দ্য কিউরিয়াস কেস অব গ্যারেথ বেল

গ্যারেথ বেল! নামটা বললেই একটা গোল একদম চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বার্সেলোনার ডিফেন্ডার মার্ক বাত্রা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিয়েছেন লাইনের বাইরে। সেখান থেকে একটান, বল নিয়ে থামলেন গোলরক্ষক পিন্টোর দুই পায়ের মাঝ দিয়ে জালে জড়িয়ে। সেই বেল আর আজকের বেলের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বললেও ভুল হবে, তার থেকেও বেশি কিছু। বেলের অবনমন কী সাধারণ কিছু নাকি তার থেকেও বেশি। আজকের গল্পটা বেলের উত্থান-পতনের কাটাছেঁড়া।

এপ্রিল ১৬, ২০১৪। ভ্যালেন্সিয়ার ম্যাস্তেলা স্টেডিয়ামে রিয়াল-বার্সা মুখোমুখি হয়েছে কোপা দেল রে’র ফাইনালে। মাদ্রিদিস্তাদের মাথায় তখন চিন্তার ভাঁজ। গত দুই দশকে মাত্র দুইবার স্পেনের ঘরোয়া লিগের কাপ জিততে পেরেছে রিয়াল। হোসে মরিনহো আসার আগে তো ১৮ বছর কোপা দেল রে’র দেখাই পায়নি ‘অল হোয়াইটস’রা।

তার উপর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো চোটের কারণে দলের বাইরে। কার্লো আনচেলত্তি তাই গ্যারেথ বেলকে নামালেন তার প্রিয় পজিশন লেফট উইঙ্গে। এরপর গ্যারেথ বেল যা দেখালেন তা বেলের ক্যারিয়ার কেন, পুরো ফুটবল বিশ্বে বাঁধাই করে রাখবার মতন গোলগুলোর মধ্যে অনায়াসে জায়গা করে নিবে। গ্যারেথ বেল যখন রিয়ালে এসেছিলেন, তখনই তৎকালীন বিশ্বের সেরা পাঁচ জন খেলোয়াড়ের একজন হয়ে গিয়েছিলেন, নইলে ট্রান্সফার রেকর্ড ভেঙে রিয়ালের মতন রয়্যাল ক্লাব কেন-ই বা কিনতে যাবে বেলকে?

গ্যারেথ বেল প্রথম লাইমলাইটে এসেছিল গত দশকের শুরুতে। কোচ হ্যারি রেডন্যাপের টটেনহ্যামের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগজয়ী ইন্টার মিলান। কোচের লক্ষ্য ছিল কোনোভাবে ড্র করে ফেরত আসা, কিন্তু মাইক টাইসনের ভাষায়, ‘সবকিছুই পরিকল্পনা মত যায়, যতক্ষণ না মুখে একটা ঘুষি এসে না পরে।’

সান সিরোতে ইন্টারের অপরাজিত থাকার রেকর্ডে এমন ধাক্কা আগে কেউ কখনও দিতে পারেননি, যতটা পেরেছিলেন টটেনহ্যামের হ্যাংলা-পাতলা লেফট ব্যাক গ্যারেথ বেল। লেফট ব্যাক পজিশোন থেকে ওভারল্যাপ করে সে ম্যাচে তুলে নিয়েছিলেন হ্যাট-ট্রিক। জানান দিয়েছিলেন, এতদিন ধরে লণ্ডনের সাদা ক্লাবটি তার জায়গা চিনতে ভুল করেছে।

ফাস্ট ফরোয়ার্ড টু ২০১৩, সামার ট্রান্সফার উইন্ডোর শেষদিন টটেনহ্যাম থেকে ১০০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ কিনে আনে ওয়েলস সুপারস্টারকে। দেওয়া হয় ১১ নম্বর জার্সি, আরিয়েন রোবেনের পর থেকে যে জার্সি শুধু গা বদল হয়েছে, থিতু হতে পারেনি কেউই। বেলকে ভাবা হয়েছিল রিয়ালের ভবিষ্যৎ। দশকের প্রথম দিকে যাকে নিয়ে এতো আশা করা হয়েছিল, দশকের শেষে তাকে খুঁজেই না পাওয়ার হেতু কী?

রিয়াল মাদ্রিদে আসার আগেই তার ট্যালেন্ট নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। বার্সেলোনা যখন টেবিলের নিচে দিয়ে নেইমারকে কিনে আনে বার্সেলোনায়, তখন রিয়াল তার প্রতিদান দেয় বেলকে কিনে। নেইমার আর বেলের মধ্যে, কেনার সময়ে বেলই সুপেরিওর ছিল। নেইমারের ব্রাজিলিয়ান হাইপ বাদ দিলে বেলকে কেনা রিয়ালের জন্য বেশ ভাল একটা প্রজেক্ট ছিল।

সমস্যা বলতে একটাই ছিল, ইনজুরি। ইনজুরি তার আজীবনের সঙ্গী। স্পার্সের জার্সিতে ৭ বছরের ক্যারিয়ারে ইনজুরিতে পরেছেন ২৮ বার। তার বেশিরভাগই বডির লোয়ায় পার্টে, অর্থাৎ পায়ের পেশি কিংবা গোড়ালিতে।

বেল ছিলেন ডেডলাইন ডে সাইনিং। সামার ট্রান্সফার উইন্ডোর একেবারে শেষদিকে এসে রিয়াল কনফার্ম করেছিল, বেল আসছে। যে কারণে দলের সাথে মানিয়ে নেবার মত কোনো প্রাক-মৌসুমের খেলা পাননি। তবে তাকে দলের সাথে সেটেল করে নিচ্ছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। ইস্কোর সাথে রোটেট করে তাকে রাইট সাইডে থিতু করার চেষ্টা করতে থাকেন ইতালিয়ান বস। স্বভাবতই নিজের পজিশন তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল রোনালদোর জন্য, কিন্তু বেল খুব দ্রুতই মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন।

আর ৪-৩-৩ ফর্মেশনে বেল পেয়েছিলেন পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা। রিয়াল তাদের ‘হান্ড্রেড মিলিয়ন ম্যান’-এর কাছ থেকে যা যা আশা করছিল, তার সবটাই যেন হাঁড়ি ভরে দিয়েছেন বেল। প্রথম মৌসুমেই করেছিলেন ৪৪ ম্যাচে ২২ গোল। আর তার সাথে ছিল রোনালদোর অনুপস্থিতিতে কোপা দেল রে’র সেই বিখ্যাত গোল আর ইউসিএল ফাইনালে এক্সট্রা টাইমে এনে দেওয়া লিড। বেনজেমা-বেল-ক্রিশ্চিয়ানোর ‘বিবিসি’ ছুঁয়েছিল ৯৭ গোলের ট্যালি। এক লা ডেসিমা যেন সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছিল মাদ্রিদিস্তাদের।

মাদ্রিদে বেলের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তখন কন্সিস্ট্যান্ট না থাকা। এই ভাল খেলতে খেলতে খেই হারিয়ে ফেলা দেখে বেশ বিরক্তই হত মাদ্রিদিস্তারা। কিন্তু সেটা পুষিয়ে দিতেন বাকিরা। কিন্তু রোনালদোর অসাধারণ ফর্মের পরেও যখন ট্রফিলেস একটা মৌসুম কাটল রিয়ালের, এক ধাক্কায় যেন রিয়ালের চিত্রই পরিবর্তন হয়ে গেল। আনচেলত্তি বহিস্কৃত, দলে আসলেন বেনিতেজ। এসেই বড় মুখ করে বলে বসলেন, এই দলের মেইন ম্যান হবেন গ্যারেথ বেল।

