আমাদের সময়ে টিভিতে ছবির কোয়ালিটি মোটেই সুবিধের ছিল না। আমাদের দেশে খেলা হয়েছে এমন কিছু পুরনো ম্যাচের রেকর্ডিং দেখলেই ব্যাপারটার আঁচ পাবেন। তবে তা সত্ত্বেও আমাদের ক্রিকেট দেখা পুরো দমেই চলত। প্লেয়ারদের হাব ভাব দেখে আন্দাজে বুঝে নিতাম উনি কে।
সবচেয়ে সহজ ছিল শ্রীকান্তকে আইডেনটিফাই করা। ভয়ঙ্কর ছটফটে ছিলেন ভদ্রলোক। এই মুখ ভ্যাঙ্গাচ্ছেন তো সেই ক্রিজ ছেড়ে স্কয়ার লেগের দিকে একটু পায়চারি সেরে আসছেন। ব্যাট ধরে ক্রিজে দাঁড়ানোর ভঙ্গিও একেবারে নিজস্ব – পা দুটো যতটা সম্ভব ফাঁক করে ব্যাটের ওপর পুরো শরীরের ভর দিয়ে এক দৃষ্টিতে বোলারের দিকে চেয়ে থাকতেন। সময় মত বল খেলার জন্যে যে কিভাবে খাঁড়া হয়ে দাঁড়াতেন সেটা আমার কাছে আজও রহস্য (ফ্রন্ট ফুট বা ব্যাক ফুটে যাওয়ার কথা ছেড়েই দিলাম)।
ব্যাট হাতে মহিন্দর অমরনাথকে চেনার সহজ উপায় ছিল পকেট থেকে উকি দেওয়া কালো রঙের রুমাল (ব্ল্যাক অ্যান্ড হওয়াইট টিভি তো)। আর বোলিং করার সময় অমরনাথকে চেনা ছিল আরও সহজ। পেটের কাছে বল নিয়ে, কুঁজো হয়ে বেশ স্বাভাবিক ভাবে ছুটতে আরম্ভ করলেও অল্প পরেই দেখা যেত বল করার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে, ‘দূর! আর বল করব না। কি হবে বল করে?’ – এই ভাব দেখিয়ে ছোটার স্পিড কমিয়ে দিয়েছেন।
এসব দেখে ব্যাটসম্যান হয়ত ক্রিজ ছেড়ে সরে দাঁড়াতে যাচ্ছেন এমন সময় আচমকা আবার নিজের ডিসিজন পালটে হুটোপাটা করে দিতেন বল ছুঁড়ে। তবে কিনা ঐ বাবুরাম সাপুড়ে মার্কা বোলিং খেলতে তেমন অসুবিধে হত না ব্যাটসম্যানের। ঐ এক ৮৩’র বিশ্বকাপ ছাড়া।
কপিল দেবের ব্যাট হাতে নামার মধ্যে বেশ একটা মাস্তান মাস্তান ভাব ছিল। ব্যাট সুদ্ধ হাত ঘোরাতে ঘোরাতে আর আকাশে সূর্যের খোঁজ করতে করতে ক্রিজের দিকে এগতেন জাঠ তনয়। পরে পড়লাম ডাবলু জি গ্রেস নাকি বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘বা!, কি সুন্দর পাখী!’ বলে সূর্যের দিকে আঙুল তুলে দেখাতেন। কপিলের ক্ষেত্রে সে সব লাগত না। কে জানে কতবার ঐ ধাঁধানো চোখে ব্যাট করতে গিয়ে বল ফস্কে আউট হয়ে এসেছেন মানুষটা (পরে জানলাম গোল্ডেন ডাকের বিশ্ব রেকর্ড কপিলের দখলে)।
বল করার সময়ও সম্ভবত ঐ সূর্যদেবকে চাক্ষুস করবেন বলেই বিশাল একটা লাফ দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বল করতেন কপিল (কোন এক জন্মে কর্ণ ছিলেন কি?)। আর বল করার পর নিজের টি শার্টের বাঁ দিকের বুকের কাছটা অল্প একটু টেনে ফিরে যেতেন নিজের বোলিং মার্কের দিকে। ফলো থ্রুতে বুটের আলতো টোকায় বল হাতে তুলে নেওয়া দেখেও খুব আমোদ বোধ করতাম আমরা।
