প্রায় দেড়টা দশক হতে চলল। এই প্রায় পনেরো বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের শুরুটা করে দেন তামিম ইকবাল। চট্টগ্রামের খান বাড়ির ছেলে। দৃঢ় চিত্তে তিনি প্রতিবার যেন নেমেছেন প্রতিপক্ষের শত প্রতিঘাতের জবাব দেবেন বলে। সাদা পোশাক গায়ে জড়িয়ে সেই ২০০৮ থেকে তিনি নিয়ম করে নেমেছেন বাইশ গজে। সকাল সকাল সূর্যের তাপ প্রখর হওয়ার আগেই তিনি প্রখরতা ছড়িয়েছেন সবুজ ঘাসে।
দীর্ঘ এত বড় এক যাত্রায় কতই না অর্জন তাঁর নামের পাশে যুক্ত হয়েছে। সে সবের মাঝে নিশ্চয়ই লর্ডসে করা শতকটা বারেবারে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চোখের সামনে। অথবা খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে করা দ্বিশতকটাও নিশ্চয়ই দারুণ এক আনন্দ দেয়। সে দিনগুলোর কথা মনে করে অবসর সময়টা কাটিয়ে দেন তামিম।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানের একটা বড় জায়গা জুড়ে সবসময়ই ছিলেন তিনি। ২০০৮ সালের ১৯ বছরের এক ছোকড়া এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অন্যতম ভরসার স্তম্ভ। আমরা এখন অবধি তাঁর কোন বিকল্প খুঁজে পাইনি। নিজের সামর্থ্য আর চেষ্টার পুরোটা নিঙড়ে দিয়ে তিনি সে জায়গাটা করে নিয়েছেন। বাইশ গজে একপ্রান্তে তিনি যেন ধ্রুব এক সত্ত্বা।
নিজের প্রথম টেস্ট ইনিংসে তিনি সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন জুনায়েদ সিদ্দিকিকে। এরপর থেকে তিনি একপ্রান্তে নিজের মত করে খেলে গেছেন, আস্থার প্রতিদান দিয়ে গেছেন। আর অপরপ্রান্তে সময়ে সময়ে নতুন সব মুখের আগমন ঘটেছে।
তামিম তো দূরে থাক আমরা মাঝে মাঝে তামিমের সঙ্গী সংকটে ভুগী। তাইতো মুমিনুল হকের সাথে ওপেনিং করা অভিজ্ঞতা হয় তামিমের। এছাড়াও আরও এগারোজন ভিন্ন ব্যাটারের সাথে ইনিংস শুরু মত চ্যালেঞ্জিং কাজটা কর গেছেন তামিম ইকবাল খান।
৬৬ টেস্টের ক্যারিয়ারে তিনি বার জন নতুন সঙ্গী পেয়েছেন। টেস্ট ক্রিকেটের ইনিংস শুরুটা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা নিশ্চয়ই আর খুব খোলাসা করে বলার কিছু নেই। সে কঠিন কাজটায় তাঁর সাথে সবচেয়ে বেশি সময় ছিলেন আরেক বা-হাতি ওপেনার ইমরুল কায়েস। দুইজনে মিলে শুরু করেছেন ৫৩টি ইনিংস। এই ৫৩ ইনিংসে দুইজনের ব্যাট থেকে এসেছে মোট ২৩৩৬ রান।
এমনকি এক ইনিংসে রানের বিচারে এই জুটির জুড়ি মেলা ভার। তিনটি সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ডটা তামিম-ইমরুল রেখেছেন নিজেদের দখলে। সর্বোচ্চ ৩১২ রান তাঁরা দু’জনে মিলে জড়ো করেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। ২০১৫ সালে খুলনায় হওয়া সে টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে এই তামিম ও ইমরুলের ব্যাটিং দৃঢ়তায় ম্যাচটি ড্র করেছিল বাংলাদেশ। তাছাড়া চারটি শত রানের জুটিও রয়েছে তাঁদের নামের পাশে।
ইমরুলের পর তামিম সর্বোচ্চ ১৪টি ইনিংসের সূচনা করেছিলেন সৌম্য সরকারকে সাথে নিয়ে। সৌম-তামিম জুটির সব মিলিয়ে সংগ্রহ ৫১২ রান। মাত্র একটিবার শতরানে জুটি গড়তে পেরেছিলেন তামিম-সৌম। সেটা আবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। ২০১৭ সালে গল টেস্টে দুইজন মিলিয়ে ওপেনিংয়ে রান করেছিলেন ১১৮ রান। সৌম্য ছাড়া খানিক লম্বা সময় তামিমের সঙ্গী হয়েছিলেন জুনায়েদ সিদ্দিকি ও শামসুর রহমান।
এই দুইজনের সাথে ভিন্ন সময়ে ১২ খানা ইনিংসের গোড়াপত্তন করেছিলেন তামিম ইকবাল খান। ক্যারিয়ারের শুরুতে মানসিক দৃঢ়তা গড়ে দিতে তামিমকে সহয়তা করেছিলেন জুনায়েদ সিদ্দিকি। তবে সে সময়টা বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে রীতিমত খাবি খাওয়া এক দল ছিল। ১৬১ রানে এক জুটি ছাড়া আর বেশিকিছু করতে পারেনি তামিম-জুনায়াদের ওপেনিং জুটি। শামসুর রহমানের সাথে বলার মত তেমন কিছু নেই। সাদা-মাটা এক সময় পার করেছিলেন তামিম।
মাঝে জহুরুল ইসলাম, এনামুল হক বিজয়, নাজিমউদ্দিনরা যুক্ত হয়েছিলেন। এসেছিলেন তামিমকে সঙ্গ দিতে। তবে তাঁদের কাছ থেকেও আশান্বরুপ কোন ফল পাওয়া যায়নি। তাই ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে তাদেরকে ছেড়ে দিতে হয়েছে বাংলাদেশের ‘এলিট’ দলের ওপেনিং স্থান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যেন বাংলাদেশ হন্যে হয়ে খুঁজেছে তামিমের যোগ্য সঙ্গী। তাইতো গেল বছর তিনেকের মধ্যে সাদমান ইসলাম, সাইফ হাসান, লিটন দাস থেকে শুরু করে সর্বশেষ তামিমের সাথে যুক্ত হয়েছেন মাহমুদুল হাসান জয়।
সবাই হয়ত আশা জাগিয়েছিল। তরুণ ক্রিকেটার হিসেবে একটু বাড়তি আলো কেড়ে নিতে পেরেছিল। তবে তারাও যেন ব্যর্থ। তাঁদের সাথেও তামিমের লেখা হয়নি কোন মহাকাব্য। লিটন দারুণ একজন ব্যাটার হলেও টেস্ট দলে তিনি বিবেচিত হন লোয়ার মিডল অর্ডারে। তাই তামিমের সঙ্গী খুঁজতে মাহমুদুল হাসান জয়কে বাজিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বেশ ভালই করছেন। তাঁর উপর আস্থা তো রাখতেই হচ্ছে।
এত আসা-যাওয়ার মাঝেও নিজের অবস্থানের অনড় থেকেছেন চট্টগ্রামের খান সাহেব। তিনি যেন সব সময় বলে গেছেন আমি আছি। আমি থাকছি। কিন্তু একটা প্রশ্ন ইদানিং বেশ খোঁচা দিচ্ছে সবার মনেই। তামিম যখন থাকবেন না তখন আমরা কি করব? তখন বাংলাদেশের ওপেনিংয়ের দায়িত্বটা সামলাবেন কে?