নেভিল কার্ডাসের অনিশ্চিত ক্রিকেটকে তুলনা করা যায় বিশাল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে; ঢেউগুলো যেমন উঁচু করে ধেয়ে এসে হঠাৎই ভেঙে পড়ে তেমনি ক্রিকেটেও মুহূর্তের মাঝে ঘটে যেতে পারে অবিশ্বাস্য কিছু। তবে অনিশ্চয়তায় ভরপুর এই খেলাতেও অন্তত এতটা চমক আশা করেনি কেউই, পুরো বিশ্বকে থমকে দিয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে ছিটকে গিয়েছে এক সময়ের পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ছাড়াই আয়োজিত হবে কোন বিশ্বকাপ, অথচ এই উইন্ডিজরাই কি না ওয়ানডে বিশ্বকাপের প্রথম দুই আসরের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জিতেছিল। বছর দশেক আগেও ক্রিকেটের বৈশ্বিক শিরোপা জেতা দলটি এখন বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি; মনে হয় যেন জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা কোন সূর্য চোখের পলকে নেমে এসেছে দিগন্তের কাছটাতে।
আসন্ন ২০২৩ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে জিম্বাবুয়েতে গড়িয়েছে বাছাই পর্বের ম্যাচগুলো। সেখান থেকে বিশ্বকাপে জায়গা করে নেয়া সম্ভাব্য দুই দল হিসেবে শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম শোনা গিয়েছিল সবচেয়ে বেশি। অথচ সময়ের সাথে বদলে গিয়েছে দৃশ্যপট। লঙ্কান সিংহরা নিজেদের কাজটা করলেও থেমে গিয়েছে ক্যারিবিয়ানদের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন।
ভারতের বিমান ধরার মিশনে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরাজয় প্রথম ধাক্কা হয়েই এসেছিল। এরপরও সুযোগ ছিল ঘুরে দাঁড়ানোর, কিন্তু নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে নাটকীয় এক পরাজয়ে সেই আশা প্রায় শেষ হয়ে যায় দলটির। অবশ্য কাগজে কলমে তখন স্বপ্নটা জিইয়ে ছিল পুরান, হোল্ডারদের জন্য।
কিন্তু শেষমেশ সুপার সিক্সে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে অসহায় আত্মসমর্পণ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পুরোপুরি ছিটকে ফেলেছে বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার রাস্তা থেকে। বাদ বাকি দুই ম্যাচ জিতলেও তাই এবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলা হবে না দুই বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
শুধু ম্যাচের ফলাফলই নয়, মাঠের পারফরম্যান্সেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল বড্ড অচেনা। এই যেমন নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৩৭০ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়েও ম্যাচ জিততে পারেনি দলটি, উল্টো সুপার ওভারে ৩০ রান হজম করে জন্ম দিয়েছে বিনোদনের। আর পরের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তো ২০০ রানের গন্ডিই টপকাতে পারেনি ক্যারিবিয়ানরা।
অবশ্য বাজে ফর্মের চেয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটারদের নিবেদনের ঘাটতি চোখে পড়েছে বেশি। মাঠের ফিল্ডিংয়েও দেখা গিয়েছে খাপছাড়া ভাব; ক্যাচমিসের সাথে যেন বন্ধুত্ব করেছিল তাঁরা। বাছাই পর্বের আগে কিংবদন্তি ড্যারেন স্যামি কোচ হয়ে এসেছিলেন। হয়তো আশা ছিল দারুণ কিছু করে দেখাবেন, নিদেনপক্ষে ভারতে যাওয়ার টিকিট নিশ্চয়ই পাবেন। কিন্তু এখন তাঁকে শুরু করতে হবে শূন্য থেকে।
ভিভ রিচার্ডস, লর্ড ক্লায়েভ কিংবা এই শতাব্দীর ব্রায়ান লারা থেকে শুরু করে হালের ক্রিস গেইল, ড্যারেন ব্রাভো – প্রজন্মের পর প্রজন্ম দর্শকদের মাঝে অদ্ভুত এক আনন্দ ফেরি করে বেড়িয়েছিলেন এদের সবাই। ক্রিকেটটা শুধুই পেশা ছিল না, ছিল উৎসবের খোরাক।
এত কিছুর পরেও অবশ্য দেশের জার্সিতে নিজেদের সেরাটা দিতে একটুও ভুল হয়নি গেইল, সামিদের। অথচ এখন নিকোলাস পুরান, শিমরন হেটমায়াররা যেন ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলতে পারলেই খুশি।
বোর্ডের সাথে দ্বন্দ, পাইপলাইনে দুর্বলতা এতকিছুর পরেও এবারের বিশ্বকাপে হয়তো উইন্ডিজের মেরুন পতাকার দেখা মিলতো যদি ক্রিকেটাররা নিজেদের শতভাগ দিতে পারতেন; কিন্তু তাঁরা সেই চেষ্টাটুকুও সম্ভবত করেনি।
স্কটল্যান্ডের জয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ইয়ন বিশপের মুখচ্ছবি আপনি কি দেখেছেন ? কালজয়ী এই ধারাভাষ্যকারও তখন শব্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন; সেই সাথে বিস্মিত হয়েছিল সব ক্রিকেটপ্রেমীরাও। বিশ্বকাপের মূল আসরেও হয়তো দেখা যাবে ইয়ন বিশপকে, তখন মনের অজান্তে ঠিকই খুঁজে বেড়াবেন তাঁর উত্তরসূরিদের।