প্রচণ্ড চাপের মুহূর্তেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ বের করে আনাটা ছিল তাঁর বিশেষ ক্ষমতা। নিশ্চিত হেরে যাওয়া অনেক ম্যাচও প্রায় একা হাতে জিতিয়েছেন তিনি যা তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যানদের একজন হিসেবে।
বলছিলাম ‘দ্য ফিনিশার’ খ্যাত অস্ট্রেলিয়ার সাবেক বাঁহাতি ব্যাটিং জিনিয়াস মাইকেল বেভানের কথা। ‘সো কলড’ বিগ হিটার না হয়েও যে আস্কিং রেটে ওভার প্রতি ৮-৯ রান করে নেওয়া সম্ভব সেটা সম্ভবত বেভানই প্রথম দেখিয়েছিলেন। মাসল পাওয়ার নয়, বেভানের সাফল্যের রহস্য ছিল ‘শৃঙ্খলা’ আর ‘মনের জোর’। যেকোন পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া আর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা – এই দুটো জিনিসই তাঁকে আর দশটা সাধারণ প্লেয়ার থেকে আলাদা করেছিল।
বাকিটা বেভানের মুখ থেকেই শুনুন, ‘যখন রান বের করা খুবই শক্ত, তখনও আপনাকে শৃঙ্খলা রাখতে হবে। একটা পরিকল্পনা মেনে এগোতে হবে। আমার ভাবনা থাকতো শেষ অবধি উইকেটে থাকে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত থাকলে পরাজয়ের চেয়ে জয়ের সংখ্যা বাড়ে। সব সময় আমি প্রতি মিনিটে, প্রতি মিনিটে রান পেতাম না, কিন্তু সেটাই ছিল লক্ষ্য।’
বেভানের খেলার স্ট্রং পয়েন্টগুলো ছিল রোটেটিং দ্য স্ট্রাইক, ফাইন্ডিং দ্য গ্যাপস, রানিং বিটুইন দ্য উইকেট আর নিখুঁত শট সিলেকশন। অহেতুক বড় শটে না গিয়ে সিঙ্গেলস-ডাবলস নিয়ে স্কোরবোর্ড সবসময় সচল রাখতেন। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে বিগ শট খেলারও সামর্থ্য ছিল তাঁর। সময়মত ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিয়ে আস্কিং রেট নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতেন।
ক্রিকইনফোর এক আর্টিকেলে বেভান সম্পর্কে লিখেছিল, ‘ফাঁকা জায়গা বের করা, জোরে দৌঁড়ানো আর সঠিক সময় আর জায়গা বের করে বাউন্ডারি আদায় করা ছিল তাঁর সাফল্যের মূল ভিত্তি। গুরুতর অবস্থায় আউট হয়ে যাওয়াটা তার স্বভাবে নেই। ওর এই অতিমানবীয় ক্ষমতাই একগাদা তারকার দলে ওকে আলাদা করতো।’
বেভানের ব্যাটিং সামর্থ্যের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বোলিং সত্ত্বার কথা ভুলে যান অনেকেই। বেভান ছিলেন একজন ‘more than useful’ চায়নাম্যান বোলার এবং উঁচুমানের ফিল্ডার। এমনকি টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে একবার বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচও জিতিয়েছেন তিনি।
ওয়ানডে ইতিহাসের ‘ওয়ান অফ দ্য গ্রেটেস্ট’ এই চেজিং আর্টিস্টকে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়ত সেভাবে মনে রাখবেন না। তাদের উদ্দেশ্যেই বলছি, এখন পর্যন্ত অবসর নেয়াদের মধ্যে ওয়ানডের সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় (৫৩.৫৮) বেভানের। সাকসেসফুল রান চেজে বেভানের ব্যাটিং গড় ৮৬.২৫ যা ওয়ানডে ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে মাত্র দুজন খেলোয়াড়ের (অন্যজন মাইক হাসি) মধ্যে বেভান একজন যার ক্যারিয়ার গড় কখনোই ৪০ (আসলে ৪২) এর নিচে নামে নি!