বেনিতেজের আমল নিয়ে খুব বেশি একটা কিছু বলার নেই। কারণ বেনিতেজের আমলে হাতে গুণে বেনজেমা আর নাভাস বাদে কেউই আপ-টু-দ্যা মার্ক পারফর্ম করতে পারেননি। আর এই সময়েই রিয়ালে প্রথম বড় ইনজুরির কবলে পরেন বেল। প্রায় ২ মাসের মত মাঠের বাইরে থেকে প্রায় ৭ ম্যাচ মাঠের বাইরে থাকেন বেল।

তাই, জানুয়ারিতে বেনিতেজকে সরিয়ে শুরু হয় জিদান অধ্যায়। জিদানের শুরুটা হয়েছিল জিদানের মত করেই, বেলও ফিরে পেয়েছিলেন নিজের সেরা ফর্ম। প্রথম ৩ ম্যাচে ৫ গোল, মৌসুম শেষে জিদানের ২৭ ম্যাচে বেলের গোল ছিল ১০ টি। খেলেছিলেন ১৬ ম্যাচে। মাঝখানে কাফ মাসলের ইনজুরি না থাকলে হয়তো ম্যাচসংখ্যা আরো বাড়তে পারত। প্রায় ৪৫ দিন পর ফেরত আসা বেলকে সরাসরিই দলে প্রবেশ করিয়েছিলেন জিদান। যার প্রতিদান বেল দিয়েছিলেন অ্যাটলেটিকোর বিপক্ষে ফাইনালে একমাত্র গোল করে।

পরের মৌসুমের মাঝামাঝি পর্যন্তই সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল, কিন্তু ২০১৬ এর নভেম্বরে এসে গোড়ালির চোটে পরেন বেল। এক চোটে ৩ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হয় বেলকে। এই তিনমাস বড্ড দরকারি ছিল রিয়ালের জন্য। তাই জিদান তড়িঘড়ি করে নেমে পরেন তার কম্বিনেশন খুঁজতে। আর সেখানেই তুরুপের তাস হয়ে আসেন ইসকো।

স্প্যানিশ মিডফিল্ডারের অসাধারণ পারফরম্যান্স এক কথায় রিয়ালের মাঝমাঠের চিত্রই বদলে দেয়। পেছনে ক্রুস-মদরিচ-ক্যাসেমিরোকে তো বাদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না, আর সামনে বেনজেমা-রোনালদো। তাই বাদ পরলেন বেল। চোট থেকে ফিরে যখন রিয়ালের লাইন-আপ ঢোকার সময় এল, তখন দেখলেন তাতে আগে থেকেই ইসকোর বুকিং দেওয়া। এরমধ্যেই টার্নিং পয়েন্ট হয়ে এল আরেকটা এল ক্লাসিকো।

ইসকোর বদলে পুরোনো সৈনিক বেলের উপর ভরসা করলেন জিদান। তাতে লাভের লাভ তো কিছু হলোই না, বরং লিওনেল মেসির ৯২ মিনিটের গোলে পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে রিয়াল। পুরো ম্যাচে যতক্ষণ ছিলেন, ততক্ষণ যেন নিজের নামটাই ডুবিয়েছেন বেল। সে ম্যাচও শেষ করতে পারেননি, চোটের কারণে তাকে আগেই সরিয়ে নিতে হয় জিদানের।

দিনকে-দিন বেলের চোট অসহ্য করে দিচ্ছিল জিদানকে। তার মত স্পিডস্টারের জন্য নিজেকে চোটমুক্ত রাখা অনেক বড় একটা ব্যাপার। দৌড়ানোর সময় কাফ মাসলের উপর সম্পূর্ণ খেয়াল না রাখলে যেকোনো সময় ব্যাকফায়ার করতে পারে। আর সেটাই হয়েছে বেলের বেলায়। জিদানও খুঁজেছেন বিকল্প।

