লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন সৌরভ গাঙ্গুলি; তবে এটি লন্ডনের বিখ্যাত লর্ডস নয়। বরং কলকাতায় স্থাপিত প্রতীকী একটি ব্যালকনি যেখানে দেখা মিলেছে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ককে। অবশ্য এবার গায়ের জামা খুলে বুনো উল্লাসে মাতেননি, জাতীয় পতাকা নেড়েই অভিবাদন জানিয়েছেন শুভাকাঙ্ক্ষীদের। আর এই ছবি দেখেই ফিরে এসেছে বিশ বছর আগের সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য।
সময়টা ২০০২ সালের ১৩ জুলাই। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড গড়েছিল ৩২৫ রানের পাহাড়। আজকের এই দিনে হয়তো ৩২৫ রানকে খুব বেশি মনে না হতে পারে, তবে ২০ বছর আগের সময়ে ৩০০ রানের ইনিংস-ই দেখা যেত কদাচিৎ। তার উপর উপমহাদেশের একটি দলের জন্য ইংল্যান্ডের মাঠে এই রান তাড়া করে জেতা প্রায় অসম্ভব।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য শেষ হাসি হাসে ভারত। মোহাম্মদ কাইফের দৃঢ়তায় অসম্ভবকে সম্ভব করে দুই উইকেটের নাটকীয় জয় পায় তারা। কিন্তু ম্যাচের নায়কদের ছাপিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়েছিল অন্য কিছু, লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি হাওয়াতে দোলানো উন্মত্ত এক উদযাপন।
ভারতের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়কের স্বভাববিরুদ্ধ এক মুহুর্ত। যা আজও শিহরণ জাগায় অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর মনে। লর্ডসের ব্যালকনি, সৌরভ গাঙ্গুলি আর একটা ভারতীয় জার্সি – ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের ফাইনালের কথা মনে করিয়ে দিতে এই তিনটি শব্দ বোধহয় যথেষ্ট।
এবার নিজের শহর কলকাতার ভিক্টোরিয়া-এরা প্যাভিলিয়ন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পুরোনো সেই স্মৃতি হয়ত মনে পড়েছে সৌরভ গাঙ্গুলির। যদিও গাঙ্গুলির মাঝে ছিল না পুরোনো সেই উদ্দামতা, ছিল না আক্রোশ। হাসিমুখেই ব্যালকনি উদ্বোধনে অংশ নিয়েছেন তিনি।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক শতাধ্রু দত্ত বলেন, ‘তিনি (সৌরভ গাঙ্গুলি) আমাকে বলেছেন এই ব্যালকনি খুব চমৎকারভাবে তৈরি করা হয়েছে। তবে মজা করে তিনি (গাঙ্গুলি) এটাও অনুরোধ করেছেন যে, তাঁকে যেন জামা খুলে নাড়াতে না বলা হয়।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সৌরভ গাঙ্গুলিকে দেখতে অগুনিত ভক্ত-সমর্থক এদিন হাজির হয়েছিল ব্যালকনি প্রাঙ্গনে। সৌরভ গাঙ্গুলির ঐতিহাসিক সেই ঘটনার স্মৃতি হিসেবেই কলকাতায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এই ব্যালকনি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে ইংরেজ-বধের গল্প ছড়িয়ে দিতেই এমন উদ্যোগ।
অবশ্য শুধু উদযাপনের জন্য নয়, লর্ডসের সঙ্গে সৌরভ গাঙ্গুলির সম্পর্কটা আরো আগের৷ ১৯৯৬ সালে এই মাঠেই টেস্ট অভিষেক হয়েছিল তাঁর৷ নিজের প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন কলকাতার এই ব্যাটার। সেই সাথে গড়ে উঠেছিলেন দারুণ এক কীর্তি। ক্রিকেটের মক্কা খ্যাত ইংলিশ ভেন্যুতে এখন পর্যন্ত মাত্র তিনজন ক্রিকেটার অভিষেকেই শতকের দেখা পেয়েছেন, আর তাদের একজন হয়েই অনার্স বোর্ডে জায়গা পেয়েছে গাঙ্গুলির নাম।
ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে সৌরভ গাঙ্গুলি শুধু একজন সেরা খেলোয়াড়-ই ছিলেন না। ব্যাট হাতে রান তোলার পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবেও ভারতকে পথ দেখিয়েছেন। ক্রমাগত ব্যর্থতা, স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারি এবং হারের চক্রে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দলের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়ার পর শুধুই ইতিহাস রচনা করেছেন বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান। আক্রমণাত্মক অধিনায়কত্বে বদলে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটকে।
তার হাত ধরেই ভারত উঠে আসে ওডিআই র্যাংকিংয়ে দুই নম্বরে, টেস্টে তিনে। তৎকালীন সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া দলের সাথে কেবল গাঙ্গুলির ভারতই প্রতিযোগিতা করতে পারতো। অধিনায়ক হিসেবে গাঙ্গুলি’র তুলনা আসলে তিনি নিজেই। তাঁকে আধুনিক ভারতীয় ক্রিকেট বিপ্লবের মূল কাণ্ডারি বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হয় না।