২৩২ ওয়ানডেতে বেভানের সংগ্রহ ৬ হাজার ৯’শ ৩২ রান। ৪৬টি হাফ সেঞ্চুরির সাথে আছে ৬টি সেঞ্চুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, ১৯৬ ইনিংসে ব্যাট করে ৬৭ বার অপরাজিত থেকেছেন তিনি।
লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারে কমপক্ষে দশ হাজার রানের অধিকারী ব্যাটসম্যানদের মধ্যে বেভানের গড়টাই (৫৭.৮৬) সর্বোচ্চ। ফার্স্ট ক্লাস এভারেজও (৫৭.৩২) অসাধারণ! অনেক গ্রেট ব্যাটসম্যানেরও ফার্স্ট ক্লাসে এত ভাল গড় নেই।
১৯৭০ সালের ৮ মে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এই ব্যাটিং প্রতিভা। আজ তাঁর ৪৮ তম জন্মদিন। তো চলুন একটু চোখ বুলিয়ে আসা যাক মাইকেল বেভানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য কিছু ইনিংস সম্পর্কে।
- ৭৮*, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সিডনি, ১৯৯৬
বৃষ্টির কারণে কার্টেল ওভারে নেমে আসা ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৪৩ ওভারে ১৭৩ রান। কিন্তু ক্যারিবীয় পেস আক্রমণের দাপটে সেই ‘মামুলি’ লক্ষ্যটাই হয়ে উঠেছিল এভারেস্টসম। দুই উদ্বোধনী বোলার কার্টলি অ্যামব্রোস আর কোর্টনি ওয়ালশের গতি ও বাউন্সের সামনে রান করা দূরে থাক, উইকেটে টিকে থাকাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
মাইকেল বেভান যখন ক্রিজে এলেন, দলের স্কোর ৩২/৪। ডানহাতি পেসার ওটিস গিবসনের ‘জোড়া আঘাতে’ মুহূর্তের মধ্যেই তা পরিণত হয় ৩৮/৬! উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলিকে নিয়ে ৩৬ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক বিপর্যয় কিছুটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করেন বেভান। কিন্তু দলীয় ৭৪ রানের মাথায় অফ স্পিনার রজার হারপারের বলে হিলি (১৫) আউট হয়ে গেলে অজিদের জয়ের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে যায়। কেননা জিততে হলে তখনও লাগে ৯৯ রান! হাতে আছে মাত্র ৩ উইকেট!
এমন কঠিন পরিস্থিতি থেকে সেদিন অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচ বের করে এনেছিলেন বেভান। ছয় নম্বরে নেমে চাপকে জয় করে প্রায় ১৫০ মিনিট ক্রিজে থেকে খেলেছিলেন ৮৮ বলে অপরাজিত ৭৮ রানের (৬ বাউন্ডারি) ‘ম্যাজিকাল’ এক ইনিংস!
৮ম উইকেট জুটিতে বেভানকে দারুণ সঙ্গ দিয়েছিলেন ডানহাতি পেসার পল রেইফেল। দুজনে মিলে গড়েছিলেন ৮৩ রানের অনবদ্য এক পার্টনারশিপ। ১৫৭ রানে রেইফেল (৩৪) আর ১৬৭ রানে ওয়ার্ন (৩) ফিরে গেলেও ম্যাকগ্রাকে (১*) নিয়ে দলের জয় নিশ্চিত করে তবেই মাঠ ছাড়েন বেভান। ৪৩ তম ওভারের শেষ বলে জয়ের জন্য দরকার ছিল ৪ রান। অফ স্পিনার রজার হার্পারের করা স্টাম্প বরাবর ফুল লেন্থের বলটিকে সোজা বোলারের মাথার উপর দিয়ে সীমানাছাড়া করেন তিনি। মাত্র ১ উইকেটের ‘শ্বাসরুদ্ধকর’ এক জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। অনেকের মতে এই ইনিংসটাই ছিল বেভানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট।
- ৬৯, প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, চন্ডিগড়, ১৯৯৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
১৯৯৬ সালের ১৪ মার্চ, উইলস বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। রিচি রিচার্ডসনের ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয়েছিল মার্ক টেলরের অস্ট্রেলিয়া।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের শুরুতেই ভয়াবহ ব্যাটিং কলাপ্সের মুখে পড়ে অস্ট্রেলিয়া। ইয়ান বিশপ আর কার্টলি অ্যাম্ব্রোসের আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে মাত্র ১৫ রান তুলতেই ৪ উইকেট হারিয়ে বসে তারা।
