চায়নাম্যান বোলারদের বলা হয় ক্রিকেটের বিরল প্রজাতি। সেই বিরল প্রজাতির কেউ যদি সেরাদের কাতারে থাকে তখন ঠিক কি কি ঘটতে পারে, দেখতে চাইলে তাকাতে হবে কূলদ্বীপ যাদবের দিকে। বলছি সেই ছেলেটার কথা, ভারতের প্রবল প্রতাপ দেখানো স্পিন ডিপার্টমেন্টের নেতৃত্বে থাকা রবিচন্দ্রন অশ্বিনকেও যে দলছাড়া করতে পেরেছিল।
কারো গল্প বলতে হলে পেছন ফিরে চাইতে হয়। সফলতার গল্পগুলো বলতে হলে যদি সফল হবার পরের গল্পটা বলি, তাহলে আসলে ঠিক গল্পটা ‘ঠাম্মার গপ্পো’ হয়না। তাই কূলদ্বীপ যাদবের জন্যও আমরা ফিরে যাব পেছনে।
নয় বছর বয়সের এক ছোট্ট বাচ্চা। যেদিন গুটিগুটি পায়ে ভারতের এক ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হল, চোখে তখন তার একরাশ স্বপ্ন। স্বপ্ন বললাম বটে, সঠিক শব্দচয়ন নিতে পারলে ‘পাগলামি’ শব্দটাই মনে হয় ওর সাথে যেত সবচাইতে বেশি। কেন? সেই বয়সটাতেই ওর কাছে যে-ই জিজ্ঞেস করত, ওর জবাব ছিল সোজাসাপ্টা- ‘আমাকে ওয়াসিম আকরাম হতে হবে!’
ভুল পড়েননি, বাঁ-হাতটা কুঁচকে ছোট্ট এক লাফে যে ছেলেটা স্পিন বোলিংয়ের ভেলকি দেখান, সেই ছেলেটা হতে চেয়েছিল এক পেসার। আইডল ওয়াসিম আকরাম শুনে বোঝা যায়, আসলে হতে চেয়েছিল সর্বজয়ী এক পেসার। তবে বাঁধ সাধল ওই ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটাই!
ছোট্ট কূলদ্বীপ যে ক্রিকেট অ্যাকাডেমিটাতে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানকার কোচ ছিলেন কাপিল পান্ডে। অন্য সবাইকে বলার মত প্রথম দিনই কূলদ্বীপ কপিল পান্ডেকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘মুঝে ওয়াসিম আকরাম বাননা হ্যায়।’ তবে কাপিল পান্ডে দেখলেন, ছোটোখাটো টিনটিনে গড়নের এই পুচকে পেস বোলিংটা মনে হয় ঠিকঠাক রপ্ত করতে পারবে না, পারলেও ওয়াসিম আকরাম হয়তো হতে পারবেনা।
তিনি কূলদ্বীপকে স্পিনার হওয়ার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু, ওয়াসিম আকরাম হতে চাওয়া নয় বছরের এক বালকের সেই পরামর্শ শুনতে বয়েই গিয়েছে! সোজাসুজি নাকচ করে দিল ছেলেটা। তবে কাপিল পান্ডে দমে গেলেন না, বোঝাতে লাগলেন, একসময় জোরও করলেন। আর এরপর কূলদ্বীপ এক সময় বুঝলোও!
তবে সেই বোঝাটা সহজ হয়নি। সেই বোঝাতে যেমন ছিল অপূর্ণ স্বপ্নের কষ্ট, ছিল নতুন কিছুতে মানিয়ে নেওয়ার খাটুনি। কঠিন সেই সময় নিয়ে নানা সময়েই কূলদ্বীপ বলেছেন, ‘আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। কারণ আমি তো স্বপ্ন দেখতাম ওয়াসিম আকরামের মত দুর্দান্ত সব ইয়োর্কারে ব্যাটসম্যানের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলার। সেই স্বপ্ন পূরণ হল না, আর এরপরই আমাকে বলা হল নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। আমাকে নতুন বোলিং অ্যাকশন দেওয়া হল। তবে ওয়াসিম আকরামের ভাবনা আমার মাথা থেকে পুরোপুরি গেল না। কানপুরে যেদিন আমি প্রথমবারের মত স্পিন বোলিং করতে নামি, সেই বলটা ছিল অনেকটা পেস আর স্পিনের বোলিং মিশ্রণ। আমার কোচ অবাক হয়েছিলেন, কেননা এভাবে তো কেউ কখনও বাঁ-হাতি লেগস্পিন করে না। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি আমাকে যতই বোঝান না কেন, ওয়াসিম আকরাম আমার মাথা থেকে সরেননি। তখন একদিন কোচ আমাকে বললেন, ওয়াসিম আকরামকে ছাড়, তুমি চাইলে শেন ওয়ার্ন হতে পার।’
এরপর ছেলেটা যে সাথে সাথেই শেন ওয়ার্ন হবার তাড়নায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। তবে তখন থেকে সে সত্যি সত্যিই স্পিনার হতে চায়। চেষ্টা করে ভীষণ, হয়ে উঠতে থাকে ক্রিকেটের সবচাইতে বিরল বোলার- লেফট আর্ম চায়নাম্যান!
