পঞ্চাশ দশকের একদম শুরু। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ইংল্যান্ড সফরের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। দল ঘোষণার পরই দেখা গেলো অচেনা দুই নাম! একেবারেই অপরিচিত। কেউ কেউ নাম শুনেছেন কেউ বা আবার জানেনও না এরা কারা! গুরুত্বপূর্ণ একটা সিরিজের আগে ঘোলাটে পরিবেশ। জানা গেল এই দু’জনই স্পিনার। আর দু’জনে মাত্র দু’টি করে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন। এতেই অনেক ক্রিকেটার যেনো আরো ক্ষুব্ধ!
মাত্র ২ ম্যাচ খেলেই জাতীয় দলে! ইংল্যান্ডের মতো কন্ডিশনে এদেরকে দলে আনার ব্যাখ্যাটাও কেউ বুঝতে পারছিলো না। তার উপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে তখন পেস বিভাগের বেশ দাপট চলছিলো। স্পিনারদের সেভাবে মূল্যায়ন করা হতো না বললেই চলে!
যাহোক আলোচনা-সমালোচনা শেষে সেই দুই তরুনকে সঙ্গী করে ক্যারিবীয় বাহিনী পাড়ি জমালো ইংল্যান্ডে। বলাবাহুল্য তখনো ইংল্যান্ডের মাটিতে কোনো টেস্ট ম্যাচই জিততে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তার উপর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ হেরে বিধ্বস্থ ক্যারিবিয়ান শিবির। তাই ওই সিরিজের আগেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সেভাবে আমলে নেয়নি ইংলিশরা। ইংলিশদের বিপক্ষে তখন জয় আশা করাটাও তো আকাশ-কুসুম চিন্তা।
কিন্তু সেই ভাবনাকে বাস্তবে রুপ দিয়ে ইতিহাস গড়েছিলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে কোনো পেস ব্যাটারি নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে স্বপ্নের এই ফল এনে দিয়েছিলেন দুই তরুন স্পিনার। একজন ছিলেন আলফ ভ্যালেন্টাইন ও আরেকজন সনি রামদিন। সেবার ইংল্যান্ডের মাটিতে পুরো ক্রিকেট বিশ্বের সামনেই জন্ম দিয়েছিলেন বিস্ময়ের!
প্রস্তুতি ম্যাচেই নিজেদের সামর্থ্যের ঝলক দেখিয়েছিলেন। এরপর সুযোগ পেয়েই করেছেন বাজিমাত। ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবার টেস্ট জয়ের পাশাপাশি প্রথমবার সিরিজ জয়ও করে ক্যারিবিয়ানরা।
ক্রিকেট পাড়ার ছোট্ট দুই জাদুকর আর ক্যালিপসোর সুরের কথা আসলেই মাথায় আসে আলফ ভ্যালেন্টাইন ও সনি রামদিনের কথা। এই দুই ছোট্ট জাদুকর নিজেদের জাদুকরী বোলিংয়ে বনে গিয়েছেন ক্যারিবিয়ান সংস্কৃতির অংশ। তাঁদের নিয়ে ক্যালিপসো সুর আজও খেলার মাঠে বেজে উঠে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ে দু’জনের মহাকাব্যিক বোলিংয়ে বাঁধা গান – ‘দোজ দু লিটল প্যালস অব মাইন’। ক্রিকেট তো যুগে যুগে কত রথী মহারথী খেলেছেন। কিন্তু এমন করে সুরে বাঁধা পড়েছেন ক’জন!
এই দু’জনের পরিচয়, জনপ্রিয়তা কিংবা ক্রিকেট ক্যারিয়ার সবকিছুই ছিলো ১৯৫০ সালের সেই ইংল্যান্ড সফরকে ঘিরে। তবে আজকের আলোচনাটা স্রেফ সনি রামদিনকে নিয়েই। কিন্তু দু’জনের ক্যারিয়ারের উত্থান কিংবা গল্পের শুরুটা যে একসূত্রেই গাঁথা। তাই একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে নিয়ে আলোচনা করাটাও বেশ দুষ্কর!
১৯২৯ সালের ১ মে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোর্ট অব স্পেনের সাউথ ক্যাপিটাল থেকে ১৫ মাইল দূরে সেন্ট চার্লস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সনি রামদিন। রামদিনের জন্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজে হলেও তিনি ভারতীয় বংশদ্ভূত। রামদিনের দাদা ব্যবসায়িক সূত্রে একটা সময় ভারত ছেড়ে পাড়ি জমান ক্যারিবিয়ান দ্বীপে।
এরপর সেখানেই স্থায়ী বসবাস। আর সেই পরিবারেই জন্ম নেন রামদিন। ছোটবেলায় বাবা-মা’কে হারিয়ে চাচার কাছেই বড় হন তিনি। জন্মসনদ না থাকায় স্কুলে থাকাকালীন নিজের ডাক নাম সনি রেখে দেন তিনি! সেখান থেকেই তিনি সবার কাছে সনি রামদিন হিসেবে পরিচিত।
এভাবেই ধীরে ধীরে ক্রিকেটে মনোনিবেশ। গ্রামের ক্রিকেট ছাড়িয়ে উঠে আসেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন তিন উইকেট। একই ম্যাচে অভিষিক্ত হন আলফ ভ্যালেন্টাইনও!
