আঙুলের ইশারায় ক্রিকেট নাচে

ক্রিকেট মাঠে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই ২২ জন ক্রিকেটারের পাশাপাশি আরো অনেকেই অংশগ্রহণ করে। ২২ খেলোয়াড়ের পাশে খেলার খুব গুরুত্বপূর্ণ দুই চরিত্র হলেন আম্পায়ার। যারা কিনা ক্রিকেট মাঠের প্রত্যেকটি ঘটনা খুব সুক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

একটি টেস্ট ম্যাচে প্রতিদিন ৯০ ওভার মাঠে থাকেন একজন আম্পায়ার। আর ওয়ানডেতে প্রায় ১০০ ওভার মাঠে থাকতে হয় তাঁদেরকে। দীর্ঘ সময় মাঠে দাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করার কঠিন কাজটিই করে থাকেন আম্পায়াররা।

আম্পায়াররা ক্রিকেটকে স্বচ্ছ করার কাজটি করে থাকেন। তাঁদের একটি ভুল সিদ্ধান্ত পারে খেলার গতিপথ বদলে দিতে। আর এই কারণে আম্পায়ারদের ম্যাচ পরিচালনার সময় শারিরীক এবং মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হয়। ক্রিকেট মাঠে কোনো ক্রিকেটার ভালো পারফর্ম করলে তাঁদেরকে মনে রাখতে পারি। কিন্তু আম্পায়াররা যদি মাঠে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে ভালো পারফর্ম করে তারপরও আমরা তাদেরকে মনে রাখতে পারি না। তাঁরা থেকে যান মানুষের চেনা জানার বাইরে।

কয়েক জন দুনিয়া খ্যাত আম্পায়ার সম্পর্কে জানবো আমরা।

  • ডিকি বার্ড (ইংল্যান্ড)

আসল নাম ছিলো হ্যারোল্ড ডেনিস বার্ড। কিন্তু সেই নামটা হারিয়ে গিয়েছিলো। ডিকি বার্ড নামে পরিচিত তিনি। তিনি ছিলেন একজন স্কুল ড্রপ আউট। বোর্ড পরীক্ষায় ফেল করে বাবার সাথে কয়লা খনিতে কাজ শুরু করেন বার্ড।এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন খেলাধুলায় আসবেন।

তাঁর ইচ্ছা ছিলো ফুটবল খেলবেন কিন্তু ইনজুরি সমস্যার কারনে ফুটবল খেলতে পারেননি। ফুটবলে খেলতে না পেরে পরে আসেন ক্রিকেটে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ইয়র্কশায়ার এবং লেস্টারশায়ারের হয়ে খেলেছেন। ক্রিকেটার জীবনের শেষে কোচিং কে ক্যারিয়ার হিসেবে নেন। কিন্তু এই পেশায় খুব বেশি দিন থাকেননি। কোচিং পেশা ছেড়ে যোগ দেন আম্পায়ারিংয়ে।

তিন বছর কাউন্টি ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করার পর আইসিসির আম্পায়ার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। এরপর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৬৬ টেস্ট ম্যাচ এবং ৬৯ টি ওয়ানডে পরিচালনা করেন। এছাড়াও ১৯৭৫, ১৯৭৯ এবং ১৯৮৩ বিশ্বকাপের ফাইনালে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

  • ডেভিড শেপার্ড (ইংল্যান্ড)

ডেভিড শেপার্ড ছিলেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ও শ্রদ্ধেয় আম্পায়ার। ক্যারিয়ারের দীর্ঘ ১৪ বছর খেলেছেন গ্লস্টারশায়ার। তিনি ছিলেন একজন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে। কাউন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর ১৯৮১ সালে আম্পায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন।

 

আম্পায়ার হিসেবে তাঁর উন্নতি ছিলো অনেক দ্রুত। তাঁকে বিবেচনা করা হত একজন অন্যতম প্রতিশ্রুতিশীল আম্পায়ার হিসেবে। ১৯৯৬, ১৯৯৯, এবং ২০০৩ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেছিলেন ডেভিড শেপার্ড। আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে ১৭২ টি ওয়ানডে এবং ৯২ টি টেস্ট পরিচালনা করেন।