টপ অর্ডারের প্রথম চার ব্যাটসম্যানের স্কোরগুলো ছিল যথাক্রমে মার্ক টেলর ১, মার্ক ওয়াহ ০, রিকি পন্টিং ০, স্টিভ ওয়াহ ৩।
এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে সেদিন ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন মাইকেল বেভান। জুটি বেঁধেছিলেন পাঁচে নামা স্টুয়ার্ট ল’র সাথে, ১৩৮ রানের দারুণ এক জুটি গড়ে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলেছিলেন দলকে; খেলেছিলেন ৪ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় ১১০ বলে ৬৯ রানের ‘সময়োপযোগী’ ও ‘দায়িত্বশীল’ এক ইনিংস।
বেভানের ৬৯, স্টুয়ার্ট ল’র ৭২ (১০৫ বল) আর হিলির ৩১ রানের (২৮ বল) সুবাদে অস্ট্রেলিয়া দাঁড় করিয়েছিল ৮ উইকেটে ২০৭ রানের সম্মানজনক স্কোর।
২০৮ রানের মামুলি টার্গেট তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ ছিল ৪১ ওভারে ১৬৫/২। জয়ের জন্য শেষ ৯ ওভারে লাগে মাত্র ৪৩ রান, হাতে আছে ৮ উইকেট। নিশ্চিত জেতা ম্যাচটা হাতছাড়া করে শেষ পর্যন্ত ‘অবিশ্বাস্যভাবে’ মাত্র ৫ রানে হেরেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাত্র ৩৭ রানের মধ্যে হারিয়েছিল শেষ ৮ উইকেট!
- ১০৩, প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, সেঞ্চুরিয়ন, ১৯৯৭
দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে অনুষ্ঠিত সাত ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের ষষ্ঠ ম্যাচে স্বাগতিকদের মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ৫ ম্যাচের তিনটিতে জিতে সিরিজে এগিয়ে ছিল অবশ্য সফরকারীরাই।
ম্যাচ প্রসঙ্গে যাবার আগে একটু বলে রাখা ভাল, অস্ট্রেলিয়া দলটা তখন যাচ্ছিল পালাবদলের মধ্য দিয়ে। ওপেনার মাইকেল ডি ভেনুটোর অভিষেক হয়েছিল ওই সিরিজেই। নিয়মিত অধিনায়ক মার্ক টেলরকে ২ ম্যাচ পরই ‘ড্রপ’ করে উইকেটরক্ষক ইয়ান হিলিকে অধিনায়কত্ব দেয়া হয়। অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে তখন খেলানো হত শুধুই ব্যাটসম্যান হিসেবে, মিডল অর্ডারে। গ্রেগ ব্লিউয়েট আর মার্ক ওয়াহ ছিলেন ওপেনারের ভূমিকায়।
যাই হোক, আবারো ম্যাচ প্রসঙ্গে ফেরত আসি। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ের ৮১ বলে ৮০ আর ড্যারিল কালিনানের ৯৫ বলে ৮৯ রানের চমৎকার দুটো ইনিংসের সুবাদে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে প্রোটিয়াদের সংগ্রহ দাঁড়িয়েছিল ২৮৪/৭। নব্বই দশকের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এটা রীতিমতো ম্যাচ উইনিং টোটাল।
২৮৫ রানের বিশাল টার্গেট চেজ করতে নেমে শন পোলকের বোলিং তোপে মাত্র ৫৮ রানেই ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ৫ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে মাইকেল বেভান যখন ক্রিজে নামলেন, অস্ট্রেলিয়ার জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন ২২৭ রান। হাতে ৭ উইকেট থাকলেও বল ছিল মাত্র ২১৪টা। অর্থাৎ আস্কিং রান রেট ৬ এর ওপরে। এমন সিচুয়েশন থেকে জয় অসম্ভব না হলেও কাজটা যে ভীষণ চ্যালেঞ্জিং এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
যে দলের ব্যাটিং লাইনআপে মাইকেল বেভানের মত ‘ফিনিশিং এক্সপার্ট’ আছে, তার আবার চিন্তা কিসের! ৮ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় ৯৫ বলে ১০৩ রানের ‘টিপিক্যাল বেভান’স নক খেলে সেদিন জয়ের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন বেভানই। ৪র্থ উইকেটে স্টিভ ওয়াহকে (১০২ বলে ৮৯) নিয়ে গড়া ১৮৯ রানের দুর্দান্ত জুটিটাই মূলত ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল।
