লারা আন্ডার প্রেশার!

এই জয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন ব্রায়ান লারা। হয়তো, এই ইনিংসটা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস নয়। তবে, এটা খুবই গুরুত্ববহ লারার ক্যারিয়ারে। এর আগে টানা ২৭ ইনিংস কোনো সেঞ্চুরির দেখা পাননি। টানা ছয় টেস্টে হার, আগের টেস্টের লজ্জার গ্লানি। তার ওপর, জ্যামাইকার দর্শকরাও লারার ওপর ক্ষুদ্ধ, কেননা তাদেরই ‘ঘরের ছেলে’ ওয়ালশকে সরিয়ে লারাকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। স্যাবাইনা পার্কে, টসের সময় লারা নাকি স্টিভ ওয়াহকে বলেছিলেন, ‘আজ হয়ত জীবনে শেষবারের মত টস করতে নামছি।’

ঠিক অপ্রতিরোধ্য না হলেও নব্বইয়ের দশকে ঘরের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের দাপট ছিল। তবে, সে সময় অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম এক পরাশক্তি। তাই এই দুই দলের লড়াইয়ের উত্তেজনা ছিল ভিন্ন রকম।

সাল ১৯৯৯। অস্ট্রেলিয়া তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। পোর্ট অব স্পেনে প্রথম টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মাত্র ৫১ রানে অলআউট হয়ে লজ্জাজনক রেকর্ডে নাম লেখায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৩৬৪ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ম্যাকগ্রার বোলিং জাদুতে ৫১ রানেই থামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইনিংস।

রিডলি জ্যাকবসের ১৯ ছাড়া কেউই পেরোতে পারেননি ৬ রানের কোটা! গ্লেন ম্যাকগ্রার দশ উইকেট শিকার অজিদের বিপক্ষে পাত্তাই পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। টেস্ট ইতিহাসে নিজেদের সর্বনিম্ন রানে আউট হওয়ার রেকর্ড গড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ!

দ্বিতীয় টেস্টের আগে তাই আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। ব্রায়ান লারা, পেদ্রো কলিন্স, কোর্টনি ওয়ালশ, রিডলি জ্যাকবসদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের এমন লজ্জাজনক রেকর্ড যেন মেনে নিতে পারেনি ক্রিকেট বিশ্ব।

গ্লেন ম্যাকগ্রাও তখন ফর্মের তুঙ্গে! ম্যাকগ্রার বিপক্ষে ওই সিরিজে নড়বড়েই ছিল ক্যারিবিয়ান ব্যাটাররা। তবে এমন লজ্জাজনক রেকর্ডের পর ব্রায়ান লারার দুর্দান্ত এক ডাবল সেঞ্চুরিতে জ্যামাইকায় ঐতিহাসিক জয়ে সব সমালোচনা যেন থমকে যায় মুহূর্তেই!

প্রথম টেস্টে ক্যারিবিয়ানদের হারিয়ে তখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে অজিরা। অপরদিকে, ঘরের মাঠে লজ্জাজনক পরাজয়ে ব্যাকফুটে ক্যারিবীয়রা। দ্বিতীয় টেস্টে তাই জয় ছাড়া কিছুই ভাবছিল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জ্যামাইকার স্যাবাইনা পার্কে টসে জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে স্টিভ ওয়াহর সেঞ্চুরি ও মার্ক ওয়াহর হাফ সেঞ্চুরির পরেও মাত্র ২৫৬ রানে অলআউট অস্ট্রেলিয়া!

ওয়াহদের দুই ভাই ছাড়া কোর্টনি ওয়ালশ, পেদ্রো কলিন্সদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি আর কোনো ব্যাটার! স্টিভ ওয়াহর ১০০ ও মার্ক ওয়াহর ৬৭ ছাড়া দুই অঙ্কের কোটা পেরিয়েছিলেন মাত্র দু’জন! ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ওয়ালশ ৪ ও কলিন্স নেন ৩ উইকেট।

জবাবে দ্বিতীয় দিনের শুরুতে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৩৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে চরম বিপাকে তখন ক্যারিবিয়ানরা।  ধারাভাষ্যকাররা বলাবলি করছিল, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফলো-অন এড়াতে পারবে তো?’ সাত রানে অপরাজিত থেকে প্রথম দিন শেষ করেন লারা।

পঞ্চম দিনে আরো বিপদ। পঞ্চম উইকেটে ব্রায়ান লারার সাথে ২২ রান যোগ করতে ইনজুরিতে পড়ে মাঠের বাইরে পেদ্রো কলিন্স! গ্লেন ম্যাকগ্রার দাপটের সামনে ক্যারিবিয়ানরা তখন অসহায়।

জিমি অ্যাডামসকে নিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন লারা। লারাকে সেদিন যোগ্য সঙ্গই দিয়ে গিয়েছেন জিমি অ্যাডামস।  ধীরে ধীরে দু’জনে মিলে দলকে টেনে তোলেন খাদের কিনারা থেকে।

