খান সাহেব মেহেরবান

জহির খান যতটুকুই আলোক রশ্মি ছড়িয়েছেন তার পুরোটাই নিজের কল্যাণে। মাঠে তাঁকে দিকনির্দেশনা বা সাহস জোগানোর মত কেউ ছিল না। তবুও নিজের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে তিনি ভারতের ক্রিকেটে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে রয়ে গেছেন।

একটা আক্ষেপে হয়ত ভারত দলকে ক’দিন আগেও পোড়াতো খুব। আহা একখানা খাসা বাঁ-হাতি পেসার নেই! এই বাঁ-হাতি পেসারের আক্ষেপটা বাড়িয়ে দেওয়ার পেছনের কারিগর ছিলেন জহির খান।

লম্বা একটা সময় ধরে তিনি ভারতের পেস আক্রমণকে আগলে রেখেছিলেন ছোট্ট এক শিশুর মত করেই। ঠিক সমমানের বিধ্বংসী একজনকে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে এসেও খুঁজে পায়নি ভারত। এখনও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করা নাম জহির খান।

ভারতের মহারাষ্ট্র্যের এক মফস্বল শহর শ্রীরামপুরে জন্ম জহির খানের। ৭ অক্টোবর ১৯৭৮ সালে তাঁর জন্ম। বাবা ছিলেন নিতান্ত সাধারণ একজন ব্যবসায়ী। স্থানীয় এক বাজারে ফটোগ্রাফি স্টুডিওর মালিক ছিলেন জহির খানের বাবা। তাঁর ছেলে পরবর্তী সময়ে বিশ্ব দাপিয়ে বেড়িয়েছে।

জিতে নিয়েছে ক্রিকেটের বিশ্বকাপ। খুব সহজেই হয়ত বলে ফেলা গেল কথাগুলো। কিন্তু এই পৃথিবীর আর বাকি সাফল্যের গল্পগুলোর মতই জহির খানের ক্যারিয়ারে রয়েছে বাঁধা। সম্ভবত বাঁধা ছাড়া সফলতার দেখা পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও স্বাদটা ঠিক মেলে না।

একবিংশ শতাব্দীর একেবারে প্রাক্কালে ভারতীয় ক্রিকেটের আলোর নিচে এসে পড়েন জহির খান। তবে সে আলোকে ছাপিয়ে নিজেই আলোর উৎসে পরিণত হন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে তিনি তখন ভারতের পছন্দের শীর্ষে। নজর কাড়তে অবশ্য তিনি শুরু করেছিলেন সাদা বলের ক্রিকেট দিয়ে।

২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। দুর্দান্ত ইনসুইং বোলিংয়ে তিনি পরাস্ত করেন অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার স্টিভ ওয়াহকে। আর সাথে সাথে গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে জানিয়ে দেন নিজের আগমনী বার্তা। এরপর অবশ্য তাঁকে কখনোই আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

তবে সীমাহীন দৃষ্টিতে হোঁচট খেয়েছেন বহুবার। পেসারদের জীবনে ইনজুরি যেন এক পরম বন্ধু। সময় নেই, অসময় নেই দুম করে হাজির হয়। জহির খানের ক্যারিয়ারেও সে বন্ধু প্রভাবটা ছিল চোখে পড়ার মতই।

এমনও সময় তিনি পার করেছেন যে সিরিজের প্রথম ম্যাচে তিনি থাকবেন অনুপস্থিত। কারণটা কোন না কোন ইনজুরি। তবে তাঁকে বেশি ভুগিয়েছে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি। তবে নাছোড়বান্দা গোছের ছিলেন জহির খান। নিজেকে প্রতিনিয়ত নতুন করে আবিষ্কার করে হলেও ক্রিকেটের সাথে থাকতে চেয়েছেন যুক্ত।

নিজের রান আপ ছোট করেছেন, বোলিং অ্যাকশনে পরিবর্তন এনেছেন। তবে ক্যারিয়ারের শেষ অবধি যেন ধার কমেনি তাঁর। প্রতিনিয়ত শেখার একটা প্রবল ইচ্ছে তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তিনি শিখেছেন, তিনি মাঠে তা ব্যবহার করেছেন। তুলে নিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটের বাঘা-বাঘা সব ব্যাটারদের উইকেট। ক্যারিয়ার জুড়ে একটা জায়গায় কখনোই যেন থিতু হতে চাননি জহির খান। যত রকমের স্কিল সম্ভব তিনি রপ্ত করবার চেষ্টা করেছেন।

তিনি পেসার হিসেবে খুব একটা যে গতিবান ছিলেন তা নয়। তবে নিজের ১৩০ কিলো/ঘন্টা গতিতেই তিনি কাবু করেছেন সবাইকে। সেখানে তাঁর প্রধান অস্ত্র ছিল পুরনো বলের রিভার্স সুইং। তাছাড়াও তিনি নতুন বলেও মুভমেন্ট করাতে সক্ষম ছিলেন জহির খান।

টেস্ট উইকেট বিবেচনায় তিনি বর্তমানে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক। তার উপর কেবল রয়েছেন ভারত ক্রিকেটের কিংবদন্তি কপিল দেব। ভারত ক্রিকেটের সবচেয়ে সফলতম অধিনায়ক ধরা হয় মহেন্দ্র সিং ধোনিকে।

ধোনির সফলতার যাত্রায় সম্মুখভাগ থেকেই অবদান রেখেছিলেন জহির খান। আরেক অবিসংবাদিত অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির সময়ে তাঁর আগমন ঘটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে রয়েছে ৩১১ খানা উইকেট রয়েছে।

ইনজুরি জর্জরিত ক্যারিয়ারে বেশ আগেভাগেই গুটিয়ে রাখতে হয় সাদা পোশাকটা। তবুও শেষ বেলায় তিনি তুলে নিয়েছিলেন নিজের ক্যারিয়ারের শেষ ফাইফার। এরপরও থেমে জাননি। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে খেলা চালিয়ে যান।

জহির খান যতটুকুই আলোক রশ্মি ছড়িয়েছেন তার পুরোটাই নিজের কল্যাণে। মাঠে তাঁকে দিকনির্দেশনা বা সাহস জোগানোর মত কেউ ছিল না। তবুও নিজের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে তিনি ভারতের ক্রিকেটে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে রয়ে গেছেন। আর ভারতকে আক্ষেপের সাগরে পুড়িয়ে গেছেন বল খানা দেয়াল ক্যাবিনেটে তুলে রেখে। জহির খানের মত কার্যকরী কাউকে তো এখনও পাওয়া যায়নি খুঁজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link