বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের সমাপ্তি

বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা না জিতেলও লম্বা সময় ধরে ফিফা র‌্যাংকিং এ শীর্ষে থাকা দেশটির নাম বেলজিয়াম। একসাথে অনেকগুলো বিশ্বমানের খেলোয়াড় থাকার কারণে নাম দেওয়া হয়েছিল সোনালী প্রজন্ম। যার মধ্যে সবার আগে যে দুটি নাম আসে সেটি রোমেলু লুকাকু ও এডেন হ্যাজার্ড। কিন্তু ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের পর ইউরো ২০২০ শেষে উয়েফা নেশনস ২০২১ লিগ এ বড় কোন সাফল্য পায়নি ইউরোপের দেশটি।

তাই যে প্রজন্ম নিয়ে এতটা গর্ব আর অহংকার ছিল সেটি এখন অনেকটাই নেতিয়ে পড়েছে। তাইতো এখন পুরো ফুটবল দুনিয়ায় বলাবলি হচ্ছে, বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম বিদায় নিয়েছে। নতুন করে একটা প্রজন্ম তৈরি না হলে আর সাফল্য পাওয়ার বিষয়ে সংশয় আরও দীর্ঘস্থায়ী হলো। সর্বশেস উয়েফা নেশনস লিগ থেকে শুন্য হাতে ফেরার পর ফুরিয়ে যাচ্ছে বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মর সময়, এটি এখন বেশিই করে বলা হচ্ছে। ক্লাসের সবচাইতে ভালো ছাত্র,  পড়া ধরলেই সবার আগে ওঠে তার হাত, ক্লাস টেস্ট থেকে শুরু করে সব পরীক্ষাতেও থাকে মেধা তালিকার শীর্ষে, তবুও সেই ছাত্রটি সেরা নয়। কিন্তু মূল পরীক্ষা এলেই কী যেন এক রোগে পেয়ে বসে তাদের!

এখনই নিজেদের হারিয়ে খুঁজে ফেরার শুরু হয়ে যায়। স্কুল থেকে ভার্সিটি জীবনে এমন অনেকের দেখা মিলে আমাদের সবার জীবনে। অনেকের সহপাঠিদের এমন পরিণতিতে ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা খুজছেন কেউ কেউ। কথাগুলো আবার অনেকের সাথে মিলেও যায় অনেক সময়। তবে সা¤প্রতিক সময়ে ফুটবলে ক্লাসের সেই অভাগা ছাত্রটির ভাগ্যই যেন ভর করেছে বেলজিয়াম ফুটবল দলের উপর! ক্লাসের ভাল আর সেরা ছাত্রটিও তাই ফাইনাল পরীক্ষায় সেরা ফলাফল দেখাতে পারছেনা।

২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সর্বাধিকবার শিরোপা জয়ী ব্রাজিলকে হারানোর পর থেকে যে কোনো টুর্নামেন্টের শুরু থেকে তাদের গায়ে থাকে ফেভারিটের তকমা। থাকবেই না বা কেনো সেটাও হতে পারে একটা বড় প্রশ্ন? দলে রয়েছেন একঝাঁক সময়ের সেরা খেলোয়াড়ের সমন্নয়। কেভিন ডি ব্রæইন, এডেন হ্যাজার্ড, রোমেলু লুকাকু আর থিয়াবো কোর্তোয়াদের মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া দল শেষ তিন বছর যাবৎ রয়েছে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে! তবে ট্রফির ছোঁয়া কোনো মতেই যেন পাচ্ছে না দলটি।

তীরে গিয়ে বারবার তরী ডুবানোর ভুলটা করেই চলেছেন লুকাকু-হ্যাজার্ডরা। ফুটবল সংশ্লিষ্ট অনেকেই তাই মনে করছেন, আগামী বছরের কাতার বিশ্বকাপই রোমেলু লুকাকু, এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডি ব্রæইনদের শিরোপা জেতার শেষ সুযোগ হিসেবে ধরা হচ্ছে। তবে নিজেদেরে ইউরোপিয়ান কন্ডিশনে সাফল্য না পাওয়া কাতারের মতো কঠিন কন্ডিশনে সাফল্য পাওয়া নিয়ে সংশয় থাকছেই।

২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলকে বিদায় করে দিলেও সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হেরে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায় রবার্তো মার্টিনেজের শিষ্যদের। এরপর এবারও নেশনস কাপের ফাইনাল খেলা হলো না সেই ফ্রান্সের সাথে হারার কারণে। বেলজিয়াম প্রথমার্ধে ২-০ গোলের লিড নিলেও ম্যাচশেষে স্কোর দাঁড়ায় ২-৩ এ!

