফাইনালে। দেশ-বিদেশের বেশ কয়েকজন বড় বড় তারকা আছে দুই দলেই। ফলে সবারই নজর ছিল সাকিব আল হাসান, ক্রিস গেইল, ফাফ ডু প্লেসিস কিংবা মঈন আলীর দিকে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে পুরো আলোটা নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন সৈকত আলী।
টুর্নামেন্ট জুড়ে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন তরুণ ক্রিকেটার ভালো ক্রিকেট খেলেছেন। তবে বরাবরের মত এবারো প্লে অফের ম্যাচ গুলোতে ব্যবধান গড়ে দিচ্ছিলেন বিদেশি ক্রিকেটাররা। আর ফাইনালের দুই দলে তো বিশ্বের সেরা কয়েকজন তারকাই আছেন। ফলে ফাইনাল ম্যাচের আলোও যে কোন বিদেশিই কেড়ে নিবেন এমনটাই ধারণা ছিল।
প্রথম ইনিংসের শুরুতে আজকেও সুনীল নারাইনের ঝড়ো ফিফটি সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছিল। তবে বরিশাল ব্যাটিং করতে নামলে আজ এক অলোক শিখার মত হাজির হলেন বাংলাদেশের এই ব্যাটসম্যান। মঈন আলী, ফাফ ডু প্লেসিসদের ব্যর্থতার দিনে ব্যাট হাতে মিরপুরে দেখা গেল সৈকত আলীর ঝড়। লম্বা সময় পর মাঠে এত দর্শক হলো। তাঁদের যেন পুরো প্রতিদানটাই দিলেন এই ব্যাটসম্যান।
বরিশাল অবশ্য আশা করেছিল আরেক স্থানীয় ওপেনার মুনিম শাহরিয়ারের উপর। টুর্নামেন্টে দারুণ ফর্মে ছিলেন এই ব্যাটসম্যান। তবে আজ ৭ বলে ০ রান করেই ফিরে যান এই ওপেনার। তিন নম্বরে সৈকত আলী নেমে মুনিমের কাজটাই করে দিলেন। আরেক প্রান্তে ক্রিস গেইলের মত ব্যাটসম্যান দেখছিলেন সৈকতের ঝড়।
ক্রিস গেইলের মত ব্যাটসম্যান যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন আরেকপ্রান্তে বরিশালের হয়ে ঝড়টা তুললেন এই ব্যাটসম্যান। মাত্র ২৬ বলে তুলে নিলে এই টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি। অবশ্য এবার সৈকত সুযোগই পেয়েছেন এর আগে তিন ম্যাচে। প্রথমটা ছিল চট্টগ্রামের বিপক্ষে লো স্কোরিং ম্যাচ। সেখানেও ৩৫ বলে ৩৯ রান করে দলের জয় নিশ্চিত করেছিলেন। ছিলেন বরিশালের সর্বোচ্চ রান স্কোরার।
তবে বড় মাচে সৈকত আলী যেন এক অন্য ব্যাটসম্যানই হয়ে উঠেছিলেন। মুস্তাফিজুর রহমান, সুনীল নারাইন, মঈন আলী, তানভীর ইসলামদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী বোলিং লাইন আপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালেন। প্রায় ২০০ স্ট্রাইকরেটে তুলে নিলেন হাফ সেঞ্চুরি। পুরো টুর্নামেন্ট খেলতে না পারার আক্ষেপ যেন মেটালেন ফাইনাল ম্যাচেই।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের দেয়া ১৫১ রানের টার্গেট যেন মামুলি বানিয়ে ফেলছিলেন। শেষ পর্যন্ত ৩৪ বলে ৫৮ রানের ইনিংস খেলে ফিরে যান। ইনিংসটিতে ছিল ১১ টি চার ও ১ টি ছয়। অর্থাৎ ইনিংসের ৫০ রানই করেছেন বাউন্ডারি থেকে। সৈকত আলী এই ইনিংসটি খেলেছেন ১৭০.৫৮ স্ট্রাইকরেটে। ইনিংসের দশম ওভারে তানভীর ইসলামের বলে আউট হন এই ব্যাটার। শেষ অবধি, ফরচুন বরিশাল মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় ট্রফি হাতে নিতে ব্যর্থ হলেও, সৈকত আলী ঠিকই নিজের জাতটা চেনাতে পেরেছিলেন। প্রমাণ করেছিলেন, চমকে দেওয়া ব্যাটিংয়ের জন্যই তাঁর জন্ম।