কূলদ্বীপ যাদব ততদিনে একটু একটু করে নাম করতে শুরু করেছেন। এরপর একদিন তার সাথে ওয়াসিম আকরামের দেখা হয়ে গেল সত্যি সত্যিই, কোলকাতা নাইট রাইডার্সের নেটে! কূলদ্বীপ তখন ওয়াসিম আকরামকে বলে দেন, ছোটবেলা থেকে তিনি হতে চেয়েছিলেন ওয়াসিম আকরামের মতই। ওয়াসিম আকরাম কূলদ্বীপের কথা শুনে হাসেন। কূলদ্বীপের ঘাড়ে হাত রেখে হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘আগার তু মেরেকো কপি কিয়া হোতা, হাম মিল নেহি পা তে।’ বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘তুই যদি আমাকে কপি করতি, আমাদের কখনই দেখা হত না।’
এই রে, কূলদ্বীপের এই ওয়াসিম আকরামের প্রতি মুগ্ধতা কেন জন্মাল সেই গল্পটাই আপনাদের বলা হয়নি। আসলে, কূলদ্বীপের বাবা ছিলেন ওয়াসিম আকরামের বিরাট ভক্ত। বাবার সেই গুণ ছোট্ট কুলদ্বীপের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে অল্প বয়সেই। এমনকি ২০১৬ আইপিএল খেলার সময় কূলদ্বীপ ওয়াসিম আকরামকে তাঁর বাসাতেও নিয়ে যান। কোচ থাকার সুবাদে অনেকটা সময় ওয়াসিম আকরামের সাথে কাজ করেছেন কূলদ্বীপ। কূলদ্বীপের মতে, ছোট বেলার হিরোর সাথে কথা বলতেই নাকি তাঁর শিহরণ বয়ে যায়!
কূলদ্বীপের জীবনে দুইজন ক্রিকেটিং হিরো আছেন। একজনের নাম তো বলেই দিয়েছি, আরেকজন হলেন শেন ওয়ার্ন। ২০০৫ সালে যখন কূলদ্বীপ আস্তে আস্তে ভারতের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক দলে খেলা শুরু করেছেন, সেই সময়ে চলছিল আগুনে অ্যাশেজ সিরিজ। সেই অ্যাশেজ সিরিজেই,শেন ওয়ার্নের প্রতি চূড়ান্ত মুগ্ধতা জন্মে কূলদ্বীপের। কানপুরে তখন ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। তাই চাইলেই ইউটিউবের সার্চবারে কয়েক শব্দ লিখে শেন ওয়ার্ন সুধা পান করা হত না কূলদ্বীপের। তাই অ্যাশেজ সিরিজের হাইলাইটস টিভিতে দেখালেই, টিভির সামনে বসে যেত কূলদ্বীপ। অস্ট্রেলিয়ার একটা হাইলাইটসও নাকি তখন থেকে তিনি মিস করেননি অনেকদিন পর্যন্ত। আর ঠিক সে সময় থেকেই স্পিনার হওয়ার সিরিয়াস ট্রেইনিং শুরু হয় কূলদ্বীপের – শেন ওয়ার্ন তাকে হতেই হবে!
সেই ঘটনার ঠিক ১২ বছর পর, ২০১৭ সালে শেন ওয়ার্নের সাথে প্রথমবারের মত সাক্ষাৎ হয় কূলদ্বীপের। এর আগে নানা সময়ে আইপিএলের মত টুর্নামেন্টে দুইজন কাজ করেছেন, ভিন্ন দলেই, তবে কখনওই কূলদ্বীপ সাহস করে নিজের আইডলের সাথে কথা বলতে যাননি। হয়তো ২০১৭ সালের সেই দিনটাতেও যেতেন না। কিন্তু তিনি অস্ট্রেলিয়ার সেই ভারত সফরে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না । দলে তখন তিনি অপরিহার্য সদস্য, কোচ হিসেবেও আছেন কিংবদন্তী স্পিনার অনীল কুম্বলে। কূলদ্বীপ গিয়ে ধরলেন নিজের গুরুকেই, একবার যদি শেন ওয়ার্নের সাথে তিনি দেখা করিয়ে দেন! কূলদ্বীপের যে ঠিক সাহসে কুলায় না!
