ভারতীয় ক্রিকেটের দুই শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক আর অন্যতম দুই বিতর্কিত চরিত্রের জন্মদিনও খুব আশ্চর্যজনক ভাবে পর পর দুই দিন। তাই আলাদা আলাদা করে কিছু লেখার থেকে, আজ ভাবলাম দুজনকে নিয়েই একসাথে একটা লেখা লিখি। অনেকটা স্মৃতিচারণ, সমালোচনাবিহীন, শুধুই ভারতীয় ক্রিকেটের দুজন কিংবদন্তিকে মনে রাখা।
১৯৯৬ সাল, আমি তখন ক্লাস সিক্সে উঠেছি। তার আগে অবধি পাড়ার কাকু ও দাদাদের থেকে শুনে আসছি ভারতীয় ক্রিকেটে বাঙালিদের প্রতি বঞ্চনার ইতিহাস। কিভাবে ৩ উইকেট পাওয়া সুব্রত ব্যানার্জিকে আর বলই দিলেন না মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। কিভাবে উৎপল চ্যাটার্জী ভারতের সেরা বাঁহাতি স্পিনার হওয়া সত্ত্বেও দিনের পর দিন ধারহীন রাজু খেলে গেলেন।
কিভাবে সৌরভ গাঙ্গুলি নামের এক স্টাইলিশ বাঁহাতি ব্যাটসম্যান ৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে একটামাত্র ওয়ান ডে খেলেই বাদ পড়লেন, আর টিমে চান্স পেলেন না। কিন্তু এইবার, এইবার ৪ বছর পরে ইংল্যান্ড সফরের প্রাথমিক দলে রাখা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু চান্স কি পাবেন? প্রথম টেস্টে প্রথম এগারোয় জায়গা হলো না। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টের আগে হঠাৎ সেই আজহারউদ্দীনের সাথে ঝামেলা লাগলো নভজ্যোৎ সিংহ সিধুর। মাঞ্জরেকারের ও চোট। বাধ্য হয়ে দলে নিতে হলো গাঙ্গুলিকে।
কিন্তু প্রথম টেস্টেই লর্ডসের সিমিং পিচে তিন নম্বরে ঠেলে দেওয়া হলো তাকে। পাড়ার ক্লাব এ গিয়ে প্রথম দিন তার দুই উইকেট পাওয়া আমার দেখা হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাড়িতে কেবল নেই। স্কুল থেকে ফিরে বার বার কাকু আর দাদাদের প্রশ্ন, সৌরভ কত করলো? হাফ সেঞ্চুরি শুনে স্বস্তি!! যাক, আর চট করে বাদ দিতে পারবে না। কিন্তু সৌরভ খেলে যাচ্ছেন। সঙ্গে এক কর্ণাটকি, তারও প্রথম টেস্ট। নাম রাহুল দ্রাবিড়।
নাম শুনেই কেমন ইতিহাস বই এর সিন্ধু হরপ্পা সভ্যতার কথা মনে পড়ে যায়। দুজনে মিলে রান নিয়ে গেলেন ইংল্যান্ড এর স্কোর এর ওপারে। অবশেষে সবার আশা আশংকা কে সত্যি করে সৌরভ যখন ডমিনিক কর্কের বলটা কভার ড্রাইভ করে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ব্যাট এবং হাত মাথার উপরে তুলে ঝাঁকাচ্ছেন, তখন গোটা পশ্চিমবঙ্গের সব বঙ্গবাসীর মন নিশ্চই একইরকম উদ্বেল হয়ে উঠেছিল।
সঙ্গের কর্ণাটকি যুবক, চিরকালের ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ব্যক্তি রাহুল সেঞ্চুরি পান নি, কিন্তু শুরু হয়েছিল এক দীর্ঘ যাত্রাপথের, যার মধ্যে দুজনে মিলে ভারতকে অনেক ম্যাচ এবং সিরিজ জেতাবেন। পরের টেস্টেও এলো সেঞ্চুরি, সিরিজ সেরা হয়ে শ্যাম্পেনের বোতল নিয়ে দেশে ফিরলেন মহারাজ।
১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ইনডিপেনডেন্স কাপ। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করে এখানে। প্রতিটি দেশ প্রত্যেকের সাথে তিনটে করে গ্রুপ লিগে ম্যাচ খেলে। গোটা টুর্নামেন্টে দুরন্ত ফর্মে ছিলেন সচিন। সেঞ্চুরি না পেলেও ম্যান অফ দা সিরিজ তিনিই হন। গোটা টুর্নামেন্ট দেখেও, একজন আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্যে আমরা ঠিক ফাইনালের আগের দিন দিল্লি রওনা হই। দিল্লি তে ট্রেন থেকে নেমে নিউসপেপার পড়ে জানতে পারি কি অসাধারণ একটা ম্যাচ মিস করেছি। পরে অজস্রবার হাইলাইটস দেখেও আমার সেই আক্ষেপ মেটে নি। সৌরভের জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ উইনিং ওয়ান ডে ইনিংস তিনি খেলেছিলেন সেদিন।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ। এর মধ্যে কেটে গেছে তিনটি বছর, ভারতের টেস্ট এবং একদিনের দলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছেন সৌরভ। প্রতি বছর ১৩০০ এর উপরে ওয়ান ডে রান করছেন, বিশ্বকাপে সেই কর্ণাটকি ব্যাটসম্যান সবচেয়ে বেশি রান করলেও, আসল ইনিংসটা খেলে বেরিয়ে গেলেন এই বঙ্গসন্তান।