কালকের শত্রু আজকের বন্ধু

কালকের শত্রু আজকের বন্ধু, লিভারপুলের দলবদলে ইদানিং এই প্রবণতাই লক্ষ করা যায়। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলেন ডারউইন নুনেজ। উরুগুয়ের এই খেলোয়াড় গত মৌসুমে বেনফিকার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অল রেডদের বিরুদ্ধে গোল করেছিলেন। আর তা করতে গিয়ে ভার্জিল ভ্যান ডাইককের রক্ষণকে যতটা সম্ভব বিচলিত করেছিলেন।

তবে, ডারউইনই লিভারপুলের একমাত্র খেলোয়াড় নন যিনি এই প্যাটার্ন অনুসরণ করেন। তাকুমি মিনামিনো রেড বুল সালজবার্গে থাকাকালীন লিভারপুলের বিপক্ষে গোল করেছিলেন যার মাত্র কয়েক মাস পরে তিনি অ্যানফিল্ডে চলে আসেন।

থিয়াগো আলকানতারা এবং ইব্রাহিমা কোনাটেও ইউরোপে যথাক্রমে বায়ার্ন মিউনিখ এবং আরবি লিপজিগের হয়ে মার্সিসাইডার্সের এই ক্লাবের বিপক্ষে খেলেছিলেন। জানুয়ারির দলবদলের বাজারে দলে ভেড়ানো লুইস দিয়াজ আগের মৌসুমে পোর্তোতে থাকাকালীন তার নতুন সতীর্থদের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন।

একজন খেলোয়াড়কে স্কাউট করার সর্বোত্তম উপায় হল তাদের কাছে থেকে দেখা। খ্যাতনামা অনেক খেলোয়াড়ের দলবদলই এমন প্রথা মেনে হয়েছে। আজকের আয়োজন তাঁদের নিয়ে যারা একসময় নিজেদের বর্তমান দলের বিপক্ষে খেলেছিলেন এবং মুগ্ধ করেছিলেন।

  • ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)

২০১৬ সালে ইউরো জেতার পর লিসবন ওয়েব সামিটে পর্তুগালের কোচ ফার্নান্দো সান্তোস বলেছিলেন, ‘তাঁকে দলে রেখে আমি অনুতপ্ত।’ খেলোয়াড়টি হলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। আর ম্যাচটা হল ২০০৩ সালের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-লিসবনের মধ্যকার ম্যাচ। এরপরই ১২.২ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে ইউনাইটেডে চলে যান সিআর সেভেন।

সান্তোস সেই সময়ে স্পোর্টিং লিসবনের ম্যানেজার ছিলেন। রেড ডেভিলদের বিরুদ্ধে প্রাক মৌসুম ম্যাচটিতে ৩-১ ব্যবধানে জয় পায় তার দল। তার কিশোর প্রডিজি এই ম্যাচে ও’শিয়া এবং ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রক্ষণকে ধূলিসাৎ জরে দেয়। রোনালদো পরবর্তীতে বলেন, ‘সেই রাতে আমি অবিশ্বাস্য খেলেছিলাম।’

ইউনাইটেডের খেলোয়াড়রা রোনালদোকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ‘একে আমরা দলে নিতে পারি না?’, স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে অনুরোধ করেন রিও ফার্ডিনান্ড। ফার্গি অবশ্য আগে থেকেই জানতেন রোনালদোর দক্ষতার ব্যাপারে। তবে, সেই পারফরম্যান্স তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলে। স্কটিশ এই ম্যানেজার সেই দিন চুক্তিটি সেই দিনই সম্পন্ন করেন। সান্তোস ১৩ বছর পরে সেই চুক্তির সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পান ইউরোর শিরোপা হাতে নিয়ে।

  • আলফ্রেডো ডি স্টেফানো (রিয়াল মাদ্রিদ)

১৯৫২ সালে হওয়া একটি ম্যাচে একজন খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সের কারণে স্প্যানিশ ক্লাব বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদ মুখোমুখি হয়েছিল দলবদলের বাজারে। পরবর্তীতে এই দলবদল ফুটবল ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দিয়েছিল। সেই খেলোয়াড় ছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। ম্যাচটিতে লস ব্লাঙ্কোসের বিপক্ষে কলোম্বিয়ান দল মিলোনারিওসের ৪-২ ব্যবধানে একটি বিস্ময়কর জয় ছিল, যেখানে ‘ব্লন্ড অ্যারো’ নামে খ্যাত ডি স্টেফানো দুবার গোল করেছিলেন।

প্রথম পদক্ষেপটি নেয় বার্সা, ডি স্টেফানোর পূর্ববর্তী ক্লাব রিভার প্লেটের সাথে তারা আলোচনা করে যে ক্লাবটি তার দলবদলের মূল অধিকারী ছিল। ১৯৪৯ সালে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের ডাকা ধর্মঘটের সময় আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় কলোম্বিয়ায় চলে গিয়েছিল। তবে, এর মধ্যেই মাদ্রিদ মিলোনারিওসের সাথে একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল যার হয়ে তিনি তখন খেলেছিলেন।

এই দুই ক্লাবের রেষারেষির মাঝখানে চাপা পরে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন। তারা তখন ফিফার কাছে সমাধান চায়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় এক মৌসুম মাদ্রিদ তো পরের মৌসুমে বার্সা – এইভাবে উভয় দলের হয়েই খেলবেন। এই শর্ত মানতে নারাজ বার্সেলোনা এই চুক্তি থেকে সরে আসে এবং ডি স্টেফানো স্পেনের রাজধানীর ক্লাবটির হয়ে ১১ বছরে আটটি লা লিগা শিরোপা এবং পাঁচটি ইউরোপিয়ান কাপ জিতেন। ইতিহাস একটু অন্যভাবে লেখা হলে হয়তো আজ রিয়াল নয় বার্সা কিংবদন্তি বলেই পরিচিত হতেন স্টেফানো।

  • উইলিয়ান (চেলসি)

২০১৩ সালের গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজারে ৩০ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে চেলসিতে আসার আগে উইলিয়ান অন্য একটি ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু কাটানো সময় অর্ধ মৌসুমেই সীমাবদ্ধ থাকে। এর কারণ হল চ্যাম্পিয়ন্স লিগে শাখতারের হয়ে চেলসির বিপক্ষে তার দুর্দান্ত পারফরমেন্স।

চেলসি ২০১২ সালের অক্টোবরে ইউক্রেনিয়ানদের কাছে ২-১ গোলে পরাজিত হয়েছিল, ফার্নান্দিনহোর জয় নিশ্চিত করা গোলটি উইলিয়ান বানিয়ে দিয়েছিলেন, দুই সপ্তাহ পর স্টামফোর্ড ব্রিজে ফিরতি লেগের ম্যাচে ভিক্টর মোজেসের প্রচেষ্টায় জিতেছিল চেলসি।

উইলিয়ান জানুয়ারিতে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে আঞ্জি মাকাচকালাতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরের গ্রীষ্মে রুশ ক্লাব আঞ্জি যখন তাদের সমস্ত তারকাদের বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন এই ব্রাজিলিয়ান চেলসিতে যোগ দেন। যদিও দলবদলের হাল দেখে অনেকেরই মনে হচ্ছিল প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব টটেনহ্যাম হবে তার ঠিকানা। কিন্তু চেলসি এই গতি তারকাকে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে নিয়ে আসে।

  • লিয়াম ব্র্যাডি (জুভেন্টাস)

ইতালিয়ান ক্লাবগুলির বিদেশি খেলোয়াড়দের দলে ভেড়ানোর উপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা দেশটির ফুটবল ফেডারেশনের। ১৬ বছর পর ১৯৮০ সালে সেটা প্রত্যাহার করা হয়। ‘সিরি ‘এ’-তে দু’টি মৌসুম শিরোপাহীন কাটানো জুভেন্টাসের ম্যানেজার জিওভানি ট্রাপাট্টোনি তখন পাঁচ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে আর্সেনালের মাঝমাঠের আইরিশ খেলোয়াড় লিয়াম ব্র্যাডিকে দলে ভেড়ান।

হাইবারির যুবদল থেকে উঠে আসার পর ১৯৭৯ সালে এফএ কাপ জিতেন এই ফুটবলার। ১৯৭৯-৮০ ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপের সেমি-ফাইনালে ওল্ড লেডিদের বিপক্ষে ব্র্যাডির পারফরম্যান্স ট্রাপাট্টনির নজর কেড়েছিল। তুরিনে যখন আর্সেনাল ১-০ জিতেছিল, তখন ম্যাচটিতে শুরু থেকে খেলেছিলেন ব্র্যাডি।

তাঁর সুন্দর খেলা ইতালিয়ান ক্লাবটির পর পর দুইবার শিরোপা জয়ের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছিল। ১৯৮২ সালে তিনি সাম্পদোরিয়ায় চলে যান অন্য একজন বিদেশিকে জায়গা ছেড়ে দিতে, এই বিদেশি ছিলেন মিশেল প্লাতিনি।

  • রায়ান গিগস (ম্যান ইউনাইটেড)

ওয়ান-ক্লাব ম্যান গিগস ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ২৪ টি গৌরবময় বছর কাটিয়ে রেকর্ড ৯৬৩ টি ম্যাচ খেলেছেন। তবে তাঁর ক্যারিয়ারের গল্পটা অন্য রকম হতে পারত। ১৩ বছর বয়সী এই ওয়েলশম্যান ম্যানচেস্টার সিটির নজরে ছিলেন।  সিটিজেনদের স্কাউট ডেনিস স্কোফিল্ড তাকে সম্ভাব্য তারকা হিসেবে চিহ্নিত করে।

ক্লাবটি তার বয়স ১৪ বছর হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল তা। দুর্ভাগ্য সিটির যে, গিগসকে নিউজ এজেন্ট হ্যারল্ড উডও দেখেছিলেন। তিনি ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের একজন স্টুয়ার্ড ছিলেন। হ্যারল্ড স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে প্রতিভাবান এই কিশোর সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন।

গিগসকে একটি ট্রায়ালের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ওল্ড ট্রাফোর্ডে। ইউনাইটেডের অনূর্ধ্ব ১৫-এর বিরুদ্ধে সালফোর্ড বয়েজের হয়ে খেলে হ্যাটট্রিক করেছিলেন তিনি। ফার্গুসনকে পরে টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘আমি একটা সোনার খনির দিকে তাকিয়ে আছি যেন।’ 

গিগসের ১৪ তম জন্মদিনে স্বয়ং স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন একটি চুক্তিপত্র নিয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাকিটা তো ইতিহাস!

  • মোহাম্মদ সালাহ (চেলসি)

আপনি কিভাবে একজন খেলোয়াড়কে আপনার দলের বিরুদ্ধে বারবার গোল করা বন্ধ করবেন? অবশ্যই তাকে নিজ দলে ভেড়ানোর মাধ্যমে। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে চেলসি মূলত এই কারণেই বাসেল থেকে ১১ মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে সালাহকে দলে টেনে ছিল।

আগের গ্রীষ্মে, স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে ম্যানেজার হিসেবে হোসে মরিনহোর ফিরে আসেন। পশ্চিম লন্ডনে পর্তুগিজ ম্যানেজারের অধীনে খেলা প্রথম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের খেলায় মরিনহোর দলের ২-১ ব্যবধানে পরাজয় এই সালাহ নিশ্চিত করেছিলেন নিজে গোল করে। ঠিক এক মাস পরে মিশরীয় এই কীর্তির পুনরাবৃত্তি করেন, সুইজারল্যান্ডেও জয়সূচক গোলটি তার পা থেকেই আসে।

এর দুই মাসেরও কম সময় পরে সালাহ চেলসিতে যোগ দেন। মরিনহো এ সম্পর্কে বলেন যে , ‘সালাহ চেলসির বিপক্ষে আর গোল করতে পারবে না যা একটি ভাল খবর।’ যদিও চেলসির জার্সিতে তাকে খুব কমই মাঠে নামতে দেখা গেছে।

  • ড্যানি ড্রিংকওয়াটার (লিস্টার)

তৎকালীন লিস্টারের ম্যানেজার ছিলেন নাইজেল পিয়ারসনের কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ড্যানি ড্রিংকওয়াটারকে দলে নেওয়ার আগে তাঁর ওপর দীর্ঘ সময় ধরে নজর রাখে লিস্টার সিটি।

২১ বছর বয়সী এই মঝমাঠের খেলোয়াড় তখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে বার্নসলিতে ধারে গিয়ে দুর্দান্ত খেলছিলেন। সেই বছর ১৮ জানুয়ারি এক মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে তাঁকে দলে নেয় লিস্টার সিটি। এর মাত্র ছয়দিন আগেই তিনি কিং পাওয়ার স্টেডিয়ামে লিস্টারের বিপক্ষেই এক অসাধারণ ম্যাচ কাটান। 

  • লুসিও (ইন্টার মিলান)

বায়ার্ন মিউনিখ এবং ইন্টার মিলানের মতো দলের হয়ে ইউরোপে বুন্দেসলিগা, সিরি ‘এ’ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা জেতার আগে লুসিওকে উদ্ভট পরিস্থিতিতে ব্রাজিলের এই ক্লাবের হয়ে তার অভিষেক হয়েছিল।

১৮ বছর বয়সী রক্ষণভাগের এই খেলোয়াড় নিজ শহরের ক্লাব প্লানাল্টিনায় ধারে গুয়ারায় খেলছিলেন। ১৯৯৭ সালের কোপা দো ব্রাসিলের প্রাথমিক রাউন্ডে তাঁর দল ৯০ মিনিটে হেভিওয়েট ইন্টার মিলানের কাছে হেরে যায় যা রক্ষণের বেশিরভাগ খেলোয়াড় ভুলে যেতে চাইবেন। কারণ ম্যাচটায় গুয়ারা হারে ৭-০ গোলে।

সেই ম্যাচেই নাকি লুসিওকে প্রথম মনে ধরে ইন্টারের। পারফরম্যান্সের পরে তাকে দলে ভিড়িয়েছিল ইতালিয়ান ক্লাবটি। লুসিও ব্রাজিলের হয়ে ১০৫ টি ম্যাচ খেলেন যার মধ্যে ২০০২ সালের বিশ্বকাপ জয়ও ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link