যদি প্রথম শ্রেণির অভিষেকে কোনো উইকেটই নিতে পারেননি তিনি। তবে সনি কিংবা ভ্যালেন্টাইন নিজেরাও হয়তো কল্পনা করেননি জাতীয় দলের জার্সিটা তার জন্য হাত ছোয়া দূরত্বে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে প্রথম দুই ম্যাচে ১২ উইকেট শিকারের পরই সনি নজরে আসেন নির্বাচকদের। সেখান থেকেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের জন্য স্কোয়াডে জায়গা পান তিনি। শুধু সনিই নয় এক সফরে ডাক পেয়েছিলেন আলফ ভ্যালেন্টাইনও। রামদিন অবশ্য এর আগে কখনোই ত্রিনিদাদের বাইরে পা দেননি!
এরপর প্রথম টেস্টে সুযোগ পেলেন দু’জনে! বাকিটা ইতিহাস! প্রথম টেস্টে ভ্যালেন্টাইন ১৩ ও রামদিন ৪ উইকেট শিকার করেন যেনো তাক লাগিয়ে দেয় পুরো ক্রিকেট দুনিয়ায়। পরের টেস্টেই রামদিন শিকার করেন ১১ উইকেট! ওই টেস্টে বোলিং করা ওভারের মধ্যে ৭০ ওভারই মেইডেন দেন রামদিন! পুরো সিরিজে এই দুই স্পিনারে বিষাক্ত স্পিন বিষে নীল হয়ে পড়ে ইংলিশ ব্যাটাররা।
প্রথমবার ইংলিশদের মাটিতে টেস্ট জয়, সিরিজ জয়! তাও কিনা যে দুই স্পিনার দলে আসা নিয়েই চলছিলো সমালোচনা! তাদের হাত ধরেই এই ঐতিহাসিক জয়! যে স্পিনারদের পাত্তাই দেয়নি ইংলিশরা তাদের সামনে অসহায় আত্মসমর্পণ করছিলো ইংলিশ ব্যাটাররা। পুরো সিরিজে ৪ টেস্টে ইংল্যান্ডের ৮০ উইকেটের ৬১টি উইকেটই শিকার করেন এই দুই স্পিনার। ৩-১ এ সিরিজ জয়ের পথে আলফ ৩৫ ও রামদিন শিকার করেন ২৬ উইকেট।
সনি রামদিনের ক্যারিয়ারের উত্থানটা এখান থেকেই। মাত্র দুই প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা রামদিন তখন ওয়েস্ট ক্রিকেটের নতুন বিস্ময়। অভিষেকের পরের বছরই ১৯৫১ সালে উইসডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের পুরষ্কার জেতেন রামদিন। সনির বোলিং খোদ দলের উইকেটরক্ষক ওয়ালকটও বুঝতে হিমসিন খেতেন! সনি কোন দিকে বল টার্ন করাবে এ নিয়েই সংশয়ে থাকতেন উইকেটরক্ষক।
১৯৫৭ সালে ফিরতি সফরে আরো একবার ইংল্যান্ডে আসে ক্যারিবীয়রা। এজবাস্টনে প্রথম টেস্টে প্রথম ইনিংসেই স্পিন ভেলকিতে শিকার করেন সাত উইকেট। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে ১১৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়া ইংলিশ দলের হাল ধরেন কলিন কাউড্রে ও পিটার মে! ১৭৫ রানে পিছিয়ে থাকে ইংলিশরা এই দু’জনের দানবীয় ব্যাটিংয়ে ইনিংস শেষ করে ৫২৪ রানে!
৯৮ ওভার বল করে ২ উইকেট নেন সনি। এই দু’জনের ৪১১ রানের জুটির পথে রামদিনের বলে বহুবার লেগ বিফোরের আবেদন হলেও আম্পায়াররা সাড়া দেননি! বিশেষ করে কলিন কাউড্রে রামদিনের সামনে নড়বড়ে ছিলেন। অবশ্য আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েও পরবর্তীতে প্রশ্ন উঠেছিলো।
ওই টেস্টে কোনোরকমে ড্র ছিনিয়ে আনলেও বাকি ম্যাচগুলোতে ইংলিশদের সামনে পাত্তা পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একই সাথে সনি রামদিনও ছিলেন একেবারেই সাদামাটা! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পরের তিন টেস্টে নিয়েছিলেন মোটে ১ উইকেট!
অবশ্য পরবর্তীতে ১৯৫৯-৬০ মৌসুমে ঘরের মাটিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৮.৮৮ গড়ে শিকার করেছিলেন ১৭ উইকেট। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেন রামদিন। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নে তিনি ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন।
১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত ত্রিনিদাদ অ্যান্ড তোবাগোর হয়ে খেলেন তিনি। ৫০ বছর বয়সে তিনি যখন ক্রিকেটকে বিদায় জানান নিজের শেষ ম্যাচেও ডেইজি হিলের হয়ে শিকার করেন হ্যাট্রিক! ১৯৭২ সালে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড তোবাগোর সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘দ্য হামিংবার্ড’ স্বর্ণপদক দেওয়া হয় সনিকে।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সনি খেলেছেন মোট ৪৩ টেস্ট। শিকার করেছেন ১৫৮ উইকেট। এছাড়া প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২০.২৪ গড়ে নিয়েছেন ৭৫৪ উইকেট। তাঁর টেস্ট পরিসংখ্যান অনেকের চোখেই সাদামাটা, তবে প্রস্তর যুগের সব ব্যাটসম্যানই কম বেশি জানতেন, রামদিন কোন ধাতুতে গড়া। বিশেষ করে, ইংলিশ ও অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের জন্য তিনি ছিলেন ত্রাশ। অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৯ ম্যাচে ১০২ উইকেট। যার মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮ টেস্টে নেন ৮০ উইকেট!