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে মরণ বাঁচন ম্যাচে বিশ্বরেকর্ড করে রাহুলের সাথে খেললেন ৩১৮ রানের পার্টনারশিপ আর শ্রীলঙ্কার বোলারদের আক্ষরিক অর্থেই নদীতে ফেলে দিয়ে করলেন বিশ্বকাপে কোনো ভারতীয়ের করা সর্বোচ্চ রান, ১৮৩। সেই বিখ্যাত মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন আর অজয় জাদেজার ( যারা পরবর্তীকালে ম্যাচ ফিক্সিং এর কারণে কুখ্যাত ও নির্বাসিত হবেন) একটু সাহায্য পেলে হয়তো ওয়ান ডে ক্রিকেটের প্রথম ২০০ হয়ে যেত সেদিন।
২০০০ সালের মার্চ মাস। আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। এমন সময় ভারতীয় দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। আজহার এখন অতীত, শচীন আগ্রহী নন, ক্যাপ্টেন হিসেবে তার পারফরমেন্স আমরা আগেই দুবার দেখে নিয়েছি। শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সৌরভ-অধিনায়কত্বে প্রথম সিরিজ জিতলো ভারত। ততদিনে বাড়িতে এসে গেছে কেবল চ্যানেল।
মাধ্যমিকের ফাঁকে ফাঁকেই খেলা দেখা চলছে। শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়, এক বাঙালির নেতৃত্বে প্রথমবার ভারতীয় ক্রিকেটের পথ চলা। প্রথম বছরেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনাল, চমক দিয়ে যুবরাজ এবং জাহির কে তুলে আনা এবং নিজের ব্যাটে একের পর এক ম্যাচ জেতানো ইনিংস, দাদাগিরি চলতে লাগলো।
২০০১ সাল। আমি তখন নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের আবাসিক কলেজের ছাত্র, উচ্চমাধ্যমিক দেব পরের বছর। অস্ট্রেলিয়া এলো ভারতে, স্টিভ ওয়াহ হুঙ্কার দিলেন টানা ১৫ টেস্ট জেতার পরে ১৬, ১৭ এবং ১৮ নম্বর ও হবে ভারতের বিরুদ্ধে, ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার হলো ভারত থেকে সিরিজ জিতে ফেরা। সৌরভ ও পিছিয়ে থাকলেন না, তৎকালীন বিশ্বের সেরা অধিনায়কের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিলেন, ১৬-১৭-১৮ সংখ্যা গুলো নিয়ে যেন স্টিভ বেশি না ভাবেন, কেননা সেটা আকাশকুসুম কল্পনা ছাড়া কিছুই না।
অস্ট্রেলিয়া ভারতকে দুরমুশ করলো মুম্বাই তে এবং ১৬ নম্বরে পৌঁছে গেলো। পরের টেস্ট ইডেনে, প্রথম ইনিংসে ফলো ও করেও দ্বিতীয় ইনিংসে লক্ষণ রাহুলের অমর পার্টনারশিপ, মনে আছে, সকালে কলেজ যাবার সময় দেখে গেলাম ওঁরা ব্যাট করছেন, ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যেসব সাহসী ছেলেরা পকেট ট্রান্সিস্টর নিয়ে আসে, তাদের কাছ থেকে স্কোর শোনা চলছে, সেই লক্ষ্মণ-রাহুল খেলে চলেছেন, আস্তে আস্তে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর কাছে চলে আসছে, লিড হয়ে গেলো, তাঁরা ব্যাটিং করে চলেছেন।
কলেজ থেকে ফিরে ডাইনিং হলে বসে টিভিতে শেষবেলার ব্যাটিং কিছুটা দেখলাম, পরে হাইলাইটস, ওয়ানস ইন এ লাইফটাইম এ জিনিস দেখা যায়। পরের দিন হরভজনের ঘূর্ণিতে চায়ের পরে কেৎরে পড়লো অস্ট্রেলিয়া। স্টিভ কে টসের সময় দাঁড় করিয়ে রাখা সৌরভ রুখে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিজয়রথ। পরের টেস্টে সচিন করলেন শতরান, আর ইডেন টেস্টের শক থেকে বোধ হয় অস্ট্রেলিয়া পুরোপুরি রিকভার করেনি, তারা আবার হরভজনের সামনে ভেঙে পড়লো। শেষবেলায় হরভজন আর দীঘে এনে দিলেন অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় এক সিরিজ জয়, যা আজও বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কামব্যাক বলে স্বীকৃত।
২০০২ সালে আমি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হই। হোস্টেলে চলে যাবার আগে হয় এই বছরের সবথেকে উল্লেখযোগ্য টুর্নামেন্ট ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি। গোটা টুর্নামেন্টে ভালো খেলেন শচীন, সৌরভ, দ্রাবিড় সবাই। ফাইনালে ইংল্যান্ড এর ৩২৫ রানের পরে সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছেন, শেবাগকে নিয়ে লড়াই শুরু করেন সৌরভ। ৬০ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেলে আউট হবার পরেই হঠাৎ ধ্বস নামে ভারতীয় ইনিংসে।
পর পর ফিরে যান দ্রাবিড়, মোঙ্গিয়া এবং শচীন ও। এই অবস্থা থেকে দুরন্ত খেলে জয় এনে দেন তরুণ তুর্কি যুবরাজ সিংহ আর মোহাম্মদ কাইফ। উইনিং রানের পরে লর্ডস এর ব্যালকনিতে টি শার্ট উড়িয়ে খালি গায়ে আরেক দাদাগিরি প্রত্যক্ষ্য করলাম আমরা সবাই। তবে, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ওয়াইড না দেওয়া, কুম্বলে কে ভুল আউট যে দেশের আম্পায়ার রা দেয়, সেই দেশের ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসের ব্যালকনিটা জামা ওড়ানোরই জায়গা। ভদ্রতার নয়।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপের আসর, দক্ষিণ আফ্রিকায়, এবং সৌরভের নেতৃত্বে বেশ শক্তিশালী ভারতীয় দল যথেষ্ট ভালো পারফর্ম করে। এই টুর্নামেন্টের অধিকাংশ ম্যাচ আমি দেখেছিলাম হোস্টেল এর বন্ধুদের সঙ্গে কমন রুমের টিভিতে। ভারত অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত পাকিস্তানের মতো দুটো হাইভোল্টেজ ম্যাচ ইউনিভার্সিটি হলের বড়ো পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থা হয়।
সে এক আলাদা অভিজ্ঞতা ছিল, বিশেষ করে পাকিস্তান ম্যাচে যখন শচীন ধ্বংস করছেন শোয়েবকে, ছাত্রদের চিৎকারে মনে হচ্ছিলো বোধ হয় স্টেডিয়াম এই বসে আছি। শচীন-সৌরভ দুজনেই গোটা বিশ্বকাপে ভালো খেললেও, ফাইনালে স্বপ্নভঙ্গ হয়। তবুও ১৯৮৩ এর পরে বিদেশের মাঠে এই পারফরমেন্স যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবি রাখে। এই বিশ্বকাপে সৌরভ দ্রাবিড় কে দিয়ে উইকেটকিপিং করিয়ে দলে ব্যাটিং গভীরতা বাড়িয়েছিলেন।
২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারত গেলো অস্ট্রেলিয়া সফরে। আগেরবার শচীনের নেতৃত্বে শোচনীয় ফল করেছিল ভারত। সৌরভ গাঙ্গুলি ততদিনে ওয়ান ডে তে ভারতের কেন, বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। কিন্তু টেস্টে? টেস্টে রাহুল তাঁকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছেন। তিন নম্বরে অভিষিক্ত হওয়া সৌরভ এখন পাঁচ নম্বরে খেলেন। শচীন রাহুল এমনকি লক্ষ্মণ ও ইডেনের মহাকাব্যিক ইনিংসের পরে ব্যাটসম্যান হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান দের কাছে অনেক বেশি নম্বর পান।
শেবাগ আছেন মারকাটারি শুরু করতে। কিন্তু সৌরভ? শুধুই কি দলের ক্যাপ্টেন? প্রথম টেস্টে বৃষ্টিবিঘ্নিত ব্রিসবেন দেখলো বাঙালি ক্যাপ্টেনের দাদাগিরি। ৩ উইকেট পড়ে যাবার পরে লক্ষণ কে সঙ্গে নিয়ে খেললেন আমার দেখা ব্রিসবেনে কোনো ভারতীয়ের সেরা ইনিংস ( হ্যা,ঋষাভ পান্তের ৮৯* মাথায় রেখেই)। ফাস্ট বোলার গিলেস্পি, বিকেল, ব্রাকেন কে স্ট্রোকপ্লের ফোয়ারা ছুটিয়ে ফেললেন বাউন্ডারির বাইরে, ম্যাকগিল ই বা আর বাদ যাবেন কেন, তিনি আর যাই হন, ওয়ার্ন তো নন, মার খেলেন তিনিও।
আজও আমার মনে হয়, ওই ১৪৪ রানের ইনিংসটাই পুরো সিরিজ এবং পরবর্তীকালে এই ভারতীয় দলের বিদেশে বুক চিতিয়ে লড়ার জমিটা তৈরি করে দিয়েছিলো। পরের টেস্টেই সেই কর্ণাটকি যুবক করলেন বিদেশের মাঠে কোনো ভারতীয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পারফরমেন্স, সিরিজে লিড নিলো ভারত। যদিও জেতার মতো জায়গায় থেকেও সিরিজ ড্র করে ফিরতে হয় ভারতকে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ড্র করে ফেরার কথাই বা এর আগে কজন ভারতীয় ক্যাপ্টেন ভেবেছেন আর কাজে করে দেখিয়েছেন?
এরপরে এলো আরেকটা টুর, ২০০৪ পাকিস্তানে ভারত যাচ্ছে বহু বছর পর, ১৯৮৯ সালে সচিন ষোলো বছর বয়সে পাকিস্তান গেছিলেন, এবং একমাত্র তিনি এই দলের সদস্য। এবারে কিন্তু শুরু হলো দল হিসেবে দাদাগিরি। ওয়ান ডে সিরিজে ৩-২ ফলে জেতার পরে, টেস্টে শেবাগ করলেন কোনো ভারতীয়ের প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি, মুলতানের সুলতান আখ্যা পেলেন। নির্ণায়ক টেস্টে দ্রাবিড় করলেন ২৭০, পাকিস্তান দুটো টেস্টেই হারলো ইনিংসে। মাঝের টেস্ট টা অবশ্য ভারত হেরেছিল, কিন্তু সে আর কে মনে রেখেছে!
২০০৫ সালের এপ্রিল মাস। আমি তখন আইআইটি খড়গপুরের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। হাওড়া খড়্গপুর ট্রেন এ যাতায়াত প্রায় সাপ্তাহিক ঘটনা ২০০২ সাল থেকে! তখন অবশ্য জানিনা এক ঝাঁকড়া চুলের বিহারি যুবক কে খড়্গপুর স্টেশন এ ডিউটি করতে দেখেছি কিনা! কিন্তু কমন রুম এর টিভির পর্দায় চোখ পড়লো, পাকিস্তান সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে। সচিন মাত্র ২ রানে ফিরে যাবার পর নতুন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে সৌরভ পাঠিয়ে দিলেন তিন নম্বরে। অন্যদিকে তখন পাকিস্তান বোলারদের ধ্বংস করছেন শেবাগ, বরাবরের মতো।
এরপরের দু ঘন্টায় যা দেখলাম, আমার আর সেকেন্ড হাফের ক্লাস করা হলো না। যদিও তখন সিনেমা রিলিজ হয়নি বলে ‘মাহি মার রাহা হ্যায়’ শব্দগুচ্ছ আমাদের কারুরই জানা ছিলোনা। হোস্টেলে চলতি ভাষায় ‘ধোনি ক্যালাচ্ছে’ টাই এরপর থেকে কমন হয়ে যায় আমাদের কাছে। বলতে বাধা নেই, সৌরভ যতজন তরুণ তুর্কিকে সুযোগ দিয়েছেন, ব্যাকিং করেছেন, ইনি তাদের মধ্যে সেরা ছিলেন।
অদ্ভুতভাবেই, ভারতীয় ক্রিকেটে ধোনির আবির্ভাব আর সৌরভের খারাপ ফর্মের জন্যে বাদ পড়া, প্রায় খুব কাছাকাছি সময়ে। ক্যাপ্টেন হলেন সেই মুখচোরা কর্ণাটকি যুবক ( কে ভেবেছিলো আজ তাঁকে নিয়ে বিজ্ঞাপন হবে যেখানে তিনি নিজে ‘ইন্দিরানগর কি গুন্ডা হুঁ ম্যায়’ বলে ব্যাট দিয়ে গাড়ির কাঁচ ভাঙবেন!), শেষ হলো একটা যুগের, যার সূচনা হয়েছিল জন রাইট আর সৌরভ গাঙ্গুলির এক দারুন যুগলবন্দীর মধ্যে দিয়ে। শুরু হলো চ্যাপেল ওয়ে, দ্রাবিড়ের ক্যাপ্টেন্সি তে। এদিকে তখন ওয়ান ডে তে একের পর এক ম্যাচ জেতাচ্ছেন ধোনি।
কখনো যুবরাজ সঙ্গী, কখনো বা অন্য কেউ, দ্রাবিড় নিজেও এই সময়ে বেশ ভালো ব্যাটিং করছিলেন ওয়ানডে তে। একইসাথে বাংলার মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরী হচ্ছিলো সৌরভ কে দলের বাইরে রাখা নিয়ে। এই সময়কার একটা টিভি বিজ্ঞাপন আমার চোখে পড়েছিল, বড়ো করুন, নির্মম এক বিজ্ঞাপন, যেখানে সৌরভ নিজে বলছেন, ‘ম্যায় হুঁ সৌরভ গাঙ্গুলি, ভুলে তো নেহি? অব ম্যায় ফিরসে টিম মে আনে কে লিয়ে বহুত প্র্যাক্টিসে কর রাহা হুঁ…।’
হ্যাঁ, করলেন তিনি প্র্যাক্টিস, ফেরাতে হলো তাকে টিমে, কেননা টেস্টের পাঁচ নম্বর জায়গা আর ওয়ান ডে তে ওপেনিং পসিশনে তার মতো ধারাবাহিকতা কেউ দেখাতে পারেন নি এই দেড় বছরে। দক্ষিণ আফ্রিকার জীবন্ত পিচে এনটিনি, পোলক, কালিস ও নেল কে খেলে করলেন ৫১ নট আউট, ইনিংসের সর্বোচ্চ, ভারত অপ্রত্যাশিতভাবে টেস্ট টি জিতেও নিলো, শ্রীশান্ত এর সামান্য কিছু মনে রাখার মতো পারফরমেন্স এর একটি সেই ম্যাচেই হবার সৌজন্যে। এরপরে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজেও রান করলেন সৌরভ। আবার হয়ে উঠলেন দলে নিয়মিত। কিন্তু এবারে ব্যাটসম্যান হিসেবে। দ্রাবিড় আর তাঁর ভূমিকা এখন অদল বদল হয়ে গেছে।
