খাদের কিনারা থেকে ফেরা সেই ইতালি

সৃষ্টিকর্তা নাকি মানুষকে তার খারাপ সময় দেন নিজেকে শুধরাতে। কোন ভুল ত্রুটি থাকলে সেটি থেকে পরিত্রান পেতে। কিন্তু এই সময়টাকে সবাই কাজে লাগাতে পারেনা। যেমন করে ইতালি লাগিয়েছেন সেটি খুব কম দেশই রয়েছে যারা পারেন। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের কথা ফুটবলপ্রেমীদের ভুলে যাবার কথা নয়।

নিজ মহাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বসেরার আসরটির বাছাইপর্বের গণ্ডি পার হতে পারেনি আজ্জুরিরা! তিন বছর আগের ঘটনাকে তাই ভুলে যাবার কথা নয়। দেশটির ফুটবলপ্রেমীদের মাঝে সে সময় কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে বিশ্বকাপে খেলতে না পারাটাকে সে সময় দেশটির ফুটবলের জন্য বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। ইতালির ফুটবলের ৬০ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি।

ব্যর্থতা কাটাতে এরপর ঢেলে সাজানোর কোন বিকল্প ছিলনা। সেটাই করল দেশটির ফুটবল ফেডারেশন। ইংল্যান্ডে ক্লাব ফুটবলে কোচিং করানো রবার্তো ম্যানচিনিকে ধ্বংসস্তুপ থেকে টেনে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরের গল্পটা ইউরো ২০২০ টুর্নামেন্টের কল্যানে সবাই এরই মধ্যে জেনে গেছেন। ফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৩-২ গোলে পরাজিত করে ৫৩ বছর পর শিরোপা পুনরুদ্ধার করার পর আলোচনাটা একটু বেশিই হচ্ছে।

অনেকটা রুপকথার গল্পের মতোই প্রত্যাবর্তন হয়েছে ইতালির। নিজেদের ফুটবল রেনেসা ফিরে পাওয়াটাকেই বড় সাফল্য হিসেবে দেখছেন দেশটির ফুটবল বিশ্লেষকরা। রাশিয়া বিশ্বকাপ খেলতে না পারা দেশটিই এখন ইউরোপ সেরা। একইদিন কোপা আমেরিকা ও ইউরোর ফাইনালে দুটি ভিন্ন মহাদেশে উড়েছে আকাশী আর নীল পতাকা।

সকালে আর্জেন্টিনা আর মধ্যরাতে ইতালির শ্রেষ্ঠত্বে আপাত সমাপ্ত হলো দুটি বড় ফুটবল উৎসবের। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভরা গ্যালারীতে অনেকটা প্রতিকুল পরিস্থিতিতে খেলেই শিরোপা জয় করে রবার্তো ম্যানচিনির দল। যেখানে আরেকবারের মতো ব্যর্থ মনোরথে ফিরে যেতে হয়েছে গ্যারেথ সাউথগেটের শীষ্যদের।

৫৫ বছর পর কোন বড় আসরের ফাইনালে খেললেও শিরোপা জেতা হয়নি স্বাগতিক দলের। নির্ধারিত সময়ে খেলা ১-১ গোলে ড্রয়ের পর খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। সেই সময়েও কোন গোল না হওয়ায় খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। পাঁচ শটের এই লড়াইয়ে ৩-২ ব্যবধানে জিতে শিরোপা নিয়ে বাড়ি ফেরে ইতালি।

সময়ের হিসাবে ৫৫ বছর পর ফাইনালে ওঠে শিরোপা জিততে না পারার হ্যারি কেনের দলের শিরোপা জয়ের অপেক্ষাটা আরও দীর্ঘ হলো। ’হোমে’ না ফিরে শিরোপা চলে গেল ‘রোমে’। ইউরোতে এটি ইতালীয় দ্বিতীয় শিরোপা জয়। ১৯৬৮ সালে প্রথম ও সর্বশেষবার শিরোপা জিতেছিল তারা। ফাইনাল ম্যাচের জন্য কিছু পরিকল্পনা করলেও সেটি কাজে আসেনি সাইথগেটের।

