মহেন্দ্র সিং ধোনি, রহস্যময় ধাঁধা

স্কুল ক্রিকেট থেকে বিশ্বকাপ; খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশনের টিকেট চেকার থেকে ওয়াংখেড়ে’র নায়ক; যিনি মাঠে নামলেই গ্যালারি থেকে দর্শকের চিৎকার শোনা যায়। স্বপ্নকে বাস্তবের মাটিতে নিয়ে এসেছেন যে কিংবদন্তী, তিনিই হলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। শূণ্য থেকে শুরু করেছিলেন তাঁর ক্রিকেট জীবন। মাহি থেকে হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম বড় নাম মহেন্দ্র সিং ধোনি।

একটি দলে একজন অধিনায়কের ভূমিকা কি শুধু দলকে নেতৃত্ব দেওয়া কিংবা খেলার মাঠে খেলোয়াড়দের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? না, এর বাইরেও একজন অধিনায়কের দায়িত্ব থাকে তাঁর দল এবং তার দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। 

কঠিন পরিস্থিতিতেও হাল না ছেড়ে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেওয়া। তবেই তো তিনি নায়ক। তবেই তো তিনি অধিনায়ক। অধিনায়কত্বও যে একটি শিল্প হতে পারে তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন রিকি পন্টিং আর সেটিকে পূর্ণতা দিয়েছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। 

ভারতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে যেমন অর্জন করেছেন অগনিত তেমনি চেন্নাইয়ের হলুদ জার্সিতে অধিনায়কত্ব করেও জিতেছেন, জিতিয়েছেন বহুবার। এর মাঝে আছে কত কত অবিশ্বাস্য জয়, হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়া অনেক ম্যাচেও দলকে তীরে ভিড়িয়েছিলেন। 

শুধু ব্যাট হাতে নয়, অধিনায়কত্ব দিয়েও প্রতিপক্ষকে বিস্মিত করেছিলেন। এই যেমন, ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে শেষ ওভার করতে দিয়েছিলেন জোগিন্দর শর্মাকে। অথচ এর আগে জোগিন্দর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন হাতেগোনা কয়েকটি। ধোনির বুদ্ধিমত্তা আর জোগিন্দরের স্নায়ুচাপ সামলানোর ক্ষমতা সেদিন বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিল ভারতকে। 

একই বিশ্ব আসরে ঐতিহাসিক ‘বল আউট’-এ ভাল বোলারদের বল না দিয়ে ধোনি বল তুলে দিয়েছিলেন অপেক্ষাকৃত ভাল ফিল্ডারদের হাতে। তাঁর এই বাজিও কাজে লেগে যায়, সেদিনও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় ভারত।

২০১১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ তো মহেন্দ্র সিং ধোনির ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় হাইলাইট৷ পুরো আসরে নিজের ছায়া হয়ে থাকা ধোনি ফাইনালে আরেকটি জুয়া খেলেছিলেন। ইনফর্ম যুবরাজকে বসিয়ে রেখে নিজেই ব্যাট হাতে মাঠে নেমেছিলেন। 

এরপর যা ঘটেছে সেটি মহাকাব্য। অপরাজিত ৯১ রান করে ভারতকে ২৮ বছর পর ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় যজ্ঞে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। ধোনির জীবনী বারবার একটা কথাই বলে গিয়েছে, ঝুঁকি নিলে কিছু অর্জন করা যাবেই – সফলতার নির্দিষ্ট কোন পথ নেই।

দেশকে সবার আগে স্থান দেয়া মহেন্দ্র সিং ধোনিক আরো মহিমান্বিত করেছে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ। চলাকালীন কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের মাঝপথে দলকে ছেড়ে যাননি সাবেক ভারতীয় অধিনায়ক। অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন, দেশের জন্য খেলাটা তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দেশপ্রেমের টানে ভারতীয় আর্মির সাথেও সখ্যতা গড়ে তুলেছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। 

বাংলাদেশের বিপক্ষে একটা রান আউট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির। ২০১৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রান আউট দিয়ে সেই ক্যারিয়ারে ফুল স্টপ পড়ে যায়। উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ এক ক্যারিয়ারে ধোনি রান করেছেন, ধোনি কিপিং করেছেন ধোনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। 

এই সবগুলো কাজেই তিনি ছিলেন সেরাদের একজন। একটা পুরো প্রজন্মে অনুপ্রাণিত করেছেন ধোনি। তাদের এমন কিছু শিখিয়েছিলেন যা কোন বিদ্যালয় শেখায় নি। তাদের লড়তে শিখিয়েছেন, তাদের ঝুঁকি নিতে শিখিয়েছেন। সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা দিয়েছেন সেটা হলো আত্মবিশ্বাস, তাকলেগে দেখেই কত কত হতাশ ব্যক্তিরা আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

যে গল্পের শুরু আছে, সে গল্পের একটা শেষও আছে। ধোনি নামক গল্পের শেষপৃষ্ঠাতেও তাই রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আর কোন মহেন্দ্র সিং ধোনিকে দেখা যাবে না। তবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) আরো এক আসর খেলা নিশ্চিত করেছেন রাঁচির সন্তান। আর তাই ধোনির দুর্ভেদ্য রহস্য আরো কিছুটা সময় উপভোগের সুযোগ থেকে গিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link