২০০৭ সাল। আমি তখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে একটি কোম্পানি তে চাকরি করছি। চ্যাপেল এর ছ্যাবলামি তখনো চলছে। বিশ্বকাপের জন্যে শেষ মুহূর্ত অবধি পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একটা আনকোরা দল নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে ঠিক নেই কে কোন পসিশনে খেলবেন। ওপেন কে করবেন? সচিন কি চারে? ওপেনে উত্থাপ্পা না সেহওয়াগ? এইসব বুঝতে বুঝতেই হেরে বসলাম বাংলাদেশের সাথে।
বারমুডাকে দুরমুশ করলেও, আত্মবিশ্বাসহীন এই দল বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট শ্রীলঙ্কার সাথে জিততে পারেনি, পারার কথাও নয়। চ্যাপেল কে দায়িত্ব ছাড়তে হলো। আর কোনো উপায় ছিল না। অন্যদিকে সৌরভ ২০০৭ এ ভারতের সেরা টেস্ট এবং অন্যতম সেরা ওয়ান ডে ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেন। টেস্টে ১১০৬ রান করেন ৬১ এর উপরে গড় রেখে (সেই বছর বিশ্বের দ্বিতীয়, ক্যালিসের পরেই), ওয়ান ডে তেও ১২৪০ রান করেন ৪৪ এর উপরে গড় রেখে ( সেই বছরে বিশ্বে পঞ্চম)।
এর পরে ভারত যায় ইংল্যান্ড সফরে। সেখানে বহু বছর বাদে ১-০ ফলে সিরিজ জিতে ক্যাপ্টেন্সি থেকে অব্যাহতি নেন রাহুল শরদ দ্রাবিড়। এই সিরিজে সৌরভ মোটামুটি ভালো পারফর্ম করেন।
এরপরে সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। শচীন, সৌরভ এবং দ্রাবিড় এই টুর্নামেন্টে খেলতে অস্বীকার করেন। একটা নতুন দল নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা রওনা দেন টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পাওয়া সেই ঝাঁকড়া চুলের তরুণ, মহেন্দ্র সিং ধোনি, যিনি ভারতীয় দলের উইকেটকিপার ব্যাটসম্যানের বহুকালের অভাব ততদিনে মিটিয়ে দিয়েছেন।
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। দিনটি ছিল সোমবার। আজ অবধি কোনো বড়ো টুর্নামেন্টের ফাইনাল সোমবারে হতে দেখিনি, কিন্তু এদিন দেখলাম। গোটা টুর্নামেন্টে কত মুহূর্ত তৈরি হলো। প্রথম ম্যাচেই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সাথে টাই, তারপরে সেই বোল আউট, যা পাকিস্তানী বোলার রা আউটসুইং, লেগ স্পিন ইত্যাদি করে হাস্যকর করে তুললেন। তারপরে ইংল্যান্ড এর সাথে সুপার সিক্সের ম্যাচে যুবরাজ সিংয়ের সেই ১২ বলে হাফ সেঞ্চুরি, স্টুয়ার্ট ব্রড কে মারা ছয় ছক্কা সহ, যা আজও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রেকর্ড।
দক্ষিণ আফ্রিকাকে ক্লোস ম্যাচে ছিটকে দিয়ে সেমিফাইনালে আবার অস্ট্রেলিয়া এবং যুবরাজ সিংহের ৩০ বলে জাদুকরী ৭০ রানে ভর করে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো। সেদিন দেখেছিলাম, উইকেটের পিছনে এক যুবকের বরফশীতল মস্তিস্ক। বোলার দের দুর্দান্তভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করে শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়া যারা একসময় হেডেন ও সাইমন্ডস এর বিধ্বংসী ব্যাটিং এ ভর করে জিতে যাবে মনে হচ্ছিলো, তাদের ধ্বসিয়ে দিলেন। শেষ ওভারে তাদের জেতার আশা ছিলও না। কজন ক্রিকেটপ্রেমী মনে রেখেছেন জানিনা, কিন্তু সেমিফাইনালেও শেষ ওভার কিন্তু করেছিলেন যোগিন্দর শর্মা।
ভারতীয় ক্রিকেটে একটা কথা খুব চালু, যে ফাইনালে শেষ ওভার যোগিন্দর কে দিয়ে ফাটকা খেলেছিলেন ধোনি যেটা খেটে যায়। কিন্তু সেমিফাইনালেও যোগিন্দর কে দিয়ে চাপের শেষ ওভার করিয়ে ধোনি দেখে নিয়েছিলেন যে ছেলেটা বলটা স্লগ ওভারে জায়গায় রাখতে পারে কিনা। ২২ রান দরকার ছিল, যোগিন্দর দেন মাত্র ৬ রান, শেষ বলে একটা চার সহ, এবং তুলে নেন ২ উইকেট।
