সত্তরের দশকে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলা বর্ডারে আগুন জ্বলছে। সে সময়ে কলকাতাতেও চলছে নকশাল আমল, তেলেঙ্গানাতে অন্ধ্রমহাসভার এক কৃষক খুনকে কেন্দ্র করে দানা বাঁধছে কৃষক আন্দোলন, নেহেরুগোষ্ঠীর ওপর বিতৃষ্ণা বাড়ছে সাধারণ জনগণের।
এই সময়ে পশ্চিম বাংলাতে একটা জিনিস খুব হতো, তা হল ‘ব্ল্যাক আউট’, সন্ধ্যের দিকে সারা শহরের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হত, ঘরে মোমবাতি জ্বালানোর ওপরও থাকত নিষেধাজ্ঞা- পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর বোম মারতে পারে এই আশঙ্কায় ভারতের পূর্বের রাজ্যগুলিতে ব্ল্যাকআউট হতো খুব। এই ব্ল্যাকআউটের সময় এনকাউন্টারে খুন হতো নকশালরা, সারা শহরে জারি হতো কারফিউ।
এত অন্ধকারের মধ্যেই হঠাৎ ছিটকে ওঠা বিদ্যুৎ হতে পেরেছিলেন পাঁচ ফুটের একটা মানুষ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে মার্শালের একটা বল সজোড়ে লাগল সুনীল গাভাস্কারের মাথায়, ননস্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়িয়ে মহিন্দর অমরনাথ। তখন হেলমেট ছিল না, ছিল না মাথা বাঁচানোর সেরকম কোনও শিরোস্ত্রাণ-ঠিক এখানেই হয়ত হেলমেটের চেয়ে অনেক উঁচুতে নিজের মাথাটাকে মেলে দিতে পেরেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার।
মাথায় বলের আঘাত এতটাই জোড়ে যে ‘ঠক’ করে একটা শব্দ শোনা গেল প্রেসবক্স থেকে। সকলে যখন ধরেই নিয়েছেন যে খেলা চালানো আর সম্ভব না ঠিক তখনই হাসি মুখে মার্শালের হাতে বলটা কুড়িয়ে ছুঁড়ে দিলেন গাভাস্কার। মহিন্দর অমরনাথ আশা করেছিলেন পরের বলটায় হয়ত একটা ‘ডু অর ডাই’ ট্রাই নেবেন গাভাস্কার মার্শালকে বাইরে পাঠানোর কিন্তু কোথায় কী? পরের একটা গুডলেংথ বল পা বাড়িয়ে আলতো করে স্ট্রোক করলেন গাভাস্কার। এক রান।
পরে মহিন্দর বলেছিলেন নিজের রাগ মেটানোর জন্য একটা ছক্কার চেয়ে তাঁর একটা সেঞ্চুরির মূল্য দলের কাছে অপরিসীম, এটা জানতেন গাভাস্কার, এখানেই যে গাভাস্কার একটা প্রজন্ম!
মুম্বাইয়ে হেমন্ত কাড়কাড়ের বাড়ির খুব কাছেই গাভাস্কারের ছেলেবেলার বাড়ি, একেবারে মধ্যবিত্ত এলাকা, আজ ফেসবুক-ইউটিউবের যুগে এত খেলোয়াড়ের বায়োপিক হয় অথচ গাভাস্কারের চেয়ে বর্ণময় জীবন হয়তো খুব বেশি নেই ভারতীয় ক্রিকেটে, ছিন্নমূল অবস্থা থেকে ক্রিকেটর সুপারস্টার হয়ে ওঠার গল্পটা একটা রূপকথা তো বটেই।
গাভাস্কারকে নিয়ে কেউ লিখবে না আজ। কারণ তিনি বিরাট কোহলি নন, গাভাস্কারকে নিয়ে লেখায় টিআরপি নেই কারণ তিনি মহেন্দ্র সিং ধোনি নন, গাভাস্কারকে বাঙালি দেওয়ালে স্থানও দেবে না কারণ তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি নন, অথচ সত্তরের উত্তপ্ত দিনগুলোয় ভারতের একমাত্র আশার আলো ছিল এই মানুষটার ব্যাটিং- অনেকে বলেন সত্তরের ভারতবর্ষের জয়-বীরু হলেন সুনীল-অমিতাভ!
বাঁচার রসদ অমিতাভের ছবি আর সুনীলের ব্যাটিং, ভাবতে অবাক লাগে এই গাভাস্কারই ভারতীয় ক্রিকেটে প্রথমবার আগুনে পেসের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের অলভিন কালীচরণ-মার্শাল-গার্নারদের সামনে একখণ্ড ভারতবর্ষ পাঁচ ফুট হাইট নিয়ে দাঁড়াত ক্রিজে, যে ভারতবর্ষ নিজের আত্মবিশ্বাসে অনায়াসে উপেক্ষা করতে পারত হেলমেটের প্রয়োজনীয়তা, এই গাভাস্কারের দখলে ততকালীন ক্রিকেটে ৩৪ টি সেঞ্চুরির অনন্য বিশ্ব রেকর্ড, প্রথম ১০০০০ রানের মাইলফলক, এই সুনীল মনোহর গাভাস্কার একমাত্র ব্যটসম্যান যার ঐ সর্বশ্রেষ্ঠ ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে ব্যাটিং গড় ৬৫.৩৬!
আবার একটা বিশ্বজয়ের সামনে ভারত, সুনীল সেই কবেই চলে গেছেন বাইশগজ ছেড়ে, তাঁর মুকুটের পালকে জমেছে ধুলো, তাঁর রেকর্ডের খাতায় একটু একটু করে থাবা বসয়েছেন তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী মারাঠি ক্রিকেট ঈশ্বর, আজ ফের দিল্লীর নবাব ভারতীয় ব্যাটিং পরম্পরার ব্যাটন তুলে নিয়েছেন কাঁধে- সময় পেরিয়ে যাবে কিন্তু গাভাস্কারের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে গেলেও তিনি আজন্ম থেকে যাবেন সুনীল গাভাস্কার হয়েই, তিনি থেকে যাবেন ভারতীয় ব্যাটিং-এর প্রথম সুপারস্টার হয়েই, তিনি থেকে যাবেন সত্তরের দশকে বিদেশে আগুনে পেসের সামনে লড়তে শেখানো এক জওয়ান হয়ে- ১৪০-১৪৫ কিমি প্রতিঘন্টার পেসের সামনেও গাভাস্কারের কোনোদিন হেলমেটের প্রয়োজন হয় নি, এখানেই প্রথমবার ভারতীয় ক্রিকেটের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
অভীক দা কতদিন আগে লিখেছিল- ‘মাথা কবেই গেছে কেটে, তবু উঁচিয়ে বাড়ি ফিরি’। খুব মনে পড়ে কথাটা, এই সুনীল মনোহর গাভাস্কর সেই লোকটা যার মাথা নীচু হয়নি বিশ্বের কোনো বোলিং আক্রমণের সামনেই, এখানেই সারা পৃথিবীর কাছে প্রথমবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল আমার দেশ, আমার পাঁচফুট পাঁচ ইঞ্চির ভারতবর্ষ!