আড়াইশ’র কোটা পেরোনোর পর অল্প কয়েক বলের ব্যবধানে দুজনই ফিরে গেলে ম্যাচের ‘ফিনিশিং টাচ’ টুকু দিয়েছিলেন কেবল ‘দুই উইকেটকিপার’ গিলক্রিস্ট (২০) আর হিলি (৯)।
৬ বল বাকি থাকতেই পাওয়া ৫ উইকেটের দুর্দান্ত জয়ে এক ম্যাচ বাকি থাকতেই ৪-২ ব্যবধানে সিরিজটাও জিতে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
- ৬৫, প্র্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, এজবাস্টন, ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল
১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালকে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ম্যাচের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন অনেকে। নখ কামড়ানো উত্তেজনা আর নাটকীয়তায় ভরা ম্যাচের শেষটা তো আপনাদের সকলেরই জানা। টুর্নামেন্টের বাইলজ অনুযায়ী, সুপার সিক্স পর্বের মুখোমুখি লড়াইয়ে অস্ট্রেলিয়া জয়ী হওয়ার কারণে দুদলের স্কোর সমান অর্থাৎ ‘টাই’ হওয়ার পরেও দক্ষিণ আফ্রিকা বাদ পড়ে যায়, ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া।
টসে হেরে আগে ব্যাটিং করতে নেমে শন পোলক আর অ্যালান ডোনাল্ডের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে খেই হারিয়ে ফেলে অস্ট্রেলিয়া। ১৭ ওভারে মাত্র ৬৮ রান তুলতেই হারিয়ে বসে ৪ উইকেট! সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে ৫ম উইকেটে মাইকেল বেভান আর অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর ৯০ রানের জুটি।
ব্যক্তিগত ৫৬ রানে স্টিভ ওয়াহর বিদায়ের পর স্কোরটা দুশ’র কোটা পার করানোর দায়িত্ব গিয়ে পড়ে বেভানের ঘাড়ে। বেভান সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে আউট হন একেবারে শেষ ওভারে গিয়ে, পোলকের পঞ্চম শিকারে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ৬ বাউন্ডারিতে বেভানের ব্যাট থেকে এসেছিল ইনিংস সর্বোচ্চ ৬৫ রান (১১০ বল)। আর ৩৬ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ইনিংসের সফলতম বোলার ছিলেন শন পোলক।
ঐতিহাসিক সেই ম্যাচে বাজে শুরুর পরেও দক্ষিণ আফ্রিকাকে যে ২১৪ রানের টার্গেট দিতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া, তার সিংহভাগ কৃতিত্বই বেভানের। দুদল মিলিয়ে ম্যাচের টপ স্কোরারও ছিলেন তিনিই। তাই বলা যায়, শেষ পর্যন্ত ম্যাচে ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল বেভানের ৬৫ রানের ‘লড়াকু’ ওই ইনিংসটাই।
- ১৮৫*, প্রতিপক্ষ এশিয়া একাদশ, ঢাকা, ২০০০
২০০০ সালের আট এপ্রিল, দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি উপলক্ষে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আয়োজন করা হয়েছিল এশিয়া একাদশ ও অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশের প্রীতি ওয়ানডে ম্যাচ।
এশিয়া একাদশের দেয়া ৩২১ রানের বিশাল টার্গেট চেজ করতে নেমে এক পর্যায়ে ৩৭ ওভারে ১৯৬ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে বিশ্ব একাদশ। ঠিক এরপরই অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ায় তারা; বেভান-ক্যাডিক জুটির কল্যাণে ভোজবাজির মত পালটে যেতে থাকে দৃশ্যপট।
১২.৫ ওভার ব্যাট করে ৮ম উইকেট জুটিতে মাইকেল বেভান আর অ্যান্ড্রু ক্যাডিক মিলে যোগ করেছিলেন ১১৯ রান! যে জুটিতে ক্যাডিকের অবদান মাত্র ২৩! আর বেভানের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৩২ বলে অপরাজিত ১৮৫ রানের অবিশ্বাস্য এক ইনিংস! স্ট্রাইক রেট ১৪০ এর ওপরে! ১৯ বাউন্ডারির সাথে ছক্কা মেরেছিলেন ৫টা! বেভানের ১৮৫ রানের অনবদ্য ইনিংসটার মাহাত্ম্য বেড়ে যায় বহুগুণে যখন শুনবেন ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল মার্ক ওয়াহর ২৮ রান!
পাকিস্তানি অলরাউন্ডার আব্দুল রাজ্জাকের করা শেষ ওভার থেকে জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ২০ রান। প্রথম বলে লেগবাই থেকে ক্যাডিক এক রান নিলে স্ট্রাইক ফিরে পান বেভান।
৫ বলে লাগে ১৯! পরপর ৩ বলে ৩ বাউন্ডারি মেরে অসম্ভব এক জয়ের আশা জাগিয়ে তোলেন তিনি।
জিততে হলে শেষ ২ বলে দরকার ৭ রান। ওভারের ‘পেনাল্টিমেট’ বলে ‘ডাবল’ নিতে গিয়ে নন-স্ট্রাইক এন্ডে সময়মত ব্যাট গ্রাউন্ড না করার ফলে রান আউট হয়ে যান ক্যাডিক। উইকেট বড় কথা নয়; ওই রান আউটের কারণে মূল্যবান ১টি রান থেকে বঞ্চিত হয় অবশিষ্ট বিশ্ব একাদশ। শেষ বলে লাগত ৬ রান, কিন্তু বেভান মেরেছিলেন ৪! ফলে তারা ম্যাচটা হেরে যায় মাত্র ১ রানের ব্যবধানে!
- ৮৭*, প্রতিপক্ষ ভারত, গোয়া, ২০০১
২০০১ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার ঐতিহাসিক সেই টেস্ট সিরিজের পর ৫ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে মুখোমুখি হয়েছিল দুদল। প্রথম ৪ ম্যাচ শেষে ২-২ ব্যবধানে অমীমাংসিত সিরিজটার নিষ্পত্তি হয়েছিল শেষ ম্যাচে। ভেন্যু ছিল নেহেরু স্টেডিয়াম, গোয়া।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে ভিভিএস লক্ষণের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে (১০৭ বলে ১০১) ভারত করেছিল ৬ উইকেটে ২৬৫ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে গিলক্রিস্টের ৬০ বলে ৭৬ রানের (১০ চার, ১ ছয়) বিধ্বংসী ইনিংস অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিয়েছিল ‘ফ্লাইং স্টার্ট’। তবে মিডল অর্ডারের ব্যর্থতায় নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা। চারে নামা মাইকেল বেভানের ১১৩ বলে ৮৭* রানের (৫ চার, ১ ছয়) ‘ফিনিশিং’ নকে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ৪ উইকেট ও ১২ বল হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় তারা।
সেদিন অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে ৩০ ওভারের পর থেকেই প্রচুর টার্ন পেতে আরম্ভ করেন ভারতীয় স্পিনাররা। ফলে স্পিনারদের বিপক্ষে ব্যাটিং করাটা ক্রমশই দুরূহ হয়ে পড়ছিল। যার ফলশ্রুতিতে মাত্র ১৫ রানের (১৮৭ থেকে ২০২) মধ্যে দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে কিছুটা অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। ৪১তম ওভারে ৬ উইকেট হারানোর পর ৪ উইকেট হাতে রেখে শেষ ৯ ওভারে জয়ের জন্য তখনও লাগত ৬৪ রান। উইকেটে বল যেভাবে ঘুরছিল, তাতে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ যেকোন সময় ভারতের দিকে ঘুরে যেতে পারত। টার্নিং উইকেটে কোয়ালিটি স্পিনের বিপক্ষে বেভানের অপরাজিত ৮৭ রানের ‘গ্রেট’ ইনিংসটি তাই নিঃসন্দেহে তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংস।
- ১০২*, প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, মেলবোর্ন, ২০০২
প্রথমে ব্যাট করে নিউজিল্যান্ড করেছিল ২৪৫ রান। সেই রান চেজ করতে নেমে শেন বন্ড, ডিওন ন্যাশ, আন্দ্রে অ্যাডামসদের বোলিং তোপে মাত্র ৮২ রানেই ৬ উইকেট হারায় অস্ট্রেলিয়া।
জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন ১৭০ বলে ১৬৪ রান, হাতে উইকেট আছে মাত্র ৪টা! জয়ের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ, এমন খাদের কিনারা থেকেও সেদিন অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। ৩ বল বাকি থাকতেই পেয়েছিল ২ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস এক জয়। যা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র বেভানের কারণে।