তিন মাসের ইনজুরি থেকে এসে সুস্থ ছিলেন মাত্র ৪ দিন। আবারও এক মাসের জন্য ছিটকে যান মাঠের বাইরে। জিদানের ধৈর্য্যের বাধ যেন এ পর্যায়ে একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল। এত পরিমাণ চোট নিয়ে আর যাই হোক, কোনো ফুটবল খেলোয়াড়কে ফর্মে ফেরত আনা সম্ভব নয়। তবুও জিদান সুযোগ দিয়েছেন, কিন্তু ফলাফল শূন্য।

নিজের শহর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে জিদান তাকে সুযোগ দিয়েছিলেন মাত্র ১৩ মিনিটের জন্য। যদিও ফাইনাল জিতে উৎসব করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু নিজের মাটিতে নিজেদের লোকেদের সামনে এভাবে বেঞ্চ থেকে নামানোটা সহজভাবে নেননি বেল। বলতে গেলে অনেকটা অপমানিত বোধই করেছেন।

অনেকে ভেবেছিলেন, বেল হয়তো এই জায়গা থেকে ব্যাক করবেন, আবার নিজের স্বরূপে ফিরে জিদানকে দেখিয়ে দিবেন কতটা ভুল ছিলেন তিনি। তেমনটা হলে হয়তো জিদানের থেকে বেশি খুশি অন্য কেউ হতেন না। কিন্তু এই ঘটনার পর বেলের খেলার মনোভাব যেন আরো উড়ে গেল। প্রি-সিজনে গলফ খেলতে গিয়ে ব্যাক ম্যাসল পুল করেন বেল। জিদানের রাগ যেন এবার আকাশ ছুঁয়েছে।

যে খেলোয়াড়ের দলের প্রতি বিন্দুমাত্র কমিটমেন্ট নেই, তাকে দিয়ে আর যাই হোক, খেলা হয় না। জিদানের থ্রি-পিটের শেষ মৌসুমে ৫ বারের চোটে ৫০ দিন ছিলেন মাঠের বাইরে। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে গিয়ে করেছেন বিখ্যাত ‘Wales>Golf>Madrid(in that order)’ সেলিব্রেশন। সুযোগ পেয়েছেন বারবার, কিন্তু কাজে লাগাবার বেলায় ছিলেন নস্যি। ফলাফল বেলের ক্যারিয়ারকে মুখরোচক বানাতে শুরু করলেন নিউজপেপার মালিকেরা। তবে বেল ফিরেছেন, ঠিকই চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে একাই লিভারপুলকে ডুবিয়েছেন। পত্রিকারা জিদানের বিপক্ষে লিখবার রসদ পেয়েছে। জিদান-রোনালদোর বিদায়ে ৫ বছরের অপেক্ষা শেষে বেল দলের মেইনম্যান হয়েছেন। তবে মেইনম্যানের গল্পটা আগের গল্প থেকে আরো হতাশার।

জিদান-বেল চলে যাওয়ার পর যখন অনেকে ভাবতে শুরু করেছিল বেল আসলেই হয়তো তার পুরোনোরূপে ফিরবেন, স্পিডস্টার বেলের ডাউনগ্রেডের কারণ আসলে জিদানই; তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে গিয়ে আরো ঝামা ঘসে দিয়েছিলেন ওয়েলশ উইজার্ড। লোপেতেগির অধীনে ভাল করা দূরে থাক, চোটের কারণে মাঠেই নামতে পারেননি।

বেনজেমাকে গণিমতের মাল ধরে মাদ্রিদিস্তাদের ভরসা যেখানে ছিল বেল, সেখানে তাকে মাঠেই দেখা গিয়েছে কালেভদ্রে। চোটে চোটে লোপেতেগি অধুয়ায় শেষে যখন সোলারি অধ্যার শুরু হল, তখন কিছু সুযোগ পেয়ছিলেন। কিন্তু তাতে যেই লাউ, সেই কদু। পুরোনো বেলকে আর পাওয়া যায়নি। এরপরের জিদান অধ্যায় নিয়ে আর মুখ না খোলাই ভাল। সবশেষে এই মৌসুমে আবারও টটেনহ্যামে লোনে ফেরত এসেছেন বেল। ফুটবলকে নতুন করে ভালোবাসার ইচ্ছেয়।

