পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের স্পিনারদের নিয়ে আলোচনা করলে যে নামগুলো সবার প্রথমে আসে তাদের মধ্যে উসমান কাদির, সাকলাইন মুশতাক, দানিশ কানেরিয়া, মুশতাক আহমেদদের নাম থাকে। তবে নিজের সময়ে সেরা স্পিনারদের একজন হওয়া সত্ত্বেও যে নামটি আড়ালে থাকে তিনি হলেন ইকবাল কাশিম। শুধু তাঁর সময়েই নয় পাকিস্তানের ইতিহাসের সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার এবং টেস্টে পাকিস্তানের অন্যতন সেরা স্পিনারদের একজন হলেন ইকবাল কাশিম।
৫০ টেস্টে ২৮ গড়ে ১৭১ উইকেট! ৮ ফাইফরের সাথে ২ বার শিকার করেছেন দশ উইকেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখন পর্যন্ত টেস্টে যা কিনা গড়ের দিক থেকে সেরা চারের একটি! ষাটের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত এই তিন দশকে বোলিং গড় এবং স্ট্রাইক রেটের দিক থেকে সেরা দুইজনের একজন ছিলেন কাশিম। তিনিই একমাত্র বাঁ-হাতি স্পিনার যিনি টেস্টে পাকিস্তানের পক্ষে ১০০ উইকেট শিকার করেছেন। সাদা পোশাকে পাকিস্তানের হয়ে সেরাদের কাতারে থাকার পরেও ক্যারিয়ারে সেভাবে আলোচনায় আসেননি তিনি।
ইকবাল কাসিম ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই ছিলেন সাবেক পাকিস্তানি গ্রেট আব্দুল কাদিরের ছত্রছায়ায়। সত্তর দশকের শেষদিকে অভিষেকের পর থেকে আশির দশকে কাদির ছিলেন নিজের সময়ের বিশ্বের সেরা একজন লেগ স্পিনার। কাদির নিজের লেগ স্পিন ঘূর্ণিতে পরবর্তী প্রজন্মের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রোল মডেল হিসেবে। প্রায় একই সময়ে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ইকবাল কাশিমকে টপকে আব্দুল কাদির নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়।
ব্যাঙ্গালুরু, ১৯৮৭। ভারত বনাম পাকিস্তানের পাঁচ টেস্টের শেষ টেস্টে মুখোমুখি হয় দুই দল। এর আগের চার টেস্টই ড্র! এদিকে শেষ টেস্টের উইকেট দেখে ইমরান খান সিদ্ধান্ত নিলেন তাদের স্পিন বিভাগের সেরা অস্ত্র আব্দুল কাদিরকে একাদশের বাইরে রাখবেন। ব্যাটিং উইকেট হিসেবে বাড়তি স্পিনার একাদশ রাখতে চাননি তিনি। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ভারতীয় স্পিনার মাহিন্দর সিংয়ের ৭ উইকেট শিকারে মাত্র ১১৬ রানেই শেষ পাকিস্তান।
ইমরান হয়তো তখন নিজের ভুল উপলব্ধি করে আক্ষেপ করছিলেন। উইকেট মিসরিড করার ভুলটা খন্ডানোর উপায় ছিলো একটাই ঘুরে দাঁড়ানো। আর সেই টেস্টে অফ স্পিনার তৌসিফ খানের সাথে ত্রাণকর্তা হিসেবে নায়ক বনে যান ইকবাল কাসিম। প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট শিকারে ভারতকে ১৪৫ রানে গুড়িয়ে দেন! এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানের ২৪৯ রানের জবাবে ২২০ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামে ভারত। ইকবাল কাশিম ও তৌসিফের জোড়া চার উইকেট শিকারে ১৬ রানের দুর্দান্ত জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ইমরান খানের দল।
কাসিমের এই দাপটের শুরুটা হয় ১১ বছর আগে অজিদের ডেরায়।