যাক, আশা যাক ফাইনালের কথায়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও উঠেছে ফাইনালে, যাকে বলে একদম হাইভোল্টেজ ম্যাচ। সোমবারে আমার একটা ইন্টারভিউ ছিল, পিডব্লিউসি তে। সকাল থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। ফাইনাল আবার বিকেলের দিকে খেলা। জানিনা ইন্টারভিউ দিতে গেলে কখন আবার ফিরবো, বৃষ্টিতে সেক্টর ফাইভ তখন জলে ডুবে থাকতো। ঘুম থেকে উঠে অফিস তো গেলাম ই না, উল্টে পিডব্লিউসি তে ফোন করে জানালাম আমার শরীর খুব খারাপ, আজকে ইন্টারভিউ দিতে যেতে পারবো না।
এইচ আর খুবই অসন্তুষ্ট হলেন, বললেন পরে তিনি আবার আমার ইন্টারভিউ শিডিউল করবেন। আমি জানতাম করবেন না, গত ১৪ বছরেও সেই কল আর আসেনি। যাই হোক, বিকেল ৫.৩০ থেকে ম্যাচ শুরু। ভারত টস জিতে ব্যাটিং নিলো, এবং গোটা টুর্নামেন্টে ভালো খেলে এসে ফাইনালে ফ্লপ করলো। গৌতম গম্ভীরের ৭৫ না থাকলে সেদিন ভারত জেতা দূরের কথা, লড়াই ও করার জায়গায় যায় না।
কিন্তু ভারত ১৫৭ করলো, এবং পাকিস্তান একের পর এক উইকেট হারিয়েও মিসবার কল্যানে শেষ ওভারে ১৩ রান, হাতে এক উইকেট অবস্থায় পৌঁছে গেলো। যারা শুধুই ফাইনাল ম্যাচ টা দেখেছিলেন, গভীর রাতের সেমিফাইনালটা দেখেন নি, তারা দেখলেন অচেনা এক ছেলে যোগিন্দরের হাতে বল তুলে দিলেন ধোনি। ফাটকা? হবেও বা। এর পিছনের ক্রিকেটিং লজিক নিয়ে ধোনি আর সৌরভ ভক্তদের মধ্যে অনেক বিতর্ক হয়েছে, তাই সেখানে আর ঢুকছি না। তবে দ্বিতীয় বলে ছয় খেয়েও পরের বলটা স্লোয়ার দিয়ে মিসবাহ কে শ্রীশান্তের হাতে ধরা পড়ান তিনি। আমি নিজের চোখে প্রথম বিশ্বকাপ জয়, সে হোক না টি টোয়েন্টি, দেখি। এর পর থেকে যতবার ভেবেছি এই দিনটার কথা, একবারও ইন্টারভিউ দিতে না যাবার জন্যে আক্ষেপ হয়নি।
২০০৮ সাল। সৌরভ গাঙ্গুলি তখনো দলের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, কিন্তু বিতর্কিত অস্ট্রেলিয়া সিরিজে কুম্বলের নেতৃত্বে পার্থ টেস্ট জিতলেও, ওয়ান ডে তে তখন অধিনায়ক ধোনি। টি টোয়েন্টির সাফল্যের পরে ধোনির হাতেই সীমিত ওভারের সব দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন নির্বাচক রা। এই অবস্থায়, ওয়ান ডে সিরিজ থেকে বাদ পড়লেন সৌরভ, ফিটনেস এবং ফিল্ডিং এর মানের কারণে। ধোনির নেতৃত্বে আর গম্ভীর, শেবাগ, শচীনের মতো ‘বয়স্ক’ ক্রিকেটার দের পারফরমেন্স এর দৌলতে সিবি সিরিজের ফাইনালে ২-০ ফলে জিতে ইতিহাস গড়লেন ধোনি।
এই বছরেরই মার্চ মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা ফিরতি সফরে ভারতে আসে, ১-১ ফলে সিরিজ ড্র হয়। প্রথম টেস্টে শেবাগ দ্বিতীয় ট্রিপল সেঞ্চুরি এবং টেস্টের ইতিহাসের দ্রুততম ট্রিপল করে নজির সৃষ্টি করেন। পরের দুটি টেস্টে যথাক্রমে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত জেতে, দ্বিতীয় টেস্ট টি স্মরণীয় হয়ে আছে ডেল স্টেইনের নেতৃত্বে ভারতের ৭৪ অল আউট এর কারণে। যদিও এই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে সৌরভ ৮৭ রান করেন। তৃতীয় এবং নির্ণায়ক টেস্টে দুরন্ত ব্যাটিং করে সৌরভ আবারো ৮৭ রান করেন এবং খারাপ ভারতীয় পিচে ব্যাটিং এর একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। পর পর দুটি টেস্টে সাতাশি রান করায় আনন্দবাজার লিখেছিলো –
একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি..
