নব্বই দশকে প্রথম পাওয়ার প্লের ১৫ ওভার কাজে লাগানোর জন্য প্রথম ‘পিঞ্চ হিটিং’ ব্যাপারটা সামনে আনে নিউজিল্যান্ড। তবে শ্রীলঙ্কাই এটাকে প্রথম সার্থক শিল্পে রূপ দেয়। কোচ ডেভ হোয়াটমোরের পরিকল্পনায় এই মারকাটারির অন্যতম রূপকার ছিলেন লোয়ার অর্ডার থেকে উঠে আসা সনাথ জয়াসুরিয়া।
সনাথ জয়াসুরিয়া; শ্রীলংকান ক্রিকেট কিংবদন্তি। নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটের হিসাব নিকাশ বদলে দেয়া এক ব্যাটসম্যান। মারকাটারি ব্যাটিংয়ের জন্য লোকে তাঁকে বলতো-মাতারা হ্যারিকেন।
আধুনিক কালের খুব কম ক্রিকেটারদেরকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে। তাঁর মধ্যে একজন হলেন সনাথ জয়াসুরিয়া।
উপমহাদেশের স্টেডিয়ামগুলোতে ফ্লাড লাইটের আলোতে নীল হেলমেট পরিহিত একজন ব্যাটসম্যান বোলারের ভুল বলগুলোকে পয়েন্টের উপর দিয়ে মাঠ ছাড়া করছেন। আর সাথে সাথেই স্টেডিয়ামের দর্শকরা উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলছে ‘স-না-থ’। ৯০ এর দশকে ক্রিকেট মাঠে ব্যাটিং এর মাধ্যমে বিনোদন দেয়া একমাত্র ক্রিকেটার ছিলেন সনাথ জয়াসুরিয়া।
সনাথ জয়াসুরিয়া; তর্ক সাপেক্ষে বিশ্বের অন্যতম সেরা বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান। এই সময়ে আরো অনেক ব্যাটসম্যান ছিলেন যাদেরকে বল করতে বোলারদের বুক কাঁপে। ওই সময়ের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শচীন টেন্ডূলকারের নিয়মিত পারফর্মেন্স, ব্রায়ান লারার সুন্দরতম ব্যাটিং এবং জয়াসুরিয়ার পাওয়ার হিট আপনাকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। শুধু পাওয়ার হিট নয়, ওয়ানডে ক্রিকেটের ধারণাটাই বদলে দিয়েছেন তিনি।
সনাথ জয়াসুরিয়ার বেড়ে জন্ম এবং বেড়ে উঠা শ্রীলংকার একটি ছোট্ট শহর মাতারাতে। সেখানেই নিজের ক্রিকেটীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটান জয়াসুরিয়া। সেন্ট সার্ভেটিয়াস কলেজে পড়ার সময়ে চোখে পড়েন কলেজে প্রিন্সিপাল এবং কোচের।
১৯৮৮ সালে অবজারভার স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টের মাধ্যমে নজরে আসেন সনাথ জয়াসুরিয়া। একই বছর শ্রীলংকাকে প্রতিনিধিত্ব করেন প্রথম অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। অনুর্ধ্ব-১৯ দলে ভালো খেলার সুবাদে একই বছরই সুযোগ পান শ্রীলংকা ‘বি’ দলে পাকিস্তান সফরে। এই সিরিজেই করেন একটি মারকুটে দ্বিশতক।
১৯৮৯-৯০ সালে শ্রীলংকা দলে প্রথম ডাক পান মাতারা হ্যারিকেন খ্যাত সনাথ জয়াসুরিয়া। ১৯৮৯ সালে মেলবোর্নে বক্সিং ডে ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হয় তাঁর। এরপর দুই বছর পর ১৯৯১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে অভিষেক ঘটে তাঁর।
সব ব্যাটসম্যানই একটি বিশেষ ইনিংসের জন্য মনে থাকে। যেমন, ব্রায়ান লারা সব ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে থাকবেন প্রথম এবং একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে ৪০০ রান করার জন্য। এছাড়াও ২০০৭ বিশ্বকাপে অ্যাডাম গ্রিল্ক্রিস্টের করা ১৪৯ রানের ইনিংসের জন্য তাকে মনে রাখবে ক্রিকেট প্রেমীরা। সেই রকম একটি ভয়ডর ইনিংস আছে সনাথ জয়াসুরিয়ার।
সনাথ জয়াসুরিয়া ছিলেন একজন বাহাতি বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান। ২০০০ সালে ভারতের বিপক্ষে ১৮৯ রানের একটি ইনিংস খেলেন এই বাহাতি ব্যাটসম্যান। এই ইনিংস খেলার পথে ২১ চার এবং ৪ টি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। ভারতীয় বোলারদের উপর রীতিমত রোলার কোস্টার চালিয়েছিলেন তিনি।
জয়াসুরিয়ার এই ইনিংসে ভর ক্অরে ভারতকে ২৪৫ রানে বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছিলো শ্রীলংকা। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপের আগে শ্রীলংকাকে বড় কোনো দল হিসেবে বিবেচিত করা হত না। কিন্তু বিশ্বকাপ জেতার পর থেকেই অন্যান্য দলের সমীহ পেতে শুরু করে শ্রীলংকা। আর এর পিছনে অনেকটাই অবদান আছে সনাথ জয়াসুরিয়ার ভাবলেশহীন ব্যাটিং।