সানিকে চেনার জন্যে তার খর্বকায় শরীর আর অসম্ভব ব্যাল্যান্সড স্ট্যান্সই যথেষ্ট ছিল। সেই সঙ্গে স্কাল ক্যাপ। মনিন্দারকেও তার ‘পটকা’র জন্যে চিনতে অসুবিধে হত না। বরং ঝামেলায় পড়তাম ভেংসরকার আর কপিল একসঙ্গে ব্যাট করলে, বিশেষ করে হেলমেট পরে। দুজনেরই হাইট প্রায় এক, দুজনেরই বেশ ওজনদার গোঁফ। তবে হয়ত আমাদেরই সুবিধের জন্যে তাদের হেলমেটের রঙ আলাদা হত।
ভিনদেশীদের মধ্যে ইমরানের হাঁটাচলায় একটা আলাদা আভিজাত্য ছিল। বল নিয়ে ছোটার আগে নিজের পেছনে একটু হাত বুলিয়ে ছুটতে আরম্ভ করতেন ইমরান। ছোটবেলায় কোনদিন ছেঁড়া প্যান্ট পরে বল করে হাসির খোরাক হয়েছিলেন বোধহয়। অন্যদিকে আক্রামের মধ্যে একটা বেপরওয়া ভাব লক্ষ করতাম। যেন ব্যাটসম্যানদের, বিশেষ করে ভারতের ব্যাটসম্যানদের, আউট করাটা ওনার বাঁয়ে হাত কা খেল। বাস্তবেও ব্যাপারটা সেরমই দাঁড়াত।
তবে সবচেয়ে দর্শনীয় ছিলেন আব্দুল কাদির।
কাদিরের হাতে বল মানেই বেশ একটা ছন্দবদ্ধ ব্যাপার। দিল্লীর রোডসাইডে লসসি তৈরি করার স্টাইলে বেশ কয়েকবার ডান হাতে ঘূর্ণি বল আকাশের দিকে ছুঁড়ে বাঁ হাতে সেটাকে কব্জায় নিয়ে এসে ছোটা আরম্ভ করতেন কাদির। তারপর নাচতে নাচতে আম্পায়ারকে পেরিয়ে, আধ হাত জিভ বের করে বোঁ করে বল ছুঁড়তেন ব্যাটসম্যানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
সেই ছুটন্ত বল লক্ষ্য করে এরপর আরম্ভ হত কাদিরের বিচিত্র সব ভাব ভঙ্গি – যেন কিভাবে স্পিন করে ব্যাটসম্যানকে বোকা বানাতে হবে তারই নির্দেশ দিচ্ছেন এ প্রান্ত থেকে। সম্ভবত কাদিরের নাচ দেখবেন না বলের স্পিন পড়বেন – এই দোটানায় অর্ধেক ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যেতেন। কাদিরের মতো অতটা না হলেও পরে মুরালিকেও বল করার সময় ভয়ংকর মুখের ভঙ্গি করতে দেখেছি।
আর মাঠের মধ্যে খুঁজে পেতে একদমই অসুবিধে হত না ব্যাটিঙের সম্রাট – ভিভ রিচার্ডসকে। মানুষটার যেন কোনকিছুতেই তাড়া নেই। টমসন – লিলির বলও এমন ধীরেসুস্থে খেলতেন যেন রবি শাস্ত্রীর বল খেলছেন। ছোটার সময়ও মনে হত বেশ শ্লথ গতিতেই ছুটছেন কিন্তু তার ছোড়া বলে কত ব্যাটসম্যান যে রান আউট হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। আর তার মুখের চ্যুইং গাম? সে বস্তু তো এখন আরবান লিজেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।