হাসি হাসি করি সাতাশি, দেখে ভারতবাসী।
এরপরেই অস্ট্রেলিয়া ভারতে সিরিজ খেলতে আসে, আপামর বঙ্গবাসীকে স্তম্ভিত করে ৪ টেস্টের সিরিজ খেলেই অবসর নেবেন ঘোষণা করেন সৌরভ। এই সিরিজে ভারত ২-০ ফলে জেতে, সৌরভ বেশ ভালো পারফরমেন্স করেন, দ্বিতীয় টেস্টে তার ক্যারিয়ার এর শেষ সেঞ্চুরি করেন, এবং শেষ টেস্টে করেন ৮৫, যদিও শেষ ইনিংসে তিনি রান করতে পারেন নি, ব্রাডম্যানোচিত ০ করে তিনি তার বর্ণময় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার এ ইতি টানেন।
এই সিরিজেরই তৃতীয় টেস্টের পর অবসর নেন ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে। শেষ টেস্টে ধোনি যখন সৌরভ কে ক্যাপ্টেন্সি করতে বলেন, সেই সৌজন্য প্রদর্শন অনেক সৌরভ ভক্তকেও হয়তো আবেগমথিত করে তুলেছিল। ২০০৮ সালে অবশেষে শেষ হয় ভারতীয় ক্রিকেটের মহারাজ অধ্যায়। এর পরেও আইপিএলে তিনি খেলেছেন, কিন্তু সেগুলো আমার স্মৃতিচারণে ততটা উল্লেখযোগ্য নয়, যদিও প্রথম এবং তৃতীয় আইপিএল সিজন এ সৌরভ যথেষ্ট ভালো পারফরমেন্স করেছিলেন।
সৌরভের অবসরের পরেই প্রকৃত ভাবে ধোনি যুগ শুরু হয়। একের পর এক সিরিজে দেশে বিদেশে ভালো পারফর্ম করে ভারত, যদিও টেস্ট ম্যাচে দেশে দুর্দান্ত খেললেও, বিদেশে সেভাবে নজর কাড়তে পারেনি ভারত। যদিও এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০০৯ সালে নিউজিল্যান্ডে সিরিজ জয়। শচীন ও গম্ভীরের বিক্রমে প্রায় চল্লিশ বছর পরে নিউজিল্যান্ড থেকে সিরিজ জিতে ফেরে ভারত।
২০১১ সাল। এই বছরে আমি প্রথমবারের মত কোম্পানি চেঞ্জ করি, এবং সেই ইন্টারভিউ প্রসেস হয় ২০১১ বিশ্বকাপের মধ্যেই। আমাকে ব্যাঙ্গালুরু চলে যেতে হবে এই অবস্থায় আবারো কোম্পানির এইচ আরের সাথে কথা বলে জয়েনিং ডেট পিছিয়ে দিই কেননা এপ্রিল এর দুই তারিখে রয়েছে ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়াম এ বিশ্বকাপ ফাইনাল। আগের বিশ্বকাপে শোচনীয় ফল করার পরে সবার মধ্যে যেন একটা বিশ্বাস ঢুকে গেছিলো যে দেশের মাঠে এবারে কাপ আমরা পাবোই।
শচীনের শেষ বিশ্বকাপ, সবাই শচীনের জন্যে জিততে চান ইত্যাদি ইত্যাদি। এই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের দিন আমি অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম দেখবো বলে। অবশেষে প্রত্যাশামতোই ভারত ফাইনালে ওঠে এবং গ্ৰুপ লিগ ও নক আউটে শচীন, যুবরাজ এদের ভালো পারফরমেন্স এর পরে ফাইনালে মুম্বাই তে আচমকাই সচিন সেহওয়াগ কে শুরুতে হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ভারতীয় দল একটু কোহলি ও গম্ভীরের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর পরে হাল ধরলেন সেই তরুণ, না, এখন আর তিনি ঝাঁকড়া চুলের নন, বয়স, অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে সাথে চুলের মাপ কমে গেছে।