আইসিসি নিরপেক্ষ আম্পায়ারদের নিয়ে প্রথম প্যানেল গঠন করলে সেই প্যানেলের আম্পায়ার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ক্যারিয়ারের শেষ বছর পর্যন্ত প্যানেল আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান।

  • স্টিভ বাকনর (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

এখন পর্যন্ত সবেচেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আম্পায়ার হলেন স্টিভ অ্যান্থনি বাকনার। ঠিক ২০ বছর আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ফুটবল ম্যাচ পরিচালনা করার রেকর্ডও আছে তাঁর।

বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে ফুটবল ম্যাচে রেফারি ছিলেন। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী কোনো রেফারি ৪৫ বছরের বেশি হলে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়। এই নিয়মানুযায়ী ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবলে রেফারিং করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচও পরিচালনা করেছেন স্টিভ বাকনার। রেফারিং কিংবা আম্পায়ারিং পেশায় আসার আগে তিনি ছিলেন একটি স্কুলের গণিত শিক্ষক। এছাড়াও ওই স্কুলের কোচ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। রেফারিং ক্যারিয়ার শেষে আম্পায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কারণ নিজের শহরে তাঁর ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা ছিলো।

আম্পায়ার হিসেবে ১২৮ টেস্ট এবং ১৮১ ওয়ানডেতে দাড়িয়েছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে আম্পায়ার হিসেবে শেষবারের মত মাঠে দাড়ান বাকনার। এছাড়াও শুরু থেকেই আইসিসির এলিট প্যানেলের আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকদের কাছে তিনি অবশ্য খলনায়ক হিসেবে পরিচিত। ২০০৩ সালে ব্রিসবেনে শচীন টেন্ডুলকারকে একটি ভুল সিদ্ধান্ত দেয়ার কারণে তিনি ভারতীয়দের কাছে খলনায়ক হিসেবে পরিচিত পান। এছাড়াও ২০০৩, ২০০৪ সালেও একই কাজ করেন স্টিভ বাকনার। ২০০৮ সালে সিডনি টেস্টে তাঁর একটি সিদ্ধান্ত ম্যাচ ভারতীয়দের বিপক্ষে যায়। এর ফলে আইসিসি তাঁর উপর থেকে কাজের চাপ কমিয়ে নেয়। বিভিন্ন কারনে ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০০৮ অস্ট্রেলিয়া ভারত সিরিজে নিষিদ্ধ করে। এত কিছুর পরও স্টিভ বাকনার সেরা আম্পায়ারদের তালিকায় বেশ উপরের দিকে থাকবেন।

স্টিভ বাকনার ১৯৯২, ১৯৯৬, ১৯৯৯, ২০০৩ এবং ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যা কিনা আম্পায়ার হিসেবে একটি রেকর্ড।

  • সাইমন টফেল (অস্ট্রেলিয়া)

পেশাদার ক্রিকেটে বলার মত কিছুই নেই সাইমন টোফেলের। ইনজুরির কারণে তিনি ক্রিকেট খেলতে পারেন নি। টফেল ভাবতে পারেননি তিনি আম্পায়ার হিসেবে কাজ করতে পারবেন। ক্রিকেট খেলতে না পেরে ট্রমার মধ্যে ছিলেন তিনি। তখন তাঁর বন্ধু তাঁকে আম্পায়ারিং করার পরামর্শ দেয়, আর তখন থেকেই আম্পায়রিং এর দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।

আইসিসি এলিট প্যানেলের শুরু থেকেই এলিট আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন টফেল। ২০০৪ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পরপর সেরা আম্পায়ার হিসেবে স্বীকৃতি পান। ১৯৯৯ সালে তাঁর ২৮তম জন্মদিনের আট দিন আগে আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হিসেবে ম্যাচ পরিচালনা করার প্রথম সুযোগ পান। ২০০০ সালে আম্পায়ার হিসেবে প্রথম টেস্ট ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ পান।

 

