নব্বই দশকের শৈশবের শেষ পাতাটুকু ছিড়ে ২০১৩ সালে যখন শচীন বিদায় নেন তখন ভারতীয় ক্রিকেটের সামনে চ্যালেঞ্জ নতুন প্রজন্মকে খুজে বের করার।
অনেক আগেই সংগ ছেড়ে চলে গিয়েছে দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষ্ণণ। অবশ্য শচীন থাকাকালীনই পাঁচ-ছয়ে ব্যাট করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন তরুণ ভিরাট। ‘দেবতা’ যখন বিদায় নিলেন তখন মিডল অর্ডারে আরেক তরুণকে খোজার দায়িত্ব ভারতীয় বোর্ডের কাধে। অবশ্য সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই ক্লাসিক ব্যাটিংয়ের ছাপ রেখে ওই জায়গাটা অনেকটাই নিজের করে নিয়েছিলেন একজন। ২০১৪ তে যখন লর্ডসে সেঞ্চুরি করেন পাকাপাকিভাবেই পেয়ে গেলেন পাঁচ নম্বর জায়গাটা।
বুঝতেই পারছেন, কে এই তরুন। হ্যা, আজিঙ্কা রাহানে।
২০১৫ সালে যখন ভারত অস্ট্রেলিয়া গেল তখন ভিরাট এর সাথে জোট মিলিয়ে তুলোধনা করলেন অজি পেস অ্যাটাক। যদিও সিরিজের ফলটা সুখকর নয়। তার উপর আবার ‘ক্যাপ্টেন কুল’ টেস্টের কাপ্তানি ছেড়ে দিলেন। তখন ভারতের কাছে একদম তরুণ টেস্ট দল যার সেনাপতি রগচটা ভিরাট আর সহসেনাপতি শান্ত মস্তিষ্কের রাহানে।
তারপরই আসল সুখের দিন। লম্বা হোম সিরিজে ঘরের মাটিকে দূর্গ বানিয়ে একের পর এক পরাশক্তিকে বধ করল ভারত। থ্রি লায়ন্স, ব্ল্যাক ক্যাপ্স কিংবা প্রোটিয়া কেউই ছাড় পেলনা টেস্টে। রান আর রেকর্ড এর পাহাড় গড়তে লাগল রাহানে। সেনাপতি, সহসেনাপতি মিলে প্রায় নিংস্ব হয়ে যাওয়া অস্ত্রভাণ্ডারকে ভরে দিয়েছেন বিজয় পুজারা এবং নিজেদের ঢালসম ব্যাট আর অশ্বিন জাদেজার ঘূর্ণি তীরে। আর সেগুলোর সাহায্যে র্যাংকিংয়ে ৭ থেকে ১ নম্বরে নিয়ে আসেন দলকে। অভেদ্য দূর্গে অপরাজেয় শক্তি বানিয়েছে টিম ইন্ডিয়াকে। আর সে দল যেন শিবাজীরূপে ভিরাটকে আর তানহাজীরূপে রাহানেকে পেয়েছে।
কিন্তু এ গল্পে রোমাঞ্চ আসল ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। রাহানের ইঞ্জুরির জন্য ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজে দলে ডাক পেয়ে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে তিনশত রান করার কীর্তি গড়লেন করুণ নায়ার। তার আগের কয়েক ম্যাচে রাহানে একটু অফই ছিলেন। ২০১৫ এর বিশ্বকাপের পর থেকে রঙিন পোশাকে ইন অ্যান্ড আউট হিসেবেই চলছিল। ২০১৬ এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের পরাজয়ের জন্য যখন ওয়াংখেড়ের ফ্ল্যাট ট্র্যাকে রাহানের স্লো ব্যাটিংকে দায়ি করা হলো তখনই অনেকটা নিশ্চিত ছিল রঙিন পোশাকে তাকে আর দেখা যাবেনা।
সীমিত ওভারে দলের বাইরে, টেস্টেও লাস্ট সিরিজে দুই ম্যাচে রান নেই আর তার উপর এক ইয়াংস্টারের তিনশ। বাংলাদেশ সিরিজ আর বিশেষ করে তারপরেই আসা অস্ট্রেলিয়া সিরিজে পাঁচ নম্বরে কে খেলবে? তরুণ নায়ার নাকি অভিজ্ঞ রাহানে? বোর্ড, কোচিং স্টাফ, ম্যানেজমেন্ট আস্থা রাখলেন অভিজ্ঞতার উপর। প্রতিদান দিতেও সময় নিলেন না রাহানে; মারাঠা রক্ত বলে কথা।
২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়া এসেই যখন প্রথম ম্যাচে ভারতকে গুড়িয়ে দিল তখন অনেকেই ভেবেছিল সাম্রাজ্য বোধহয় শেষ। কিন্তু পরের দু ম্যাচে জয় আর ড্র দিয়ে আশা আবার ফিরিয়েছিল ভারত। তবে থার্ড টেস্টে খেলার সময় যখন ভিরাটের শোল্ডার ইঞ্জুরি হয় তখন মনের কোণে দূরাশা বাসা বেধেই নিয়েছে। কিন্তু মারাঠা রক্ত আবার বুঝিয়ে দিল তাকে ভরসা করা যায়।
সিরিজ ডিসাইডারে ক্যাপ্টেন হিসেবে রাহানে। তার নেতৃত্বে অনেকটা হেসে খেলেই জয় পেল ভারত আর তার সাথে আমার মনের মধ্যে একটা শট ও গেথে গেল। ১৪০+ স্পিড এ করা প্যাট কামিন্সের এক বলে ক্রিজ থেকে বাইরে এসে ফ্রন্টফুট প্রেস।
তবে এরপর শুরু হয় রানের আকাল। ২০১৮ থেকে শুরু হয় বিদেশ সফর। আর শুরুতেই হোচট খায় ভারত৷ দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ২-১ এ পরাজয় আর তার মূল কারণ ব্যাটিং বিপর্যয়। ৬ ইনিংসে ৪ বারই ২০০ এর নিচে অল আউট। তারপর ইংল্যান্ড সফর। এখানে ৪-১ এ পরাজয় আর মূল কারণ আবার সেই ব্যাটিং বিপর্যয়। ভিরাট ছাড়া কেউই সুবিধা করতে পারেননি। প্রশ্ন উঠল পুজারা-রাহেনেদের নিয়ে। এরপর আসল ২০১৮-১৯ এর বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফি। এই সফরের কথা তো ভারতীয় সাপোর্টাররা আমৃত্যু মনে রাখবে। নাতি নাতনিকে একবার হলেও শোনাবে প্রথমবারের মত অজি মাটিতে ক্যাংগারু বধের কাহিনি; ২-১ এর কাহিনি।
আহা! শুনলেই শান্তি লাগে৷ তবে এত আনন্দের মধ্যেও একজায়গায় বিষাদ থেকেই গেল। পুজারা রান পেলেও রাহানের ব্যাট চুপ।
এতগুলা ব্যর্থতার পরে স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়ার প্রশ্নের তীর সহসেনাপতির দিকে। প্রেস কনফারেন্সে তো অনেকে বলেই বসলেন ভিরাটকে-রঞ্জিতে তো ট্যালেন্টের অভাব দেখছিনা। রাহানের এরকম প্রদর্শনের পর কি পরবর্তীতে? তবে এসকল তীর আটকাতে রাহানের সামনে যেন ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন ভিরাট। সাংবাদিকদের উত্তরে বললেন, ‘জিংক্স (রাহানে) ছাড়া দল অসম্পূর্ণ।’
প্রায় দুবছর ঢাল হয়ে আস্থার সবটুকুই দেখিয়েছে বোর্ড। রাহানের ব্যাটে আলোর শিখাও ফুটল ক্যারিবিয়ান দ্বীপে।
তবে মিডিয়া আর সমর্থক এখনো থামেনি৷ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ভিরাট দেশে আসলে রাহানেকে ক্যাপ্টেনসি দেওয়া কি ঠিক নাকি থার্ড টেস্টে রোহিত আসার পর তাকে? বিতর্কটা প্রথমে অযৌক্তিক লাগলেও ভালই চলল। অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে এই বছরের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিও চলেও আসল। আর অ্যাডিলেডে প্রথম ম্যাচেই লজ্জা!
৩৬!
কানের কাছে ৩৬ বাজলেই যেন মনেহয় পায়ের নিচে মাটি নেই। দল যেন ধ্বংসস্তুপে। আর সেনাপতিও শিবির ছেড়ে দেশে। সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল, ৩৬ এর ধ্বনি, সেনাপতির বিদায়, মূল অস্ত্রদের ইঞ্জুরি সব মিলে মনেহলো এত গভীর খাদে কোনোকালেই পড়েনি দল; উঠে আসা অসম্ভব৷ আর এই অবস্থায় অস্থায়ী ক্যাপ্টেন হলেন রাহানে। মাথা যেন নুয়ে আছে এবার শুধু পড়ে যাওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু মারাঠা রক্ত যে হারতে জানেনি, মাথা নোয়াতে জানেনি, শেষবিন্দু পর্যন্ত লড়তে শিখেছে৷ এই দল নিয়েই, দুই অভিষিক্ত নিয়েই অজি ঔদ্ধত্যকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মেলবোর্ন জয় করল। আর জয়ের নেপথ্যে অনেক বছর চুপ থাকা, মাঝে জ্বলে ওঠা রাহানের ব্যাট আর পাশাপাশি অসাধারণ কাপ্তানি।
অনেকেই বলবে ‘সিরিজ তো শেষ হয়নি। আনন্দ,প্রশংসা বেশি হয়ে যাচ্ছেনা?’ জবাব, ‘না, সিরিজে হার এখনো সম্ভব কিন্তু এ আনন্দ, এ প্রশংসা তো শক্ত মনোবলের জন্য, গভীর খাদ থেকে উঠে আসার জন্য।’ এর আগে ভারত যখন ৪২ এ অলআউট হয়েছিল পরের ম্যাচে জুটেছিল ইনিংস হার। কিন্তু এবার ৩৬ এর লজ্জাকে পেছনে ফেলে প্রধান ঢাল-তলোয়ার ছাড়াই ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে জয়ের শংখধ্বনি বাজালো টিম ইন্ডিয়া। টিম এর ওরকম গুড়িয়ে যাওয়া থেকে কামব্যাক – শান্ত মাথায় এসব নেতৃত্ব দিয়ে পাল্টা-হামলার উদাহরণ হিসেবে থাকলেন সেই ‘অজিংকা রাহানে।’
রাহানের ক্যারিয়ার গ্রাফে অনেক চড়াই উতরাই-ই আছে। চড়াই এর সময় যেমন পেয়েছেন টিম ম্যানেজমেন্টের প্রশংসা; তেমনি উতরাই এ আস্থার ঢাল হাতে সামনে পেয়েছেন অধিনায়ক ভিরাট ও টিম ম্যানেজমেন্টকে। আর বরাবরই এ আস্থার প্রতিদান দিয়ে গেছেন। ম্যানেজমেন্ট,অধিনায়কের আস্থা আর রাহানের প্রতিদান; এ ভালবাসার গল্প প্রত্যেক ভারতীয় সাপোর্টারদের মনের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করবে আর বোঝাবে কাধে যদি কেও হাত রাখে তাকে কখনো মাটিতে মিশতে দেওয়া যাবেনা।