মূলত ম্যাচের দুই মিনিটের মাথায় গোল করার পর সেটি ধরে রাখতে না পারাটা ছিল প্রথম ব্যর্থতা। এরপর টাইব্রেকার নামক ভাগ্যের খেলায় সিনিয়র ম্যানচিনির কাছে হেরে গেছেন জনিয়ল সাউথগেট। জয়ে যেমন ইতালির ইতিহাস তৈরি হলো ঠিক তেমনি ইংল্যান্ডের পরাজয়ের রচিত হলোনা নতুন কোন ইতিহাস। লন্ডনের বিখ্যাত ওয়েম্বলির ৪০ হাজার দর্শকও ইতালির জয়ের পথে কাঁটা হতে পারেনি। টাইব্রেকার ভাগ্যে ইংলিশদের উৎসবের রঙ হয়ে যায় নীল।

ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসে এবার দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নশিপ নির্ধারণের জন্য খেলা গড়ালো টাইব্রেকারে। ১৯৭৬ সালে জার্মানি এবং চেকোস্লোভাকিয়ার মধ্যকার শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচের ফলাফল নির্ধারিত হয় টাইব্রেকারের মাধ্যমে। ৪৫ বছর পর টান টান উত্তেজনার এক লড়াই দেখল ফুটবল বিশ্ব। শেষবার ১৯৬৮ সালে যুগোস্লাভিয়ার বিপক্ষে ইতালির ফাইনাল ম্যাচে ১-১ গোলে সমতায় শেষ কয় নির্ধারিত সময়।

পরে রিপ্লে ম্যাচে যুগোস্লাভিয়াকে ২-০ গোলের ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরার মুকুট ঘরে তোলে ইতালী। ৫৫ বছর আগে ১৯৬৬ সালে ওয়েম্বলির এই টার্ফেই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক শিরোপা ঘরে তুলেছিল ইংলিশরা। ফুটবলের জন্মভূমি হওয়া স্বত্ত্বেও মেজর কোনো টুর্নামেন্টের সাফল্য এরপর আর আসেনি ইংল্যান্ডের। দশকের পর দশক ধরে বয়ে বেড়ানো না পাওয়ার গ্লানি ইংলিশদের তাড়িয়েবেড়াচ্ছিল।

নিজেদের ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠে ইংল্যান্ড। জয়-পরাজয়ের রেকর্ডে ইতালী থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল ইংলিশরা। যার ধারাবহিকতা অব্যহত থাকলো এবারো। এই ম্যাচ জয়ের মাধ্যমে নিজেদের অপরাজিত থাকার রেকর্ডটি ৩৩ ম্যাচ থেকে থেকে ৩৪ এ উন্নীত করল মানচিনির শীষ্যরা।

আজ্জুরিরা সবশেষ ২০১৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর উয়েফা ন্যাশন্স লিগে পর্তুগালের বিপক্ষে পরাজয়েল মুখ দেখেছিল। এরপরের গল্পটা হয় জয় নয়তো ড্রয়ের। এর আগে ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কোচ ভিত্তোরি পোজ্জোর অধীনে টানা ৩০ ম্যাচ অপরাজিত ছিল ইতালী। সেবার ইউরোপিয়ান জায়ান্টরা নিজেদের ১৯৩৮ সালের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ ও ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক জয় করেছিল। এবার ম্যানচিনির শিষ্যরা বিশ্বরেকর্ড গড়ার পথে রয়েছে।

আর মাত্র দুটি ম্যাচ জিতলেই সেই কাঙ্খিত রেকর্ডটি হয়ে যাবে তাদের। ব্রাজিল ও স্পেন টানা ৩৫ ম্যাচে অপরাজিত থেকে যৌথভাবে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছে। ব্রাজিল ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত খেলে এই রেকর্ডটি গড়েছিল। আর স্পেন ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত খেলে অসামান্য এই রেকর্ডে নিজেদের সঙ্গী করেছিল। এদিকে আফ্রিকার দল হিসেবে আলজেরিয়া আবার ইতালির ঘাড়ে নি:শ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। ২০১৮ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ২৭ ম্যাচে অপরাজিত রয়েছে তারা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link