কপিল দেবের পরে বিশ্বকাপে কোনো ভারতীয় অধিনায়কের খেলা সেরা ইনিংস অবশ্যই ধোনির এই ৯১*, যা তাঁকে ম্যাচ সেরার পুরস্কারও এনে দেয়। গোটা টুর্নামেন্টে নিষ্প্রভ থাকার পরে ফাইনালে জ্বলে ওঠে মাহির ব্যাট, আর ভারত দ্বিতীয়বারের জন্যে ২৮ বছর পরে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। আমার মনে আছে, এই ম্যাচের পরে আবেগতাড়িত হয়ে আমি ফেসবুকে লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম যে ভারতের অধিনায়কদের মধ্যে আজকের পর থেকে ধোনিই শ্রেষ্ঠ, সৌরভ গাঙ্গুলি দ্বিতীয়।
এরপরে ধোনি সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অনেক কিছু অর্জন করেন। ৫০ এর উপরে গড় রেখে ১০০০০ রান, ওয়েস্ট ইন্ডিজে ত্রিদেশীয় সিরিজে শেষ ওভারে ১৭ রান আর এক উইকেট বাকি এমন অবস্থায় ৪ বলে খেলা শেষ করে দেওয়া, অনেক ম্যাচ বরফশীতল মস্তিস্ক নিয়ে শেষ ওভারে নিয়ে গিয়ে জেতানো, এগুলো সবই তার ব্যাটে এবং অধিনায়কত্বে আমরা দেখতে পাই। উইকেটকিপিংএও প্রভূত উন্নতি করেন তিনি এবং স্টাম্পিং ও ডিআরএসে অভাবনীয় দক্ষতা দেখান।
২০১৩ সাল। এই বছর স্মরণীয় চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের কারণে। শিখর ধাওয়ান, কোহলি, জাদেজা, অশ্বিন এদের পারফরমেন্সে ভর করে ভারত সেবার একটিও ম্যাচ না হেরে বিলাতে এই ট্রফি জেতে এবং প্রথম অধিনায়ক হিসেবে তিনটি আইসিসি ট্রফি জেতার নজির সৃষ্টি করেন মাহি।
এর পরে মাহি টেস্টে ২০১৪ সালে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন, ২০১৬ সালের টিটোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ সেমিফাইনালে হেরে গেলেও, ক্ষুরধার অধিনায়কত্ব এবং উইকেটকিপিং এর জোরে বাংলাদেশ ম্যাচ বের করা এখনো সবার মনে গেঁথে আছে।
সৌরভের মতো ধোনিও বেশ কিছু ক্রিকেটার কে তুলে এনেছেন। অশ্বিন, জাদেজা, রোহিত শর্মা কে ব্যাক করে সেরা ওপেনার বানানো, কোহলিকে গরুম করে পরবর্তী অধিনায়ক হিসেবে তৈরী করা, একটা ফাস্ট বোলিং ইউনিট বানানো যা কোহলি আরো উন্নত করে বিদেশে সিরিজ জিতবেন ইত্যাদি ভারতীয় ক্রিকেটে তার অবদান। সৌরভ যেমন একটা সেট টিম ছেড়ে গেছিলেন ধোনিকে, যে কারণে ধোনি শুরু থেকেই সাফল্য পেতে শুরু করেন, ধোনিও তেমনি মোটামুটি একটা সেট টিম দিয়েছেন কোহলিকে।
আজ সৌরভ আর ধোনি দুজনেই ভারতীয় ক্রিকেটে অতীত। কিন্তু অতীত মানেই তারা কিন্তু ব্রাত্য নন। আজও ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা হলে, গত কুড়ি বছরের প্রসঙ্গে তারা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, হয়তো বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বর্তমান অধিনায়কের থেকেও বেশি প্রাসঙ্গিক।
অদ্ভুত কিছু সমাপতনের কারণে এই দুজনের ভক্তকুল নিজেদের মধ্যে অহি নকুল সম্পর্ক তৈরী করেছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত, ভারতীয় ক্রিকেটে এই দুই কিংবদন্তির অবদান অনস্বীকার্য এবং দুজনেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম সেরা। সাত জুলাই, মহেন্দ্র ‘বাহুবলী’ ধোনির জন্মদিন, আর আট জুলাই সৌরভ ‘মহারাজ’ গাঙ্গুলির জন্মদিন। ভারতীয় ক্রিকেট কে নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে এই দু’টি দিন সত্যিই ঐতিহাসিক।