ছয়ে নেমে ৯৫ বলে ১০২ রানের (৮ বাউন্ডারি) ‘মহাকাব্যিক’ এক ইনিংস খেলেছিলেন মাইকেল বেভান। সপ্তম উইকেটে শেন ওয়ার্নকে নিয়ে ৬১, অষ্টম উইকেটে ব্রেট লিকে নিয়ে ৭১ আর নবম উইকেটে বিকেলকে নিয়ে গড়েছিলেন ১২ বলে ২৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি। ৩৮ রানে ৪ উইকেট নিয়েও দলকে জেতাতে পারেন নি সেদিন দুর্দান্ত বোলিং করা ফাস্ট বোলার শেন বন্ড। বন্ডেরই শেষ ওভারে মারা ‘জয়সূচক’ দুই বাউন্ডারিতে তুলির শেষ আঁচড়টা দিয়েছিলেন অ্যান্ডি বিকেল।
নিউজিল্যান্ডকে হারানো ম্যাচে পাওয়া দুর্দান্ত ওই সেঞ্চুরিটাকে বেভান তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস বলে মনে করেন। বেভানের ভাষায়, ‘ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল, মনে হচ্ছিল ফাইনালটা (ত্রিদেশিয় সিরিজের) খেলাই হবে না। আমাদের ২৪০-এর মত রান করতে হত। ৮০’র আশেপাশেই ছয়জন সাজঘরে ফেরেন। এরপর আমি ১০০ করি। বড় রান চাপের মধ্যে তাড়া করাটা খুব উপভোগ্য। প্রশান্তিদায়ক এক অভিজ্ঞতা।’
- ৭৪*, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড, পোর্ট এলিজাবেথ, ২০০৩ বিশ্বকাপ
২০০৩ সালের দুই মার্চ, বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ড। পোর্ট এলিজাবেথে অনুষ্ঠিত তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইয়ে সেদিন ছড়িয়েছিল অ্যাশেজের উত্তাপ।
টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড করেছিল ২০৪ রান। বিধ্বংসী বোলিংয়ে ডানহাতি পেসার অ্যান্ডি বিকেল একাই নিয়েছিলেন ৭ উইকেট!
২০৪ রানের সাধারণ পুঁজি নিয়েও ম্যাচে লড়াই জমিয়ে তুলেছিল নাসের হুসেইনের ইংল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়ার টপ ও মিডল অর্ডারের নামীদামী ব্যাটসম্যানদের প্রায় সবাই ব্যর্থ হয়েছিলেন সেদিন। গিলক্রিস্ট (২২), হেইডেন (১), পন্টিং (১৮), মার্টিন (০), সাইমন্ডসদের (০) ব্যর্থতার দিনে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন পাঁচে নামা ড্যারেন লেহম্যান (৩৭)।
অস্ট্রেলিয়ান টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে আউট করে মূল ধ্বসটা নামিয়েছিলেন অ্যান্ডি ক্যাডিক (৯-২-৩৫-৪)। নিয়ন্ত্রিত লাইন লেংথে বোলিং করে ব্যাটসম্যানদের ক্রমাগত চাপে রাখার কাজটা করেছিলেন ‘দুই অলরাউন্ডার’ এন্ড্রু ফ্লিন্টফ (৯.৪-১-২৬-০), ক্রেইগ হোয়াইট (১০-২-২১-১) আর বাঁহাতি স্পিনার অ্যাশলি জাইলস (১০-১-৪২-২)।
বেভান নেমেছিলেন ৬ নম্বরে, অসিদের স্কোর যখন ৪৮/৪। তবে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়ে এক পর্যায়ে তাদের স্কোর দাঁড়ায় ১৩৫/৮। জয় থেকে তখনও তারা ৭০ রান দূরে; হাতে ছিল মাত্র ২ উইকেট আর ৭৪ বল। এমন তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার মত দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আরও একবার অজিদের ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হলেন ‘দ্য ফিনিশার’! ক্যাডিক-ফ্লিনটফদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ৯ম উইকেটে অ্যান্ডি বিকেলকে সাথে নিয়ে গড়লেন ৭৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি! ২ বল বাকি থাকতেই দলকে এনে দিলেন ২ উইকেটের নাটকীয় এক জয়!
বেভানের ১২৬ বলে ৭৪* রানের ইনিংসে ছিল ৬টি চার ও ২টি ছয়ের মার। আর ৩ চার ও ১ ছয়ে বিকেলের ব্যাট থেকে এসেছিল অপরাজিত ৩৪ রান (৩৬ বলে)।