বেলের গত অর্ধদশকের পরিক্রমায় অনেকগুলো প্রশ্নই জেগে ওঠে, বেলকে কী আসলেই নষ্ট করেছেন জিদান? নাকি বেল নিজেই এই অবস্থার জন্য দায়ী? নাকি বেল ফুটবল ইতিহাসের আরেকটি হতাশার নাম? প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরই হ্যাঁ, ফ্রম আ সারটেইন পয়েন্ট অফ ভিউ।

ইংলিশ মিডিয়ার মতে জিদানই যে বেলের নষ্টের পেছনে পুরোপুরি দায়ী, তা নয়। বরং জিদান তার ম্যানেজারিং ক্যারিয়ারের প্রথম দুই বছর বেশ ভাল পরিমাণ সময় দিয়েছেন বেলকে। তখন বেলও নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মৌসুমের পরের হাফে প্রায় ৫ মাসের মত মাঠের বাইরে থাকা জিদানের পুরো প্ল্যানিং পাল্টে দিয়েছে।

বেলের পজিশন ছিনিয়ে নিয়েছে ইসকো ও অ্যাসেন্সিওর অসাধারণ পারফরম্যান্স। বলতে গেলে যোগ্য হিসেবেই তারা রিয়ালের মত দলে টিকে ছিল। কিন্তু বেল ফেরত আসার পর সেই জায়গাটি আর নিতে পারেননি। জিদানও নিজের একগুয়েমিতে ভর করে বেলকে যথাযথ সুযোগ দিতে কিছুটা কার্পণ্য করেছেন বৈকি।

তবে জিদানের একছত্র দোষ আছে বললেও ঠিক চলবে না। বেল একজন স্পিডস্টার, স্পিডস্টারদের সাথে নিজের গার্লফ্রেন্ডের থেকে ভাল সম্পর্ক থাকে ইনজুরির। হাস্যকর হলেও কথাটা সত্যি। গ্যারেথ বেলের চিকনচাকন শরীর খুবই উপযোগী ছিল একসময় স্পিডস্টার হওয়ার ক্ষেত্রে। যে কারণে টটেনহ্যামে ইন্টারের বিপক্ষে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন বেল। কিন্তু রিয়ালে আসার পর থেকেই বডি বানানোর দিকে মনোযোগ দিতে থাকেন বেল।

বলা বাহুল্য, আপনার পাশে রোনালদোর মত সুঠাম দেহী একজন থাকলে আপনিও সেদিকেই ঝুঁকে পরবেন। ফলে এক বছরের মধ্যে বেলের ওজন ৭৬ থেকে হয় ৮৬ কেজি। যার পুরোটাই ছিল আপার বডি মাসল। একজন স্প্রিন্টারের জন্য স্বভাবতই ব্যাকফায়ার করে জিনিসটা। বেলের আপার বডি মাসলের ওজন সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিল তার পায়ের মাসল। ফলাফল বেল শেষ ৬ বছরে কাফ মাসলের ইনজুরিতে মাঠের বাইরে ছিলেন মোট ১৮৬ দিন।

তবে হ্যাঁ, এটা মানতে দ্বিধা নেই, গ্যারেথ বেলের সামর্থ্য ছিল একসময়, এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা তারকা হওয়ার। রিয়ালের মেইনম্যানের বাডন হাতে নিয়ে অনেকদূর দৌড়ানোর। কিন্তু কোনটাই করতে পারেননি। যদিও দলীয় অর্জন দেখে বেলকে লিজেন্ডের কাতারে ফেলা ভুল হবে না, কিন্তু সেটাই তো সব নয়। বেল হয়তো ক্যারিয়ার শেষে আফসোস করবেন সঠিক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়ার। ফুটবল ক্যারিয়ারে মনোযোগ না দিলে গলফ কোর্সে সময় কাটানোর সিদ্ধান্তকে। অনেক কিছুই হতে পারতেন, কিন্তু পারেননি বলে।

‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’ খ্যাত মরিনহো কম চেষ্টা করেননি। কোচ হিসেবে যতটুকু নিংড়ে দেওয়ার তার থেকে বেশিই দিয়েছেন তিনি। হাজার হলেও এক সময় তাকে রয়্যাল ক্লাবে চেয়েছিলেন। রয়্যাল ক্লাব না হোক, টটেনহ্যামে মিলেছেন দুজনে। তাই বেলের কাছ থেকে সবটা বের করার ইচ্ছে ছিল তার। ফলাফল? গত ছয় মাসের চেষ্টার পর বেল ফিরেছেন। বার্নলির বিপক্ষে দুই গোলই যেন তার প্রমাণ। বেলের ফর্মে ভাটা পরেছে হয়তো, কিন্তু ক্লাস, সেই আগের মতই আছে। ডিফেন্ডারদের মাঝ দিয়ে চিকি রান, অফ-সাইড ট্র্যাপ ভাঙ্গা আর ক্লাসিক্যাল ওয়ান-টাচ ফিনিশ; সব যেন সেই ৪-৫ বছর আগের পুরোনো বেলকেই মনে করিয়ে দিল। শেষ চার ম্যাচে ৭ গোলে অবদান মনে করিয়ে দিল, বেল এখনও ফুরাননি।

বেলের বয়সটা বেশি নয়, মাত্র ৩১। ইউরোপিয়ান খেলোয়াড়দের লংজেভিটির দিকে বয়সটা তেমন কিছু বেশি নয়। এ বয়স থেকেও উঠে আসা সম্ভব। কিন্তু ক্যারিয়ারকে এমন এক দিকে নিয়ে গিয়েছেন বেল, তাতে করে ফেরত আসাটা খুব কঠিন।

এমনকি বর্তমান কোচ হোসে মরিনহো পর্যন্ত থ্রেট দিয়েছিলেন ট্রেনিং সেশনে, ‘আমার কাছে থাকলে ঠিক করে খেল, নইলে রিয়ালে গেলে মাঠ চোখেও দেখবে না।’ ফিটনেস নিয়েও ছিলেন বিরক্ত। তবে সবকিছুই নির্ভর করে ফর্মের উপর। যেমন এতদিন ধরে চলা নিন্দুকের মুখ আজ হঠাৎ করেই চুপচাপ, ধূ-ধূ মরুর মতন শান্ত।

তবে তিনি ফর্মে ফিরুন, কিংবা না-ই বা ফিরুন, দিনশেষে গ্যারেথ ফ্র্যাংক বেল ওয়েলশ উইজার্ডই থাকবেন। মাইথলজিতে তাণ্ডব চালানো ড্রাগনের স্বর্ণযুগের কথা গালভরে বলা হয়, বলা হয় তাকে নিয়ে রাজ্য জয়ের গল্প। কিন্তু তার শেষদিনে শিকলে আটকে থেকে ধুঁকে ধুঁকে মরার গল্প কেউ বলে না। গ্যারেথ বেলের ক্ষেত্রেও হয়তো তেমনটা হবে না। কিন্তু বেলের সামনে সুযোগ আছে ফিনিক্স পাখি হওয়ার। বেল সেই সুযোগ নিয়ে ইতিহাসের অন্যতম হবেন, নাকি পৌরাণিক লোক কথার হাজারো ড্রাগনের মধ্যে একটি হয়ে থাকবেন; সে গল্প ফুটবলকে বিদায় বলার পরেই জানা যাবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...