অনিক কুম্বলে কূলদ্বীপের আবদার রাখেন। কূলদ্বীপের সাথে শেন ওয়ার্নকে পরিচয় করিয়ে দেন। পরে কূলদ্বীপ বলেছেন, ‘আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না। শেন শুধুই বলছিল, আমি হা করে শুনছিলাম। আমি অনেক কিছুই বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু আমার জিহ্বা জড়িয়ে যাচ্ছিল।’
প্রাথমিক আবেগের ঝাপটা সরে গেলে শেন ওয়ার্নের সাথে খাতির জমে যায় কূলদ্বীপের। সেই সিরিজেই পরদিন থেকে মাঠে দেখা হলেই এগিয়ে আসতেন ওয়ার্ন। আর এখন? নানা সময়ে ওয়ার্নের থেকে পরামর্শ নেন কূলদ্বীপ। কূলদ্বীপ বলেছেন, ওয়ার্নকে টেক্সট করলেই নাকি তিনি সানন্দে রিপ্লাই দেন!
কূলদ্বীপও শেন ওয়ার্ন থেকে পরামর্শ নিতে থাকেন সেদিন থেকেই। কূলদ্বীপ বলেন, যেকোন সমস্যা হলেই তিনি ছুটে যান শেন ওয়ার্নের কাছেই। শেন ওয়ার্নও কূলদ্বীপের সমস্যাগুলো শুধরে দেন। কূলদ্বীপের বোলিং অ্যাকশন, বডি এলাইনমেন্ট, ডেলিভারি এংগেল- ক্রিকেটের এসব নানা দরকারী জিনিস শেন ওয়ার্নের শুধরে দেওয়া। কূলদ্বীপ যে শুধু এসব বেসিক জিনিস নিয়েই প্রশ্ন করেন তা নয়, কূলদ্বীপ শেন ওয়ার্নের কাছে জানতে চান ম্যাচ পরিস্থিতি নিয়েও। কূলদ্বীপের ভাষায় তাঁর প্রশ্নগুলো হয় পাগলাটে। ‘চার খেলে কি করব’ ‘ছয় মারলে কি হবে’ শেন ওয়ার্নের সমস্ত অভিজ্ঞতা নিংড়ে নিতে চান কূলদ্বীপ!
সময় যায়, কূলদ্বীপের জানার শেষ হয় না, শেষ হয় না শেন ওয়ার্নের প্রতি কূলদ্বীপের মুগ্ধতা। এন্ড্রু স্ট্রাউসকে প্যাভিলিয়নে ফেরানো শেন ওয়ার্নের ৭০০ তম ডেলিভারিটা নাকি কূলদ্বীপ ইউটিউবে প্রায়ই দেখেন। কূলদ্বীপের ক্রিকেট ফ্যান্টাসি জুড়ে থাকে শেন ওয়ার্ন আর ব্রায়ান লারার দ্বৈরথটাও। বুঝতেই পারছেন, কূলদ্বীপ কিভাবে সেরাদের কাতারে এসেছেন। ক্রিকেটে খেয়ে, ক্রিকেটে বেঁচে থাকা একজন ক্রিকেটে সেরা হবেন না তো কিসে সেরা হবেন?
শেন ওয়ার্নের প্রতি কূলদ্বীপের মুগ্ধতা বলছিলাম। কূলদ্বীপও কিন্তু নিজের প্রতি শেন ওয়ার্নের মুগ্ধতা তৈরি করতে ছাড়েননি। ২০১৮-২০১৯ এ সিডনি টেস্টে টিম পেইনকে আউট করা ডেলিভারিটা নাকি শেন ওয়ার্নকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে তিনি নিজে যেচে কূলদ্বীপকে তা জানিয়েছিলেন।
অনিক কুম্বলে যেদিন কূলদ্বীপকে শেন ওয়ার্নের সাথে কূলদ্বীপ যাদবের পরিচয় করিয়ে দিলেন, কূলদ্বীপ শেনকে প্রশ্ন করেছিলেন তিনি সব ফরম্যাটে সামলাতে পারবেন তো? শেন ওয়ার্ন অভয় দিয়েছিলেন, ‘আমি বলছি পারবে’। আর এখন যখন ক্রিকেটের সব ফরম্যাটে কূলদ্বীপ ছড়ি ঘোরাচ্ছেন, কূলদ্বীপকে শেন ওয়ার্ন মনে করিয়ে দিতে ছাড়েননা, ‘দেখেছ আমি বলেছিলাম তুমি পারবে।’
কূলদ্বীপ যাদব আর শেন ওয়ার্নের ঘনিষ্ঠতা আস্তে আস্তে আরো বেড়েছে। ক্রিকেটের আইডল থেকে এখন শেন ওয়ার্ন কূলদ্বীপের অনেক কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছেন। যেই কাছের বন্ধুকে অনুকরণ করতে বলেছিলেন কপিল পান্ডে। কে জানে, এই বন্ধুটাকে ২০০৫ সালে না দেখলে ওয়াসিম আকরাম হতে চাওয়া কারো কূলদ্বীপ যাদব হওয়া হত কিনা!