অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস: ভেলকিবাজ কিংবা ভদ্রলোক

সম্ভবত, অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের মতো ইংল্যান্ড দলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেননি আর কোনো অধিনায়কই। সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন নিজের আমলে ক্রমাগত হারকে ড্রয়ে রুপে এনে দিতে পেরেছিলেন! এরপর আরেক অধিনায়ক মাইকেল ভন ড্র থেকে জয়ের মুখ দেখিয়েছিলেন ইংল্যান্ডকে।

এরপর ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস। শুধু ড্রকে জয়ে নয় বরং মাস কয়েকের মাঝেই দলের ভেতরের পরিবেশে বেশ পরিবর্তন আনেন স্ট্রাউস। ব্যাকফুটে থাকা একটা দলকে টেনে তুলে সফলতার শীর্ষে।

২০০৯ সালে অ্যাশেজে অজিরা সেঞ্চুরি করেছিল আটটি। অপরদিকে, ইংলিশদের সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিল মাত্র দু’জন। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তিনজন বোলার ২০ এর বেশি উইকেট শিকার করে, অপরদিকে ইংল্যান্ডের কেউই নিতে পারেননি ২০ উইকেট!

অস্ট্রেলিয়া উইকেট প্রতি গড়ে ৪০ রান করেছিল, ইংল্যান্ডের উইকেট প্রতি গড় রান ছিল ৩৪! এই পরিসংখ্যানই ২০০৯ অ্যাশেজে ইংলিশদের অবস্থান স্পষ্ট। কেভিন পিটারসেনের ইনজুরি, ফ্লিনটফ তখন ক্যারিয়ারের একদম শেষ দিকে, অ্যালাস্টিয়ার কুক, পল কলিংউডরা এক ইনিংসের বেশি নিজেদের সেরাটা দিতে পারেনি। এমন এক অবস্থা থেকেই ইংল্যান্ড ক্রিকেটকে আবার উঠিয়ে এনেছিলেন স্ট্রাউস!

বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্ব আর তাঁর সোজাসাপ্টা কথা দলের ভেতরের পরিবেশই পাল্টে দেয়। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের সেরাটা বের করে আনতে সর্বোচ্চ দিয়েছিলেন তিনি। সবাই যাতে নিজের শতভাগ দিয়ে দলকে শক্ত অবস্থানে নিতে পারে সেটাই ছিল স্ট্রাউসের মূল লক্ষ্য।

স্ট্রাউস নিজের ব্যক্তিগত অর্জন নিয়ে কখনোই চিন্তা করেননি। উইকেটরক্ষক না হয়েও ধরেছেন ১২১টি ক্যাচ! ইংল্যান্ডের হয়ে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। অধিনায়ক হিসেবে নিজের সেরাটা দেওয়া ছাড়াও ফিল্ডিংয়ে শতভাগ দিয়ে ম্যাচের ভাগ্যও বদলে দিয়েছেন তিনি।

২০০৯ অ্যাশেজে বাকিদের ব্যর্থতার মাঝেও লর্ডসে ১৬১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে হার এড়ানোর জন্য সেরাটা দেন স্ট্রাউস। ওভালে শেষ টেস্টেও ৫৫ ও ৭৫ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। এর চার বছর আগে ২০০৫ সালে ওভাল টেস্টে স্ট্রাউসের ১২৯ রানের ইনিংসের কারণেই ম্যাচে টিকে থাকে ইংলিশরা।

ইংল্যান্ডের বিপদে প্রায়সই ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে যেতেন স্ট্রাউস। তাঁর অধীনেই দলের সবচেয়ে খারাপ অবস্থান থেকে টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে উঠে আসে ইংলিশরা। ২০১২ সালের শুরুতে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হিসেবে স্ট্রাউসের রেকর্ড ছিল ২১ জয় ও এর বিপরীতে মাত্র ৫ হার!

