লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। তীব্র রোদে তখন মস্তিষ্ক টগবগ করে ফুটছে। তবে ‘আমার সোনার বাংলা’ আন্দোলিত করে দিয়ে গেল সাকিব আল হাসানদের ধমনীতে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া থেকে, ঘুরে দাড়ানোর নতুন এক প্রত্যয়ে উজ্জীবিত যেন গোটা দল। শেষ অবধি হয়েছেও তাই। রোদের ঝলকানি হার মেনেছে।
মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাটের উজ্জ্বলতা হার মানিয়েছে পাকিস্তানের আকাশে থাকা সূর্যকে। তীব্রতায় আবার ছাপিয়ে গেলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। কি অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুন্য! তবে তখনও তো সুপার ফোর দূর কোন নক্ষত্র।
সেই নক্ষত্রের পানে বাংলাদেশ ছুটবে। বাংলাদেশকে শুরুটা এনে দিলো মিরাজ-শান্তর সেই ১৯৪ রানের ব্যাটিং দূর্গ। সেই দূর্গটা স্রেফ রক্ষণের দায়িত্ব এসে পড়েছিল তাসকিন আহমেদ, শরিফুল ইসলামদের কাঁধে। শেষ অবধি বাংলাদেশের বোলিং ইউনিট আগের দিনের আক্ষেপটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। বোর্ডে একটু রান থাকলেই যে তারা জয় এনে দিতে পারতেন আগের দিনও।
ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের সমস্যার শেষ নেই। মেকশিফট ওপেনার হিসেবে হাজির হয়ে মিরাজ খেলে ফেললেন অনবদ্য এক ইনিংস। চাপ এসেছিল। তিন রানে দুই উইকেট হারিয়ে চাপেই পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সেই চাপ স্থানান্তর করে দিতে সময় নেননি মিরাজ-শান্ত।
সেই জুটির ভীতে দাঁড়িয়ে থেকে রানটা স্রেফ বাড়িয়ে নিতে হতো বাকিদের। সে কাজটা ভালভাবেই করে গেছেন মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, শামীম হোসেনরা। তবে ওই যে শামীমের খেলা নো লুক ফ্লিকটাই আসলে বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ দিনের শুরু থেকে শেষ ওমন আত্মবিশ্বাস নিয়েই খেলেছে।
কিন্তু তবুও শঙ্কার কালো মেঘ মনের আকাশটায় ছড়িয়ে ছিল। হারলেই যে একেবারেই সমালোচনার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্রের আয়োজন হতো। যাতে মিশ্রিত থাকত, কটু কথা আর হাস্যরস মাখানো জ্বালাময়ী সব কন্টেন্ট। একদল সে প্রস্তুতি সম্ভবত নিয়েই রেখেছিল।
ঠিক তখনই শরিফুল যেন বলে উঠলেন, ‘হোল্ড মাই কাপ অব টি’। আফগান শিবিরে থাকা সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাটারকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেললেন। এ যাত্রায় অবশ্য আম্পায়ার মহাশয়ের একটু আশীর্বাদ মিলেছিল। ডিআরএস যে তার দেওয়া সিদ্ধান্তকেই মেনে নেয়। সেখান থেকে শুরু। কখনোই আফগানরা হারের ভয় ধরাতে পারেনি।
তবে একটু দুশ্চিন্তায় ফেলেছিল বটে। ওই যে সমীকরণের ভীষণ জটিলতা। সেসব তখন সাকিবে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রসায়নের জৈব যৌগের মত করে। উর্বর মস্তিষ্কের সাকিব অবশ্য হাল ছাড়লেন না। হাল ছাড়লেন না মুশফিকুর রহিমও। ভয়ংকর হয়ে ওঠা ইব্রাহিম জাদরানের ক্যাচটা তিনি লুফে নিলেন। চোখের পলক ফেলার আগেই উড়ে গেলেন মুশফিক। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে তালুবন্দি হয়ে গেলেন ইব্রাহিম জাদরান।
গোটা দলটাই যেন নিজেদের সর্বোচ্চটুকু দিলেন। সাইড বেঞ্চ থেকে উঠে আসা এনামুল হক বিজয়ও নিবেদনের কমতি রাখলেন না। দারুণ এক থ্রো-তে সাজঘরে পাঠালেন করিম জানাতকে। এরপর বিনোদনের বাক্স খুলে বসতে চেয়েছিলেন রশিদ খান। দু’চার খানা বাউন্ডারি আর ওভার বাউন্ডারিতে আবারও ভয়ের একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইলেও, দংশিল তাহাকে তাসকিন।
ব্যাস! সমাপ্তি। সুপার ফোরে বাংলাদেশ। সমীকরণ এক লহমায় উদাহরণ। বাংলাদেশ দলটা আসলে কেমন যেন। এদের বোঝা বড় দায়। লজ্জার একেবারে শেষ সীমানা ঘুরে এসে, আনন্দের বান বইয়ে দেন। এই তল্লাটের দর্শক যারা, তাদের হৃদপিণ্ডটা নিশ্চয়ই মাঝেমাঝে বলে ওঠে, ‘এবার আমায় ক্ষ্যামা দে’। তাকে আর বোঝায় কে! এই দলটা যে হৃদয়ের গভীরেই করে বসবাস!