লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণ: রহস্যময় জাদুকর

নজড় কাড়া বোলিং ফিগার। ২ রান দিয়ে সাত উইকেট বাগিয়ে নেওয়া তো আর মুখের কথা নয়। তাও সেই কাজটা করলো মাত্র ১২ বছর বয়সী এক ছোকড়া। কব্জিটা ঘোরাতে জানে বেশ। তাতেই যেন ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনে প্রথম আলোচনায় এসেছিলেন লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণ।

৭০-৮০ দশকে ভারতীয় ক্রিকেটে আসার আলো জ্বালিয়েছিলেন শিবারামাকৃষ্ণ। যখন সারা বিশ্বে দাপট চালাচ্ছে পেস বোলাররা ঠিক তখন আবির্ভূত হন ক্ষুদে সেই স্পিন জাদুকর। কিন্তু হিসেবে গড়মিল কিংবা নিয়তির নিষ্ঠুরতা। কোন এক অজানা কারণে লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণের আলো বেশিদিন আর স্থায়ী হয়নি।

ভারতের সাবেক মাদ্রাস প্রদেশে জন্ম লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণের। নতুন একটি বছর শুরু হওয়ার ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বন্ধু মহলে অধিক পরিচিত ছিলেন শিবা কিংবা এল এস নামে। স্কুল জীবনেই ক্রিকেটের সাথে সক্ষ্যতার সূত্রপাত। সেই স্কুল ক্রিকেটেই প্রথম দেখিয়েছিলেন তাঁর স্পিন জাদু, জ্বেলেছিলেন আশার উজ্জ্বল প্রদীপ।

বেশ ভাল লেগ স্পিনটা করতে পারতেন শিবারামাকৃষ্ণ। ১২ বছর বয়সে নিজের স্কুল বিদ্যা মন্দিরের হয়ে তৎকালীন মাদ্রাস আন্ত:বিদ্যালয় চ্যাম্পিয়নশিপে দুই রান খরচায় সাত উইকেট নিয়ে তাক লাগিয়ে দেন সবাইকে। প্রত্যাশা শুরুতেই যেন ছুঁয়ে ফেলে সপ্তম আকাশ।

অমন চোখ ধাঁধানো বোলিং পারফরমেন্সের পর শিবারামাকৃষ্ণ সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে ডাক পেলেন ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। এরপর অনূর্ধ্ব-২২ দলের সদস্য হয়ে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কা এবং ইংল্যান্ডেও। তবে সেখানে সুযোগ পাননি মাঠে নেমে তাঁর স্পিন জাদুতে কাবু করতে পারেননি প্রতিপক্ষে খেলোয়াড়দের।

অপেক্ষায় ছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভারতের সবচেয়ে মর্যাদার রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ পান তিনি এবং এবার নিজেকে প্রমাণ করতে বিন্দুমাত্র ভুল করেননি শিবারামাকৃষ্ণ।

শিবারামাকৃষ্ণ ১৯৮১/৮২ সালের রঞ্জি ট্রফিতে নিজের অভিষেক ম্যাচটি খেলতে নেমেছিলেন কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায়ে দিল্লির বিপক্ষে। দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১১ ওভার বল করেন শিবারামাকৃষ্ণ। তাতেই তাঁর ধ্বংসলীলার একটা আঁচ পেয়ে যায় ভারতীয় ক্রিকেট। সাত উইকেট তিনি একাই নিয়ে নেন।

খরচ করেন কেবল ২৮টি রান। একটা শোরগোল পড়ে যায় তৎকালীন ক্রিকেট অঙ্গনে। রঞ্জির তিনটি ম্যাচ খেলেই তিনি ডাক পেয়ে যান ১৯৮২/৮৩ সালে পাকিস্তান ট্যুরের জন্য ভারতের জাতীয় দলে। তবে ওই যে সুযোগের অভাব। তিনি নেট অনুশীলনেই কাটিয়েছেন দিন।

তারপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দলেও জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। অবশেষে এলো তাঁর সুযোগ। ১৭ বছর ১১৮ দিন বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে দলে জায়গা করে নেন লক্ষ্মণ শিবারামাকৃষ্ণ। কিন্তু নিজের অভিষেক টেস্টে আলো ছড়াতে ব্যর্থ হন তিনি।

তাঁর ফলে ১৯৮৩ বিশ্বকাপের জন্যও বিবেচিত হননি তিনি। এমনকি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের পরের বেশ কয়েকটি সিরিজেও দলে ডাক পাননি তিনি। শিবারামাকৃষ্ণ প্রথম পূর্ণ সিরিজ খেলেন ১৯৮৪-৮৫ সালে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে। সেই সিরিজেই আবার শিবারামাকৃষ্ণ ঘুরালেন তাঁর জাদুর ছড়ি। বনে গেলেন সিরিজ সেরা খেলোয়াড়। 

মুম্বাইয়ে প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই ছয়টি করে উইকেট নিয়ে ভারতকে ১৯৮১ সালের পর টেস্ট জয়ের স্বাদ এনে দেন শিবারামাকৃষ্ণ। প্রথম ইনিংসে ৬৪ রানের বিপরীতে ছয় উইকেট নেন। পরের ইনিংসে ১১৭ রান দিলেও তা খুব একটা প্রভাব ফেলেনি ভারতের আট উইকেটের বড় জয়ে।

কিন্তু আবার ধপ করেই নিভে গেলো শিবারামাকৃষ্ণ নামক প্রদীপের আলো। পরবর্তী সিরিজগুলোতে অনুজ্জ্বলতা তাঁকে আবার ছিটকে দেয় দল থেকে। এরপর আর টেস্ট দলে সুযোগ হয়ে ওঠেনি তাঁর। ওপেনারদের আধিপত্যে একজন লেগ স্পিনারকে দলে রাখা বিবেচিত হতো বিলাসিতা হিসেবে।

তবে শিবারামাকৃষ্ণের দক্ষতার উপর ভরসা করে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে নিয়ে যান সুনীল গাভাস্কার। আবারো নিজেকে প্রমাণ করে হন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। সেই সাফল্য তাঁর জন্য খুলে দেয় বিশ্বকাপ দলের দরজা। ১৯৮৭ বিশ্বকাপে মাত্র দুই ম্যাচ খেলেন তিনি। ছন্দছাড়া পারফর্মেন্স একটি উইকেট তাঁর ঝুলিতে।

এমন আসা যাওয়ার মাঝে তিনি মনোনিবেশ করেন ব্যাটিং এ। হতে চান অল রাউন্ডার হতে। কিন্তু তাঁর জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন হয়ে ওঠেনি। আরো বছর দশেক ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেও আর জাতীয় দলের রাস্তাটা খুঁজে পাননি লক্ষণ শিবারামাকৃষ্ণ। বহু আশা জাগিয়েও অঙ্কুরেই জাদুকর শিবারামাকৃষ্ণ নিভুনিভু আলো নিভে যায় পুরোপুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link