ভারতকে ৪-০ তে হারিয়ে ইংল্যান্ডকে উঠিয়ে আনেন টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে। ২০১০-১১ অ্যাশেজে ৩-১ এ সিরিজ জয় নিয়ে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করাটা ছিল স্ট্রাউসের ক্যারিয়ারের অনেক বড় অর্জন।

১৯৭৮-৭৯ সালের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটে জিতেছিল পার্সি চ্যাপম্যান ও আর্থার কারদের ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। এর বাদে স্যার লিওনার্ড হটন ও মাইকেল ব্রিয়ারলিেই অন্য ইংলিশ দুই অধিনায়ক ছিলেন যারা অ্যাশেজ জিতেছিলেন অস্ট্রেলিয়া ও ঘরের মাটিত।

যদিও সে সময়, মানে হটন-ব্রিয়ারলিদের সময়ে ইংল্যান্ডই একমাত্র দেশ ছিল যাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পেশাদার ম্যাচ হত। সেখান থেকে হটন-ব্রিয়ারলির পর স্ট্রাউসই পরবর্তীতে দেশের মাটিতে এবং অজিদের ডেরায় অ্যাশেজ জয় করেন। ওই সময় নিরপেক্ষ ভেন্যুর ত্রাশ ছিল ইংল্যান্ড দল।

২০১১ বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে আরব আমিরাতে ৩-০ তে টেস্ট হারলেও এক টেস্টে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেন স্ট্রাউস। একমাত্র ইংলিশ ব্যাটার হিসেবে এশিয়ায় কোনো টেস্টে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি।

তবে, তিনি ভেবে ফেলেছিলেন ওয়ানডেতে তাঁর সেরা সময়টা শেষ। ব্যাট হাতে ভালো করা সত্ত্বেও তিনি মনে করেছিলেন নতুন অধিনায়কের প্রয়োজন। আর তাই ২০১১ বিশ্বকাপের পরই সরে দাঁড়ান দায়িত্ব থেকে।

হাটন এবং স্ট্রাউসের মাঝে দারুণ এক মিলও ছিল। দু’জনেই দলের ক্রিকেটারদের ভিতরের আত্মশক্তিটা পড়তে পারতেন আর যার কারণে সেটার উপর জোর দিয়ে প্রত্যেকের সেরাটা বের করে আনার জন্য কাজ করতেন। স্ট্রাউসের মতে, ‘তুমি যদি ব্যাটারকে রান করতে না দাও, সে রানের জন্য ক্ষুদার্থ থাকবে। আর এতেই সে উইকেট দিয়ে আসবে।’

আর এটাই ছিলো স্ট্রাউসের দর্শন। যার যে দায়িত্ব এবং সামর্থ্য তাকে সেটাই দিতে হবে। স্ট্রাউসের মতে অ্যান্ডারসন যদি বলতো পঞ্চম স্লিপ রাখতে তিনি তাই করতেন। স্ট্রাউস একবার বলেছিলেন, ‘আপনি চাইলেই জোনাথন ট্রটকে বলতে পারবেন না তুমি দ্রুত রান তোলো। কারণ তার গড় ৫০ সে নিজের মতো করেই খেলবে। এখানে পরিবর্তন করা যাবে না।’

স্ট্রাউসের মতে, অধিনায়কের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে প্রত্যেকে নিজেদের সেরাটা দিতে পারে।

স্ট্রাউস মানুষ হিসেবেও ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক। সেটা হোক মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে। খেলার মাঠে না আম্পায়ার না প্রতিপক্ষের ক্রিকেটার – কারো সাথেই কখনো বাক-বিতণ্ডায় জড়াননি সাবেক এই ইংলিশ ওপেনার। না স্লেজিং, না মাঠের কোনো বিতর্কিত ঘটনা – কোনো কিছুই স্পর্শ করতে পারেনি স্ট্রাউসকে।

ক্রিকেট মাঠে অনন্য নজীর গড়ে তিনি ২০০৯ সালের বার্মিংহ্যাম টেস্টে অ্যাশেজের মঞ্চেও অস্ট্রেলিয়াকে একাদশ ঘোষণা হওয়ার পরও বদলি নেওয়ার সুযোগ দেন। ব্র্যাড হ্যাডিনের বদলিতে সেবার টেস্ট অভিষেক হয় গ্রাহাম ম্যানুর। স্ট্রাউস সব সময়ই নিজের দায়িত্ব নিয়ে ভেবেছেন, আত্মস্বার্থ কখনোই ভাবেননি। ক্যারিয়ারের শেষ অবধি দেশ ও দেশের ক্রিকেটকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সামর্থ্যের সেরাটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link