১৯৭৬ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাদা পোশাকে অভিষিক্ত হন ইকবাল কাশিম। প্রথম ইনিংসেই উইকেট শূন্য থাকেন তিনি। ওই টেস্টের শেষদিনে দ্বিতীয় ইনিংসে অজিদের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিলো ২৮৪ রানের! বল হাতে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ চার উইকেট শিকার করেন ইকবাল কাশিম। অজিরা ৬ উইকেটে ২৬১ রান করলেও নির্ধারিত ওভার শেষ হওয়ায় ম্যাচের ফলাফল দাঁড়ায় ড্র। মূলত পর্যাপ্ত ওভার না থাকায় সেই টেস্টে জয় পায়নি অজিরা। কিন্তু অজিদের এই জয় না পাওয়ার অন্যতম কারণ ছিলেন ইকবাল কাশিম।
দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তানের পক্ষে সেঞ্চুরি করা আসিফ ইকবালকে সমর্থন দিয়ে ৫২ বলে ৪ রানে অপরাজিত থাকেন কাসিম। শেষ উইকেটে ৮৭ রানের জুটির মধ্যে তিনি করেন মাত্র চার রান! কিন্তু এই জুটিই কিনা অজিদের জয়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। কাসিমদের দ্রুত অলআউট করতে না পারায় ম্যাচ জিততে পর্যাপ্ত ওভার পায়নি অজিরা। সাদা পোশাকে অভিষেক ম্যাচটা রঙিন করেই রাখেন কাশিম। মেলবোর্নে পরের টেস্টে পাকিস্তান হারলেও বল হাতে সাত উইকেট শিকার করেন কাশিম।
পরের বছর ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শিয়ালকোটে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন ইকবাল। অভিষেক ম্যাচে ৬ উইকেটে দল হারলেও দলের পক্ষে সেরা বোলার ছিলেন তিনি। ৭ ওভারে ২ মেইডেন দিয়ে ১৬ রানে ২ উইকেট শিকার করেন তিনি! মাত্র ১.৭১ ইকোনমিতে বোলিং করেন তিনি। এরপরের ১২ বছরে মাত্র ১৫টি ওয়ানডে খেলেন কাশিম!
১৯৮৮ সালে এশিয়া কাপে চট্রগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে শেষ ওয়ানডে খেলেন তিনি। সেখানেও দলের পক্ষে সেরা বোলিং ফিগার ছিলো তাঁর। ৯ ওভারে ৩ মেইডেন দিয়ে মাত্র ১৩ রানের বিনিময়ে তিন উইকেট শিকার করেন তিনি! ১.৪৪ ইকোনমিতে বল করা ইকবাল কাশিম এরপর আর দলে সুযোগই পাননি!
কাসিমের অভিষেকের কিছুদিন পরই পাকিস্তান দলে অভিষেক হয় আব্দুল কাদিরের। লেগ স্পিন জাদু দেখিয়ে দ্রুতই দলে নিজের জায়গা পাঁকা করে ফেলেন তিনি। সাদা পোশাকে কাদিরের সাথে জুটি বেঁধে বহু ম্যাচে ২২ গজ মাতালেও রঙিন পোশাকে সেই সুযোগ পাননি কাশিম। ক্যারিয়ারে খেলা ১৫ ওয়ানডেতে মাত্র ১২ উইকেট শিকার করলেও তাঁর ইকোনমি রেট ছিলো মাত্র ৪.৫২! যা প্রমাণ করে দলের পক্ষে কিপটে বোলিং করে প্রতিপক্ষকে অল্প রানে আটকে দিতে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের অন্যতম সেরা অস্ত্র।
সাদা পোশাকে নিজের ক্যারিয়ার রঙিন করতে পারলেও রঙিন পোশাকে ছিলেন সাদামাটা। সাদা পোশাকে ৫০ টেস্ট খেলা পাকিস্তানের কিংবদন্তি স্পিনার রঙিন পোশাকে কিনা পর্যাপ্ত সুযোগই পাননি! আব্দুল কাদির রঙিন পোশাকে মাঠ দাঁপিয়ে বেড়ালেও কাশিম রয়ে গেছেন তাঁরই ছায়ায়। আব্দুল কাদির আড়ালে থেকেও ঠিক নিজের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে সাদা পোশাকে হয়েছেন সেরাদের একজন। তবে রঙিন জার্সিতে আক্ষেপটা হয়তো চাপা থাকবে আমৃত্যু।