জয়াসুরিয়ার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের সূচনা হয় মূলত ১৯৯৬ বিশ্বকাপ আগে আগে সময় থেকে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে মারকুটে ব্যাটিং শুরু করেন তিনি। এরপর থেকেই এটাই তাঁর ট্রেড মার্ক শট হিসেবে দাঁড়ায়।
জয়াসুরিয়ার ট্রেডমার্ক শট ছিলো পুল এবং কাট। ১৯৯৬ সালে শ্রীলংকার বিশ্বকাপ জয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন তিনি। ক্রিকেট মাঠে সবসময়ের আগ্রাসী মনোভাবের নতুন করে সৃষ্টি করা এই ব্যাটসম্যান নিজেকে করে তুলেছেন অনন্য। ক্রিকেটে বেশ কিছু দূর্দান্ত ইনিংস খেললেও খারাপ খেলা ইনিংসের সংখ্যা কোনো অংশে কম নয় সনাথ জয়াসুরিয়া। তিনি যেভাবে ব্যাটিং করতেন, তাতে যদি কিছুটা নিয়মিত রান করতে পারতেন তাহলে হয়তো ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হতে পারতেন।
জয়াসুরিয়া মূলত ছিলেন বোলিং অলরাউন্ডার; প্রথম ক্যারিয়ারে নিচের দিকে ব্যাট করতেন। দূর্দান্ত বোলিং করতেন। ওয়ানডেতে শিকার করেছেন ৩০০ এর উপরে উইকেট। যেকোনো বাহাতি আর্ম স্পিনারের মধ্যে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড এটা।
বাহাতি আর্ম স্পিনারদের মধ্যে সর্বোচ্চ চারবার পাঁচ উইকেট নেয়ার রেকর্ড আছে তাঁর। সনাথ জয়াসুরিয়ার কথা আসলে বোলিং এর থেকে বেশি আলোচনা হয় তাঁর ব্যাটিং নিয়ে। দলের দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে বেশ কার্যকর ছিলেন তিনি।
ওয়ানডে ক্রিকেটে বেশ সফল এই ব্যাটসম্যান। কিন্তু ওয়ানডে পরিসংখ্যানের কাছে তাঁর টেস্ট পরিসংখ্যান বেশ ধূসর। ১১০ টেস্ট খেলে করেছেন মাত্র ৬৯৭৩ রান এবং বল হাতে নিয়েছেন মাত্র ৯৮ উইকেট। ২০০৬ সালে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন জয়াসুরিয়া কিন্তু নির্বাচকদের ডাকে সাড়া দিয়ে আবারো টেস্ট ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। মাত্র ১৮ মাস পরে একবারে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি।
২০১১ সালের বিশ্বকাপের পর সবধরনের ক্রিকেটকে বিদায় জানান সনাথ জয়াসুরিয়া। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪৪৫ তম ম্যাচে ক্রিকেটকে বিদায় জানান। তিনি যখন ক্রিকেটকে বিদায় জানান, তখন তিনি ছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেট সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ক্রিকেটার। কিন্তু পরবর্তীতে এই রেকর্ড ভেঙে নতুন করে গড়েন ক্রিকেট ঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকার।
ক্রিকেট ক্যারিয়ারে খুব বেশি তর্ক কিংবা বির্তকে জড়াননি মাতারা হ্যারিকেন খ্যাত সনাথ জয়াসুরিয়া। কিন্তু ক্রিকেট ক্যারিয়ারের পর জাতীয় দলের সাথে সংযুক্ত ছিলেন তিনি। এই সময়ে তাঁর বিপক্ষে অভিযোগ উঠে ফিক্সিংয়ের। আর এই ফিক্সিংয়ের এই দায়ে দুই বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন। ক্রিকেট ছাড়ার পর শ্রীলঙ্কা দলের ম্যানেজার এবং নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেছেন সনাথ জয়াসুরিয়া। এছাড়াও শ্রীলঙ্কায় রাজনীতিতে জড়িত আছেন তিনি।
সনাথ জয়াসুরিয়া মূলত ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আইসিসির দূর্নীতি বিরোধী ইউনিট আকসুকে তথ্য দিতে বিলম্ব করায়। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিলো আকসুর চাওয়া নথি পত্র নষ্ট করার অভিযোগ। এইসব কারণেই নিষিদ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তবে, নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফিরেছেন তিনি।
ক্রিকেটে তৈরি করে দেয়া আগ্রাসী ব্যাটিং এর ধারক হিসেবে বিবেচিত হবেন সনাথ জয়াসুরিয়া। তাঁর সৌজন্যেই ক্রিকেট বিশ্ব পরিচিত হয়েছে এই আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের।