রুপোলি জোৎস্নার কোমল স্পর্শ

সুন্দরের কী কোনও সংজ্ঞা হয়?

সহজ ভাষায় হয় না। সুন্দর শুধুই অনুভূতি। কখনও মনকে চঞ্চল করা এক আবেগ। কখনও আবার তপ্ত হৃদয়ে এক আঁজলা জল দেওয়া শীতলতা। আবার কখনও বৃষ্টিতে ভিজতে চাওয়ার কোমলতা। কিন্তু রূঢ় বিজ্ঞান সেই আবেগে গা ভাসাবে কেন!! বয়ে গিয়েছে তার। সে যুক্তির পূজারী। পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের হাতে কলমে বিশ্বাসী। তাই গণিত দিয়ে সুন্দরকে ব্যাখ্যা করেছে সে। কী সব অনুপাত টাত দিয়ে সংজ্ঞা দিয়েছে।

আচ্ছা বলেন তো কোনও মানে হয়। অনুভূতি দিয়ে যার খোঁজ পাওয়া যায়, তার জন্য অঙ্ক কষতে যাব কেন!! এই লেখা সেই সুন্দর অনুভূতি নিয়ে। ভালোলাগা নিয়ে।

লিওনেল আন্দ্রেস মেসি। নাম শুনলে বা তাঁর পায়ে ফুটবল দেখলে আপনার কী মনে হয়? আমার মনের মনিকোঠায়, দুনিয়ায় যা যা সুন্দর সব একসঙ্গে এসে ভিড় করে। যে সুন্দরে অংকের কোনও জায়গা নেই, আছে কবিতা, গান, ভালোবাসা, ভালোলাগার অনুভূতি।

মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার জোৎস্না রাতের তাজমহলের কথা মনে হয়। গোল চাঁদ যে ভাবে, মেঘের পর্দা সরিয়ে সাদা মার্বেলে শিল্প রচনা করে, মেসির বাঁ পা-ও তো একই ভাবে তুলির আঁচড় কাটে সবুজ ক্যানভাসে। ডিফেন্সের বেড়াজাল কাটিয়ে। পূর্ণিমার মায়াবিনী আলোয় তাজমহলের রূপ দেখে ঝলসে যায় চোখ। এ কি মায়া? পলক ফেলতে ভুলে যান অনেকেই। মেসির ফুটবলও তো তাই। তাই না?

মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয়ের কথা মনে হয়। শ্বেত শুভ্র বসনধারীর গায়ে, আলোর প্রথম রেখা দেখার জন্য আমরা যেমন হা পিত্তেশ করে বসে থাকি, মেসির খেলা দেখার জন্য সে ভাবেই রাত জাগা। সকালের সূর্যের হাল্কা আলো কাঞ্চনজঙ্ঘায় রংয়ের খেলা দেখায়। কমলা, গেরুয়া, হলুদ, নীল, লাল- কী রং নেই সেখানে। মেসিও তো তাই। ডিফেন্স চেড়া থ্রু, ফ্রি কিক, ড্রিবল, ঠিকানা লেখা পাস, বাহারি গোল-কী নেই ভাণ্ডারে।

মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার গ্রামের পাশে বয়ে যাওয়া নদীর কথা মনে হয়। কখনও জোয়ার কখনও ভাঁটা। কিন্তু সে থামতে জানে না। বয়ে চলে আপন বেগে। এক এক ঋতুতে তার এক এক রূপ। গ্রীষ্মে জল কমে, মাঝের চড়া দেখা যায়, তখন সে একরকম। বর্ষায় ছাপিয়ে ওঠে দুকূল, তখন সে ভয়ঙ্কর সুন্দর। শীতে আবার সেই নদী শান্ত কোমল। যেন কোনও অষ্টাদশী তরুণী। মেসিও তো তাই। তাই না? রাইট উইং, লেফট উইং, ফলস নাইন, মাঝমাঠ-ভিন্ন পজিশনে তাঁর ভিন্ন রূপ। নদীর মত।

মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার গঙ্গার ধারে, একে অপরের হাতে হাত রেখে বসা, প্রেমিক প্রেমিকার কথা মনে হয়। মনে হয়, নশ্বর এই দুনিয়ায়, হানাহানির এই সময়ে প্রেম, ভালোবাসাই সবচেয়ে সুন্দর। শাশ্বত। সৈন্যের বন্দুক, গোলাপে বদলে দিতে পারে সে। ভুলিয়ে দিতে পারে ক্ষতের আঘাত, জীবন মরণের প্রশ্ন। হিংসা, বিদ্বেষ। বদলে উস্কে দিতে পারে বাঁচার আনন্দ। মেসির ফুটবল তো একই কাজ করে। করে না?

মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার কবিগুরুর গানের কথা মনে হয়। যা এক লহমায় বদলে দিতে পারে আমাদের মনের আনাচ কানাচ। রাগ, ঘৃণা, অভিমান, দুঃখ, হতাশা, ম্যাজিকের মত ভুলিয়ে দিতে পারে রবি ঠাকুরের গানের কলি। প্রাণে তখন শুধুই খুশির তুফান। মেসির ফুটবল দেখেও আমার একই অনুভূতি হয়। সব ভাবনা সরে গিয়ে হৃদয়ে মিশে থাকে খুশির রেশ।

মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁর সানাই, আমজাদ অলি খাঁর সরোদ বা হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির কথা মনে হয়। তাঁদের হাতে প্রাণ পেয়েছে বোবা যন্ত্রগুলো। যেমন চেয়েছেন কথা বলিয়েছেন। সুর তালের জাদুকরী যুগলবন্দীতে মুগ্ধ হয়েছি আমরা। মেসির পায়ে তেমন প্রাণ পায় ফুটবল। কথা শোনে। ম্যাজিসিয়ানের মত যা ইচ্ছে তাই করেন বলটাকে নিয়ে। তাই তো পেপ গুয়ারদিওলা বলেছিলেন, ‘অংকের ছক কষে লিওকে থামানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু প্রার্থনা করতে পারি, আমার দলের সঙ্গে খেলা থাকলে ও যেন ছন্দে না থাকে।’

শেষে বলি মেসির পায়ে ফুটবল দেখলে আমার জীবনের জয়গানের কথা মনে হয়। মনে হয়, হাল ছেড়ো না বন্ধু। রোসারিও বস্তিতে জন্ম নেওয়া এক শিশু। যে বড় হয়ে ঠিক মত দৌড়াতে পারবে কিনা জানতো না। জানতো না, প্রাণের প্রিয় ফুটবল খেলাটা, একটা বয়সের পর আর খেলতে পারবে কিনা। সে যদি জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারে, বিশ্ব শাসন করতে পারে, আমরাও পারবো। পারবো না?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link