অসাধারণ এক প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে বেলজিয়ামকে চরমভাবে হতাশ করে ফ্রান্স। গত ইউরোতেও একরাশ হতাশা নিয়ে ফিরতে হয়েছিল লুকাকুর দলের। সেবার শেষ আটের লড়াইয়ে ২-১ গোলে হারে চ্যাম্পিয়ান ইতালির কাছে। সমর্থকদের এমন সব তিক্ত হারের স্বাদ দেওয়ায় আগামী কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে তেমন আশাবাদী নন বেলজিয়াম ফুটবল ধারাভাষ্যকার পিটার ভনডানবেম্পটও। দলেরবর্তমানে ফলাফলে অনেকেই হতাশ হয়েছেন।

খুব কাছ থেকে বেলজিয়াম দলকে দেখা এই ধারাভাষ্যকার জানিয়েছেন, ’বেলজিয়ামের খেলার ষ্টাইল নিয়ে কারও কোন অভিযোগ নেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক টুর্নামেন্টে ব্যর্থ হওয়ার কারণে কাতার বিশ্বকাপে এই প্রজন্সের সাফল্য পাওয়ার আশা অনেকটাই কমে গেছে। বিশ্বকাপ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে আমাদের’।

বেলজিয়াম জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়াড় মার্ক দিগ্রিস এভাবে একের পর শিরোপার জেতার সুযোগ হারানোয় বর্তমান দলের ওপর রীতিমত বিরক্ত প্রকাশ করে বলেন, ‘কয়টা টুর্নূামেন্টে আপনি ব্যর্থ হতে পারেন। আমি তো এ দৃশ্য দেখতে দেখতে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এটা অনেক দুঃখজনক ব্যপার যে, এই প্রজন্ম এভাবে শিরোপা জেতার সুযোগ নষ্ট করেছে। এটার কোনো দরকার ছিল না বলে আমি মনে করি।’

ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্মের সামনে শেষ সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কাতার বিশ্বকাপ নিজেদের করে নেওয়ার। তা না হলে শেষপর্যন্ত ট্রফিশুন্যই থাকতে হবে দেশটির সোনালী প্রজন্মকে। অথচ এক হাজারের বেশি দিন ধরে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর দল বেলজিয়াম। ক্লাব ফুটবলের বেশ কয়েকজন তারকা ও প্রতিভাবান ফুটবলারের উপস্থিতি থাকার কারণে বর্তমান দলটিকে বলা হয় ’গোল্ডেন জেনারেশন’। কিন্তু ২০১৮ বিশ্বকাপের পর আরেকটি সুযোগ নষ্ট করে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম।

বয়সের পাশাপাশি ফর্ম-ইনজুরিসহ নানা কারণে সুনির্দিষ্ট একটি ব্যাচ দীর্ঘদিন খেলতে পারে না। যে কারণে ভালো একটি স্কোয়াডের স্থায়িত্বও অনেক দিন বেশি হয় না। ২০১৪ বিশ্বকাপে শেষ আট, ২০১৮ বিশ্বকাপে শেষ চার আর ২০২০ ইউরোয় শেষ আটে গিয়ে বাদ যাওয়ায় স্বভাবতই হতাশ কোচ রবার্তো মার্টিনেজ কষ্ট লুকিয়ে রাখতে পারেননি, ’এই দলটার জন্য খুব কষ্ট লাগছে, হতাশাও তাই বেড়েই চলেছে। কারণ, এই খেলোয়াড়দের বিদায় এভাবে হলে সেটাকে মেনে নেবার মতো নয়। যদিও তারা নিজেদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সবই করেছে।’

তবে আগামীর পথে কিছুটা আশার আলো হয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন ১৯ বছর বয়সী উইঙ্গার জেরেমি ডোকুর মতো তরুণরা। পাশাপাশি ডি ব্রুইন, হ্যাজার্ড, লুকাকুরা থাকলে আশার আলো হবে আরও উজ্জ্বল। তবে বেলজিয়ামের সোনালি প্রজন্ম নাকি এখন ‘দুর্ভাগা প্রজন্ম’ হয়ে দেখা দিয়েছে। দুর্দান্ত দল হয়েও একাধিক বার শুন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে বেলজিয়ামকে। একটু যদি বিশ্লেষন করা হয় দলটিকে তাহলে দেখা যাবে, দুর্দান্ত গতিময় ফুটবলের পাশে আক্রমণভাগে আছেন লুকাকু –হ্যাজার্ডের মতো ক্ষিপ্র গতির খেলোয়াড়।

মাঝমাঠে রয়েছেন সময়ের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার কেভিন ডি ব্রুইন। রক্ষণভাগে অভিজ্ঞ থমাস ভারমিলেন আর জান ভারটংগেন। আর সবার পেছনে গোলপোস্টের নিচে থিবো কর্তোয়া নামের দৃঢ় এক দেয়াল থাকার পর এই দলটা নিজে বাজি না ধরার মতো মানুষ কি খুব একটা খুজে পাওয়া যাবে ফুটল দুনিয়ায়।

ঠিক একই সময়ে বিশ্বমানের এত ফুটবলারকে একসঙ্গে একটি দলে পাওয়া বেলজিয়াম লম্বা সময় ধরে নিজেদের অন্যভাবে চিনিয়ে রেখেছে। এই সময়ে বেলজিয়াম একমাত্র দল যারা, বড় কোনো শিরোপা না জিতেই লম্বা সময় ধরে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থেকেছে। ভবিষ্যতে হয়তো থাকবে, তবে সোনালী প্রজন্ম নিয়ে একটা হতাশা থাকবেই। সেটি দেশটির ফুটবলপ্রিয়দের পাশাপাশি বোদ্ধাদেরও হতাশা বাড়িয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link