লুসাইল স্টেডিয়ামের আকাশে উড়ছিল ফ্যালকন এফ-১৬ জেট বিমান। অন্যদিকে স্টেডিয়ামে গোল উদযাপন করছিলেন ৬০ হাজার ব্রাজিল সমর্থক। আচ্ছা, কার আওয়াজ বেশি ছিল?
সার্বিয়ার বিপক্ষে বিশ্বকাপের নিজেদের প্রথম ম্যাচে রিচার্লিসনের দ্বিতীয় গোলের পর প্রশ্নের উত্তরটা জেনে যান সবাই। লুসাইল স্টেডিয়াম তখন পরিণত হয়েছে হলুদ জন সমুদ্রে, জেট বিমানের আওয়াজ যেন তখন মিলিয়ে গেছে শূন্যেই।
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে লুসাইল স্টেডিয়াম প্রস্তুত হচ্ছিল বহুদিন ধরেই। নানা ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং কনসার্টও আয়োজন করা হয়েছিল এই স্টেডিয়ামে। তবে দর্শক উন্মাদনায় পূর্বের সব কীর্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছেন ব্রাজিলের সমর্থকরা। সার্বিয়ার ক্রমাগত ফাউলের পরও ব্রাজিল তাঁদের নান্দনিক ফুটবল থামায়নি, বরং গতি বাড়িয়েছে। স্টেডিয়ামে থাকা দর্শকরাও তাই উৎসব করে গিয়েছেন পুরো ম্যাচজুড়েই।
বলা হয়ে থাকে বাকি দশ দেশের চাইতে আলাদা ব্রাজিলের ফুটবল। ঈশ্বরের সমতুল্য হিসেবে দেখা হয় ফুটবল তারকাদের। পিতা-মাতারা চান ছেলেমেয়ে বড় হয়ে ফুটবলটাই আঁকড়ে ধরুক, মাঠে ঝড় তুলুক নেইমার, ভিনিসিয়াস, রদ্রিগো হয়েই।
বিশ্বব্যাপী তাই ব্রাজিলের সমর্থক তাই বাকি সব দেশ থেকে বেশিই। ব্রাজিলের ফুটবলে মোহাবিষ্ট হয়ে তাই সাত সমুদ্র তেরো নদী ওপারের কেরালাতে ব্রাজিলের ম্যুরাল তৈরি হয়, ম্যাচের পর আনন্দ উৎসব হয় পাকিস্তানের লিয়ারিতে। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো কাতারের রাজধানী দোহাও।
দোহার স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকা বেশিরভাগ সমর্থকই তাই ব্রাজিলিয়ান ছিলেন না, বরং ছিলেন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা ব্রাজিল সমর্থক। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম তাদেরকে ‘ভণ্ড সমর্থক’ আখ্যা দিলেও, তারা সত্যিকার অর্থেই ভালোবেসেছেন ব্রাজিলের ফুটবলটাকে।
সেলেসাওদের প্রতি তাদের আবেগ কিংবা আত্ননিবেদনে কোনো ঘাটতি নেই। বরং আছে নিখাদ অনুরাগ, ভালোবাসা। ব্রাজিলের প্রতিটি গোল ভুলিয়ে দেয় তাদের জীবনের সমস্ত ক্লেদ, দু:খ।
তাছাড়া বিশ্বকাপের সফলতম দলটার নামও ব্রাজিল। সর্বোচ্চ পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতার পাশাপাশি দুইবার রানার্স আপ হয়েছে তারা। এছাড়া তৃতীয় হয়ে শেষ করেছে দুইবার। অবশ্যই তাদের সাফল্য সমর্থক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, তবে বেশিরভাগ সমর্থকই ব্রাজিলকে ভালোবেসেছেন তাদের খেলার ধরণের জন্য, সৌন্দর্য্যটাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য।
আশিক নামের কেরালার এক সমর্থক বলেন, ‘তাদের খেলার ধরণটা অসাধারণ। গতি, আক্রমণ, গোলগুলো দেখার মত হয়েছে। আমার মনে পড়ে না আমি কবে থেকে ব্রাজিল সমর্থক করি। তবে ভাগ্যিস আমি অন্য কোনো দলের খেলার প্রেমে পড়িনি!’
জর্ডানের ল্যায়েথ অবশ্য জানালেন তিনি তরুণ বয়স থেকেই ব্রাজিলের ভক্ত। তিনি বলেন, ‘আমরা একদম তরুণ বয়স থেকেই ব্রাজিলের খেলা দেখে বেড়ে উঠছি। তাদের খেলার স্টাইল, আক্রমণের কৌশল অনবদ্য। রিচার্লিসনের দ্বিতীয় গোলটা দেখেছেন? আমি বাজি ধরে বলতে পারি বিশ্বের অন্য কোনো দল ওই রকম গোল করতে পারবে না। কেবল ব্রাজিলই পারবে এটা করতে।’
কারিনা এবং মেরারি নামের দুই মেক্সিকান বন্ধু কাতারে এসেছেন ব্রাজিলের সমর্থনে। মেক্সিকো জাতীয় দল এবারের বিশ্বকাপে থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিলের ফুটবলের প্রতি তাদের প্রেম বাধ্য করেছে হলুদ জার্সিতে স্টেডিয়ামে আসতে।
কারিনা বলেন, ‘ব্যাপারটা স্রেফ ফুটবলের। আমি ব্রাজিল পছন্দ করি, বিশেষ করে তাদের তারকা ফুটবলাররা অসাধারণ খেলেন। আমরা মেক্সিকান, তবে ফুটবলটাই বেশি পছন্দ করি। সেই কারণেই ব্রাজিলের ম্যাচ দেখতে আসা।’
বিশ্বব্যাপী মানুষের এই ব্রাজিলপ্রীতি অবাক করেছে স্বয়ং ব্রাজিলিয়ানদের। জুলিয়ানা নামের এক ব্রাজিলিয়ান বলেন, ‘দারুণ ব্যাপার যে আমাদের দলটা বিশ্বব্যাপী দারুণ জনপ্রিয়। চমৎকার ফুটবলে প্রদর্শনীর প্রভাব এটা। আমরা দেখছি অনেক ভিনদেশি নাগরিকই ব্রাজিলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য।’
২০০২ বিশ্বকাপের পর শিরোপা জিততে পারেনি ব্রাজিল। শেষবার ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে সেমিফাইনাল খেলেছিল তারা। যদিও জার্মানি এবং নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে চতুর্থ হয়েই শেষ করতে হয়েছিল সেবার।
সেই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল তাই দর্শকদের জন্য সুখের মুহূর্তের জন্ম দেয় না। ভক্তরা আশা করছেন এবার মরুর বুকে সাম্বা নাচের উপলক্ষ বয়ে আনবেন নেইমার-রিচার্লিসনরা।