সেদিন শুরুতে একটু দেখে শুনে সাবধানেই খেলছিলেন লারা। শট নির্বাচনের বেলাতেও ছিলেন বেশ হিসেবি, আসলে ম্যাচের চাহিদাই ছিল তেমন।  প্রথম ৫০ রান তুলতে বল খরচ করলেন ১৪০টা! তবে পঞ্চাশ পেরোনোর ঠিক পরপরই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন তিনি।

শুরুটা করলেন স্বয়ং শেন ওয়ার্নকে লং অনের ওপর দিয়ে সোজা গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে। নিজের সহজাত স্ট্রোক-প্লে দিয়ে ক্রমেই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে আরম্ভ করলেন লারা। শুধু মোড় ঘোরানোই নয়, হারানো ফর্মটাও ফিরে পেতে শুরু করলেন লারা।

একপ্রান্তে জিমি অ্যাডামসের অবিচল নিষ্ঠা ও সংযত প্রতিরোধ, আর অন্যপ্রান্তে কাউন্টার অ্যাটাকিং স্টাইলে খেলে বোলারদের রীতিমতো কঁচুকাটা করছিলেন লারা।  দিনশেষে লারা মাঠ ছাড়লেন ২১২ রানে অপরাজিত থেকে; অ্যাডামসের নামের পাশে লেখা ৮৮ নট আউট।

আর ৯০ ওভার বোলিং করে অস্ট্রেলিয়ার পুরো বোলিং ইউনিট ছিল উইকেট শূন্য! ম্যাকগিলের বলে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ ছক্কা আর শেন ওয়ার্নের এক ওভারে টানা চার বলে বাউন্ডারি হাঁকানোর দৃশ্যটাই দিনে লারার ইনিংসের হাইলাইটস।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ চার উইকেটে ৩৭৭ রান নিয়ে দিন শেষ করে। মানে, গোটা দিনে ৩৪০ রান তুলে তাঁরা বিনা উইকেটে। লারা আউট হয়েছিলেন পরদিন সকালে, ৩২২ রানের ম্যারাথন জুটিটা ভেঙেছিলেন ম্যাকগ্রা। লারার ৩৪৪ বলে ২১৩ রানের ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি’ ইনিংসটাতে ছিল ২৯টি চার ও ৩টি ছক্কার মার। পঞ্চম উইকেটে জিমি অ্যাডামসের সাথে মিলে গড়লেন ৩২২ রানের জুটি! 

তৃতীয় দিনের শুরুতেই ২১৩ রানে ম্যাগ্রার বলেই আউট হন লারা। ৩৪৪ রানের ইনিংসটা ছিল ২৯ টি চার ও তিনটি ছক্কায় সাজানো। এরপর ম্যাকগ্রার পঞ্চম শিকার হয়ে দ্রুতই ফেরেন অ্যাডামস। সেঞ্চুরি থেকে মাত্র ৬ রান দূরে থাকতে ৯৪ রানের এক আক্ষেপময় ইনিংস শেষে আউট হন জিমি অ্যাডামস। লারার অনবদ্য ইনিংসে ৪৩১ রানে থামে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাকগ্রা ৫ ও স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল নেন ৩ উইকেট।

১৭৫ রানে পিছিয়ে থেকে ব্যাট করতে নেমে কোর্টনি ওয়ালশ, নিহেমিয়াহ পেরির দাপুটে বোলিংয়ে মাত্র ১৭৭ রানেই গুড়িয়ে যায় অজিরা! মাত্র ৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ১০ উইকেটের দাপুটে জয় পায় ক্যারিবীয়রা। এক সময় ম্যাচ থেকে ছিটকে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ  ইতিহাস রচিত প্রত্যাবর্তনে স্যাবাইনা পার্কে ১০ উইকেটের বিশাল এক জয়ে মাঠ ছাড়ে!

এই জয়ে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন ব্রায়ান লারা। হয়তো, এই ইনিংসটা তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস নয়। তবে, এটা খুবই গুরুত্ববহ লারার ক্যারিয়ারে। এর আগে টানা ২৭ ইনিংস কোনো সেঞ্চুরির দেখা পাননি। টানা ছয় টেস্টে হার, আগের টেস্টের লজ্জার গ্লানি।

তার ওপর, জ্যামাইকার দর্শকরাও লারার ওপর ক্ষুদ্ধ, কেননা তাদেরই ‘ঘরের ছেলে’ ওয়ালশকে সরিয়ে লারাকে ক্যাপ্টেন করা হয়েছে। স্যাবাইনা পার্কে,  টসের সময় লারা নাকি স্টিভ ওয়াহকে বলেছিলেন, ‘আজ হয়ত জীবনে শেষবারের মত টস করতে নামছি।’

কে জানতো, সেই স্যাবাইনা পার্কই ক্রিকেটের বরপুত্রের জন্য কি বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষায় ছিল!

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...