সবচেয়ে কম বয়সী আম্পায়ার হিসেবে ১০০তম ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ পান টোফেল। অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে দাপটের সময়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ পাননি। চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও সুযোগ পাননি নিজ দেশের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ। তিনি ২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং ২০১১ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন।

আম্পায়ার হিসেবে ৭৪ টেস্ট, ১৭৪ ওয়ানডে এবং ৩৪ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ২০০৯ সালে পাকিস্তানে শ্রীলংকা দলের উপর সন্ত্রাসী হামলায় শিকার হয়েছিলেন সাইমন টফেলও। ২০১২ সালে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান সাইমন টফেল।

  • আলিম দার (পাকিস্তান)

আলিম দার এই সময়ের সেরা আম্পায়ার। তিনি ১৩৪ টেস্ট, ২১১ ওয়ানডে এবং ৪৯ টি-টূয়েন্টিতে দায়িত্ব পালন করেছেন। আম্পায়ার হিসেবে ক্যারিয়ারে অভিষেক ২০০০ সালে। তিনি আম্পায়ার হিসেবে ২০০৬ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ২০০৭ এবং ২০১১ বিশ্বকাপ এবং ২০১০ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০০২ সালে আইসিসির এলিট প্যানেলের আম্পায়ার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তিনি। আন্তর্জাতিক ম্যাচের পাশাপাশি বিভিন্ন ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক লিগেও আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

  • রুডি কোয়ের্টজেন (দক্ষিণ আফ্রিকা)

আম্পায়ার হিসেবে তিনি ১০৮ টেস্ট,  ২০৬ ওয়ানডে এবং ১৪ টি-টুয়েন্টিতে দায়িত্ব পালন করেন। আম্পায়ারিং ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৮১ সালে। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সূচনা হয় ১৯৯২ সালে। অনেক সময় নিয়ে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে দাড়িয়েছেন কোয়ের্টজেন।

১৯৯৭ সালে আইসিসি তাঁকে পূর্ণ সময়ের জন্য আম্পায়ার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ১৯৯৯ সালে কয়েকবার ফিক্সিংয়ের অভি্যোগ পেয়েছিলেন কোয়ের্টজেন। কিন্তু তিনি তা বেশ সাহসিকতার মাধ্যমে ফিরিয়ে দেন। আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের অনেক চড়াই উৎরাই পার করেছেন ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। প্রোটিয়া ক্রিকেটার হ্যান্সি ক্রনিয়ের ফিক্সিং কেলেঙ্কারির জন্য তাঁকে প্রচুর সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।

২০০৩ এবং ২০০৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১০ সালে আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান কোর্টজেন।

  • বিলি বাউডেন (নিউজিল্যান্ড)

বিলি অধিক সমাদৃত তাঁর অদ্ভুত ভঙ্গির সব সংকেতের কারণে। ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আম্পায়ারিংয়ের শুরু হয়। ২০০০ সালে প্রথমবারের মত টেস্টে আম্পায়ারিং করার সুযোগ পান বিলি বাউডেন।

২০০২ সালে আইসিসির এলিট প্যানেলের আম্পায়ার হিসেবে সু্যোগ পান।আম্পায়ার হিসেবে ৮৪ টেস্ট, ২০০ ওয়ানডে এবং ২৪ টি-টুয়েন্টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারের ইতি টানেন তিনি।

  • ড্যারিল হারপার (অস্ট্রেলিয়া)

ডারিল হারপার ১৯৮৭ সালে আম্পায়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে নিযুক্ত হন আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হিসেবে।

আম্পায়ারিং ক্যারিয়ারে ৯৪ টেস্ট, ১৭৪ ওয়ানডে এবং ১০ টি-টুয়েন্টিতে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সালে টেস্ট আম্পায়ার হিসেবে অভিষেক ঘটে হারপারের। ২০০২ সাল থেকে ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত এলিট আম্পায়ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে আম্পায়ারিং ক্যারিয়াকে বিদায় জানান ডারিল হারপার।

লেখক পরিচিতি

খেলাকে ভালোবেসে কি-বোর্ডেই ঝড় তুলি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link